পেট বড় বালাই
– রাখী চক্রবর্তী
‘আজ পাতে ভাত ডাল/ রান্নার একি হাল।’
‘রাঁধুনি না আনলে/ উপসী থাকবে কাল।’
‘বলো কি গিন্নি/ এ যে ঘোর অনাচার।’
‘দাসী বাঁদী নই আমি/ বৌ যে আমি তোমার।’
রাঁধুনি নেই তাই দিগম্বর বাবু ও চন্দ্রাবতী দেবীর সংসার অচল।
পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন চন্দ্রাবতী দেবী আজকের মধ্যে রাঁধুনি আনতেই হবে।
দুপুর বেলায় ভাত খেয়ে নিম কাটি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে দিগম্বর বাবু বললেন কি রে, বাঙালী রান্না কি পারিস?
-আজ্ঞে কর্তা মশাই শুক্তো থেকে তেলেভাজা আর ডাল থেকে সন্দেশ সবই পারি শুধু একবার খেয়ে দেখেন।
-দুপুরের পদ রাতে চলবে না। এই বলে দিলুম। কি নাম তোর?
-আজ্ঞে শশধর চক্রবর্তী
-কি গো গিন্নি, এসে দেখো রান্নার ছেলে এসেছে।
পানের পিক না ফেলে ঢোক গিলতে গিলতে চন্দ্রা দেবী বললেন, এই ছোকরা কিনা আমাদের জমিদার বাড়ির রাঁধুনি হবে। বলি তোমার মাথা ঠিক আছে তো।
-আঃ হা্ গিন্নি, ও সব রান্না জানে। তা না হলে বলছি কি।
-অ, তা কি কি পারে ও রাঁধতে?
-শুক্তো, ধোঁকা, মাছ, মাংস, ডিম, চচ্চড়ি সব রকমের ডাল মিষ্টি আরও অনেক কিছু।
-তাহলে ঐ কথাই রইল। কাল সককাল সককাল চলে এসো।
-দেখো আবার যেন আমাদের ধোকা দিয়ে না চলে যায়। আগের রাঁধুনির মতো। চন্দ্রা দেবী এখন আর কাউকে বিশ্বাস করেন না।
– মালতী কি ভালোই না রাঁধত! চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল ব্যাস তারপর থেকে আর কাজেই এল না!
ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক রান্না করছিল সেদিন মালতী। ভাগ্যিস আমি রান্নাঘরে গেছিলাম তখন। ছোট টিফিন কৌটোতে দু’ পিস ইলিশ মাছের পেটি দিব্যি তুলে রাখল। সেই দিন আমি হাতে নাতে ধরলাম মালতীকে। তার মানে রোজ চুরি করিস তুই।
মালতী অবশ্য কোন কথার উত্তর দেয়নি।
– শোন শশধর, একটা কথা বলে রাখলাম খাবার কিন্তু চুরি করবে না।
– না না, গিন্নি মা বামুনের ছেলে চুরি করব না।
– মালতীও বামুনের বৌ ছিল।
যাইহোক শশধর গিন্নি মাকে আশ্বাস দিয়ে বাড়ি চলে গেল।
পরের দিন খুব সকালে কাজে এল শশধর।বিশাল বড় উঠোনে উনুন পাতা আছে। সেই উনুন জ্বালাবার আগে শশধর গিন্নি মাকে ডাকলো ।
– গিন্নি মা আজ কি কি রান্না হবে?
