রম্য রচনা- শুকনো কেস

শুকনো কেস

-অমল দাস

 

পাড়ার প্রীতি বৌদিকে বেশ ভালোই লাগে আমার। যত দিন যায় ততই যেন চাঙ্গা হয়ে উঠছে। যেমন গৌরবর্ণ ত্বক তেমনই আকর্ষণীয় দেহ। মুখশ্রী দেখলেই প্রাণে দোলা লেগে যায়। আলাপ আছে, মাঝে মাঝে বৌদির সাথে কথা হয় বইকি! কিন্তু মন যেন অমোঘ কিছু চায় তার কাছে। বৌদির একটা ছেলে আছে তুহিন, ষোলো বছরের, বেশ ডানপিটে। আর বৌদির ছোট বোনটাও এ বাড়িতেই থাকে। রাই, বয়স বছর কুড়ি হবে! বৌদির বাবা আগেই গত হয়েছেন! মা সদ্য মারা যাওয়ায় সত্যদা (বৌদির স্বামী) ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। মাসি ও বোনপো জুটি বেশ একাত্ম হয়ে উঠেছে। এদের দুইয়ের আচার-ব্যবহারে পাড়ায় বিস্তর অভিযোগ আছে। যদিও আমার খারাপ কিছু মনে হয় না। ওরা বর্তমান সমাজের, দু’জনেই বেশ খোলা মনের, প্রায় একসাথেই থাকে হাসি ঠাট্টায়ও বেশ মশগুল। নিন্দুকের হয়তো এতেই আপত্তি।

প্রত্যেক রবিবারের মত এ রবিবারও ছুটির দিন বৌদিদের বাড়ির সামনের গলি পথে  নদীতে স্নান করতে যাই। প্রখর গরমে মুক্ত জলে স্নানের উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য একটিই একবার হাঁটা পথে বৌদির দর্শন। রাস্তার পাশেই তার রান্না ঘরের জানলাটা। হালকা বাদামী রঙের লম্বা চুলের একটা বড় ঝুলন্ত খোঁপায় হলদে শাড়ির আঁচলটা পিঠ থেকে ঘুড়িয়ে এনে নাভির কাছে গুঁজে দিয়ে ডালের কড়াইয়ের হাতা নাড়া অবস্থায় একনজর দেখে বেশ দারুণ লাগে। মনে হলো যেন ফুটন্ত ডালে ডুব দিয়ে সমস্ত তৃষ্ণা মিটিয়ে নিই এক নিমিষে। কিন্তু বাস্তবটা তো অন্য! ভাবি সে কেন এখানে পড়ে আছে! সে আমার কেন নয়। বয়সের পার্থক্য আছে তবুও…ফালতু উচাটন..  

একটু আড় চোখে দেখতে দেখতেই বৌদির সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়, সে একটা মুচকি হাসি দিতেই আমার সারা শরীরে যেন উৎসুক আর উদ্দীপনার চোরা স্রোত বইতে লাগলো। জানলায় এঁটে যেতে ইচ্ছা ছিল! কিন্তু আঁটলাম না, সামনে হাঁটলাম।

পূবালী হাওয়ায় বেয়ে মৃদু স্বরে বৌদির একটা ডাক ভেসে এলো- ‘রূপম…’

আমি শুনলাম! ভাবলাম আমার ভ্রান্তি, না শোনার ভান করলাম। বৌদি ভাবলো শুনিনি! সে আবার ডাকলো – রূপম একবার শুনবে..!

এবার যেন কানকে বিশ্বাস হলো যে, ঠিকই শুনেছি তাহলে। আপ্লুত আমি জানলার কাছে ফিরে গেলাম। আমি কিছু জিজ্ঞাস করি তার আগেই সে বললো- এখানে নয় গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে এসো।

হঠাৎ কেমন যেন একটা শিহরণ জেগে গেল সমস্ত শরীরে। ভয় আনন্দ মিশ্রিত এক অভিনব আলোড়ন হতে লাগলো মনের মধ্যে। সামনের গেটটা খুলে ভিতরের দিকে যেতেই দেখি বৌদি একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আগ্রহ নিয়ে কিছুটা কেঁপে ওঠা গলায় প্রশ্ন করলাম- কিছু বলবে বৌদি?

বৌদি তৎক্ষণাৎ ডানহাতের তর্জনীটি ঠোঁটে চেপে ধরে একটা আওয়াজ দিলো হিশ্‌শশ… …

আমারও ঠোঁটে যেন আড়ষ্টতা এসে গেল। তার চুপ করানোর ইশারা যেন তীরের মত গেঁথে গিয়েছিল অন্তরে। বৌদি খুব নিচু সুরে বললো- এখানে এসো কথা আছে।

একেই বৌদির রূপে আমি উচ্ছন্নে যাই তার উপর চাপা স্বরে সামনে থেকে হাতছানি আমার রক্ত আরও তেজে ছুটতে লাগলো শিরায়। রোমকূপ যেন ফুলে উঠতে লাগলো, রোমগুলোও সব ফণা তুলে খাড়া। আর কি কি সাপের মত ফণা তুলতে হতে পারে জানিনা! তবে নিমেষে গায়ের তোয়ালেটা নামিয়ে কোমরে হাফ্‌ প্যান্টের উপর জড়িয়ে নিলাম। কেন? সে নাই বললাম।

কাছে, বৌদির একদম কাছে যেখানের নিঃশ্বাসের আওয়াজ নেওয়া যায় সেখানে গিয়ে বললাম- কি ব্যাপার আজ দুপুরে ডাকলে যে?

বৌদি আবারও চাপা সুরে- একমাত্র তুমিই পারবে আমার উৎসুক মেটাতে! তাই..

আমার আনন্দ আর আমার আয়ত্বে নেই, কথাটা লুটে নিয়েই জানতে চাইলাম – তা সব কি এই খোলা বারান্দায় এখানেই হবে, না ঘরে?

-আস্তে কথা বলো! সাবধানী স্বরে বললো।

– কেউ আছে ঘরে? জানতে চাইলাম অন্তরের বাঁধনহারা পুলকে।

-থাকলে কি আর এই দুপুরে তোমায় ডাকতাম আমার দেওর সোনা।

এই বলে সে আমার ডান দিকের গালটা হালকা টিপে দিলো। আর যাই কোথায়। আমি আর আমাতে নেই। কামনার দহনে সম্পূর্ণরূপে পুড়ে ছাই হতে লাগলাম। মনে হলো এখুনি বৌদির নীল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি ডুবে যাই তলে, গভীর তলে। থামিয়ে দিই সুদীর্ঘ জ্বলনের জ্বালা। বললাম- আর দেরি সইছে না যে বৌদি! তাড়াতাড়ি কর!

বৌদি যেন তার ঐশ্বরিক ক্ষমতায় আমাকে সম্পূর্ণ পড়তে পেরেছিল। সে হেঁয়ালিতে বললো- নদীতে জালা ডুবিয়ে পূর্ণ করবে, না জল এনে জালা ভরবে।

বৌদির প্রায় ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে বললাম- জালা যে ভাবে ভরতে চায় সে ভাবেই  ভরে দেবো, বাধ্য ছেলে… দ্বিতীয় আর নেই আমার মত।

বৌদি আমার উন্মুক্ত বুকে আলতো ভাবে তার দুই হাতের তালু দিয়ে পিছনে ঠেলে দিয়ে চোখের ইশারায় দেখিয়ে বললো- লক্ষ্মী সোনা যাও তবে ওই দিকে..  

আমি আমোদী সুরে হেলেদুলে বললাম- আবার ওইদিকে কেন বৌদি? ঘরে নয়!  

-না না!লক্ষ্মীটি ঘরে একদম নয়। ওই গোয়াল ঘরের পাশের ঘরে। (গোয়াল ঘরটা মূল বাড়ির দক্ষিণে দু’পা হেঁটে।) 

-ধু….স্‌ বৌদি! ওখানে তো নোংরা খড় কাঠে ভর্তি ঘরটা।

-তাতে কি হয়েছে গো…!

-ওখানে কি ভাবে হবে?

-কেন তুমি কি শুতে যাচ্ছো ওখানে? যা হবে দাঁড়িয়েই হবে! এতো চিন্তা করোনা।

-না! মানে ওই গাছপালার মধ্যে তুমি আর আমি দাঁড়িয়ে….! কেউ দেখে ফেললে!