– চিংড়ি মাছ দিয়ে পুঁই শাক, মটর ডাল, দু’ তিন রকমের ভাজা কর আর কাতলা মাছের কালিয়া,কচি পাঁঠার ঝোল। পায়েস করিস আজ। আমার ছোট ছেলে খাবে বলেছে।
আর রাতের জন্য হিংএর কচুরি, ছোলার ডাল নারকেল দিয়ে, মুরগির ঝাল।
শশধর বলল, – মা একটা থালাতে
সর্ষের তেল, সিঁদুর ,চাল, যে কোন একটা সব্জি একটা টাকা দেবেন। অগ্নি দেবতাকে পুজো করে তবে উনুন জ্বালবো।
চন্দ্রা দেবী শশধরের নিষ্ঠাতে খুব খুশি।
রোজ রোজ ভালো ভালো খাবার খেয়ে জমিদার বাড়ির সকলেই খুব খুশি। শশধরকে ওরা আর কেউ হাতছাড়া করবে না।
ভালোই চলছিল হঠাৎ একদিন চন্দ্রা দেবী রান্না ঘরে ঢুকে দেখেন শশধর একটা ছোট্ট টিফিন কৌটোতে খাবার ভরছে। চিৎকার করে উঠলেন চন্দ্রা দেবী, – শেষে কিনা তুইও খাবার চুরি করলি।
– না গিন্নি মা আমি খাবার চুরি করিনি।
– তবে টিফিন কৌটোতে খাবার ভরলি কেন?
গিন্নি মা আমি প্রথম যেদিন এই রান্না ঘরে ঢুকলাম, সেইদিন জানলার পাশে একটা বাচ্চা মেয়ে উঁকি মারছিল। জিজ্ঞাসা করলাম কি চাই এখানে, যাও।
মেয়েটি বলল, – এই কৌটোতে আমাকে কিছু খাবার দাও। চারদিন কিছু খাইনি।
– গিন্নি মার কাছে যা। আমি রাঁধুনি। আমার দেওয়ার নিয়ম নেই।
– তাহলে আগের মা কেন দিতো আমাকে খাবার। ওই মাও তো রাঁধুনি ছিল। ওই মা বলেছিল আমাকে, খিদে পেলে এখানে আসতে। কিন্তু ঐ মা কোথায় চলে গেল।আমি যে চার দিন ধরে কিছু খাইনি..
– তখন বুঝতে পারলাম গিন্নি মা, মালতী চোর ছিল না। এই মেয়েটিকে মালতী রোজ খাবার দিত লুকিয়ে লুকিয়ে। আপনি সেদিন দেখে ফেলেছিলেন।
আজ আমারটা যেমন দেখে ফেললেন।
চন্দ্রাদেবী বললেন কোথায় গেল মেয়েটি?
শশধর যেই ডাকল,- ঝিমলি আয়। ওমনি ঝিমলি জানলার সামনে এসে গেল।
– কিরে কোথায় থাকিস তুই?
– সেন বাড়ির বারান্দাতে রাতের বেলায় থাকি। দিনের বেলায় পুকুরের ধারে থাকি।
– তোর মা বাবা কেউ নেই?
– মা তো ছিল। সেদিন খুব খিদে পেয়েছিল আমার। আমি মাকে বললাম মা ভাত দাও না একটু। আর থাকতে পারছি না।
মা বলল,- আমার পিণ্ডি খা তবে, তারপর থেকে কোন দিন আমি মার কাছ থেকে খাবার চাইনি। তারপর মা তো মরেই গেল।
চন্দ্রাবতী দেবী এখন অনুশোচনা করছেন শুধু শুধু মালতীকে চোর বদনাম দিয়ে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলাম।
এখন শশধরকেও ছাড়ানো যাবে না।
দিগম্বর বাবু সব কথা শুনে ঠিক করলেন ঝিমলিকে এই বাড়িতেই রাখবেন তিনি।
শশধর খুব খুশি। কাজ সেরে রাতের বেলায় বাড়ি গিয়ে মালতীকে সব কথা বলল
মালতী বলল, আমি যেটা বলতে পারিনি গিন্নি মাকে। তুমি বলতে পেরেছ সেটা।ঝিমলি খেয়ে পড়ে সুখে থাক ওখানে।
শশধর বলল, গিন্নি মা তো জানত না যে তুমি আমার সহধর্মিণী। তাহলে হয়তো এই কাজটাও আমার কপালে জুটত না।
শশধর রোজ ভালো ভালো রান্না করে রসনা তৃপ্তি করছে দিগম্বর বাবুর বাড়ির লোকজনদের।
আর যাদের পেট খিদের জ্বালায় জ্বলছে তারা হয়তো এ বাড়ি ও বাড়ি ভিক্ষা করতে গিয়ে বলছে, একটু খাবার দেন, পেট বড় বালাই বাবু, পেট বড় বালাই।