-কেউ দেখবে না! আর দেখলেই বা কি? আমি নই তুমি! তুমি একা!

আমি তো অবাক! তুফান বিনা নারকেল গাছের মত গোড়া থেকে ভেঙে পড়লাম। প্রায় আশাহত মৃত কণ্ঠে গভীর আর্তনাদে নির্বোধের মত জানতে চাইলাম -আমি! একা? মানে.. কি করবো..?

বৌদি যথেষ্ট আব্দারে রসে ডুবুডুবু সুরে বললো- ভুল বুঝো না! একটিবার যাওনা গো.. কেউ একটা ওখানে ঢুকেছে। পিছন দিকটা দিয়ে ঘুরে একবার লুকিয়ে দেখে আসো না কে!

আমার যৌবনী নৌকা চোখের সামনে ডুবে গেছিলো একটু আগেই, এবার আমি মর্মাহত। সমস্ত আশায় জলাঞ্জলি হয়ে গেলো। অগত্যা বৌদিকে আর নিরাশ করলাম না, আমি যতই নিরাশ হই। বললাম একা নয় তুমিও সাথে চলো।

-আবার আমিও! কি একটা ভাবল তারপর বললো- আচ্ছা চলো, তবে সাবধানে চুপিচুপি কোন রকম আওয়াজ না হয়!

পিছন দিক দিয়ে ঘুরে যখন গোয়ালঘরের পাশের ঘরের জানলার কাছে পৌঁছলাম তখন দু’টো অস্ফুট স্বর শুনতে পেয়ে আমরা আরও সাবধানী হয়ে গেলাম। কে বা কারা জানি না। আমাদের দেখে না নেয়, তাই দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে কান পাতার চেষ্টা করলাম।

একটি ছেলের কণ্ঠ- এ রাই নাড়তে বললি যে। সেই থেকে নেড়েই যাচ্ছি! পড়ছে কই?

একটি মেয়ের কণ্ঠ- আহ্‌ ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? নাড়তে থাক ধীরে ধীরে। আগে ফুলে উঠবে, তারপর দেখবি বাড়বে! তারপর.. পড়বে!

আমার বুঝতে আর বাকি রইল এরা সেই গুণধর মাসি বোনপো, যাদের নিয়ে পাড়ায় চর্চা চলে। কিন্তু একি শুনছি আমি.. তাহলে নিন্দুকেরা কি ঠিক! বৌদি কিছু শুনলো কিনা জানি না। আমার কান আরও দৃঢ় হয়ে খাড়া হয়ে গেলো কৌতূহলে।

তুহিন- নেড়েছি তো..! ফুলেও উঠেছে, কিন্তু পড়ছে কই?

রাই- তোর সবটায় তাড়া! নাড়তে নাড়তে মজা নে… ঠিক পড়বে।  

তুহিন- আমি আর পারছিনা, নে তুই একটু নেড়ে দে..।

রাই- তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না! ভোগের ইচ্ছে খুব, অথচ ধৈর্য্য নেই।

তুহিন- ধুর! ওর থেকে বোঁটায় টান দিয়ে দুধ বার করা অনেক সহজ! এতে তো গরম, ঘাম আর খাটনি।

একটু চুপ থাকার পর আবার মাসি- নে এবার পড়ার সময় হয়ে এসেছে বুঝি, তুই ধর! আমি একটা বাটি নিয়ে আসি চুপিচুপি, তুলে রাখতে হবে তো!

মানে! এ কি শুনছি? বাটিতে ধরবে সেটা…ছিঃ ছিঃ! আমি আর সইতে পারলাম না, আড়াল ভেঙে বেরিয়ে ওদের কিছু একটা বলতে যাবো অমনি দেখি বৌদি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় কেমন সমস্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে ঝড়ের গাছের মত ডালপালা সমেত হুড়মুড়িয়ে পড়ল আমার উপর। বুঝলাম বৌদি সবই শুনেছে, অনাচার সহ্য হয়নি, তাই এই অবস্থা। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বৌদিকে তো ভালো লাগে, আশাও করি কিন্তু এভাবে আমার গায়ে লুটিয়ে পড়বে বা এইভাবে আমি তাকে জড়িয়ে ধরবো তা কল্পনা করিনি। পাতা আর গাছের ডাল পালায় ঝরঝর করে আওয়াজ হওয়াতে ওরা’ও জানলা দিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে পড়ল। তুহিন অবাক চমকিত চোখে তাকিয়ে বললো- তোমরা এখানে কি করছো? আর মায়ের কি হয়েছে?

রাইও আকস্মিক উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত সুরে- দিদির কি হলো গো.. এই দিদি..

সে জানলা টপকে এদিকে বেরতেই যাবে আমি থামালাম- থামো আসতে হবে না, উগ্র কণ্ঠে জানতে চাইলাম- এখানে দুজনা! এসব কি নোংরামি হচ্ছে?

তুহিন থতমত খেয়ে সভয়ে বলল- কি! কি হচ্ছে?

-‘কি করছিলে’ উচ্চ কণ্ঠ ঝাড়লাম!

রাই প্রশ্নের ভীতি কোনমতে সামলে – কেন দুধ গরম করছিলাম তো!

আমি এবার অবাক -মানে?

– ‘ও’ দুধের সর খেতে খুব ভালোবাসে তাই!

-তা.. ঘর ছেড়ে এখানে কেন?

– জামাইবাবুকে ডাক্তার দুধের সর খেতে বারণ করেছে কোলেষ্ট্রল বেড়ে যাওয়ার ভয়ে। একই ভয়ে দিদি ওকেও দেয়না, অথচ ওর খুব প্রিয়। তাই এখানে লুকিয়ে….

 

শুরু থেকেই আমার সব ধারনাই আজ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমিও এবার প্রায় নিশ্চল পাথর, কি হয়েছে আর কি ভাবছি। বৌদিও বোধকরি শুনে একটু আশ্বস্ত হলো, ভুল ভাঙল হয়তো! সে ওঠার চেষ্টা করলো, আমিও হাত ধরে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তুহিনকে বললাম- এদিকে আয় একটু ধর।

আহাম্মক বলে কিনা  ‘তুমি মাকে একটু নিয়ে যাও ঘরে, আমি দুধের সরটা খেয়ে আসছি’।

কেমন বেআক্কেল বুঝুন! মা আমার উপর এলিয়ে পড়ে আছে, আর ছেলে দুধের সরে ডুবে। যাই হোক আমি কোনমতে ধরে ধীরে ধীরে বৌদিকে ঘরে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিলাম। কোথায় ডুবে যেতে চেয়েছিলাম আর কোথায় ফেঁসে আছি। মাসি বোনপো গোয়ালঘরের আড়াল থেকে একে অপরের ঠোঁট মুছতে মুছতে বেরোচ্ছে। আর আমি হাফ্‌ প্যান্টটা একটু কোমরের উপর তুলে খালি গায়ে তোয়ালেটা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। এমন সময় সত্যদা বাইক নিয়ে ঢুকে হাঁ করে দেখছে। ওদিকে ওদের, এদিকে আমাকে ওই অবস্থায় দেখে কি বুঝল জানি না! কিন্তু গভীরতা বুঝে একবার চিৎকার করে উঠলো- ‘রূপম! আমার সর্বনাশটা হয়ে গেলো। ওরে কে কোথায় আছিস ধর’ বলতে বলতে গলাটা প্রায় শুকিয়ে গেলো। কেউ শুনল কিনা জানিনা। সে উঠোনের মাটিতে মাথায় হাত রেখে ‘থ’ মেরে বসে গেলো।

আমি বুঝলাম অবস্থা বেগতিক, এ সময় আমার কথা কেউ শুনবে না। লোক জমায়েত হলে ‘লিনচিং’ ঘটতে পারে। এই শুকনো কেস থেকে বাঁচতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে যতেই মাসি বোনপোকে বললাম এবার সামলাও আমি পালালাম।    

 

Loading

8 thoughts on “রম্য রচনা- শুকনো কেস

  1. দারুন একটা রম্য গল্প। অনন্য লেখনীতে অপার মুগ্ধতা।

Leave A Comment