Site icon আলাপী মন

গল্প -প্রতীক্ষার ইচ্ছা

প্রতীক্ষার ইচ্ছা
-সঞ্চিতা (ঝুমা ) রায়

 

চার বছরের জন্মদিনে মেয়ে ইচ্ছার মুখে পায়েস তুলে দিচ্ছিলেন মা। “মা ওমা” মেয়ে ইচ্ছার মুখে এই প্রথম কথা ফুটলো। “মা” এই ডাকটা শোনার জন্য যে দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল প্রতীক্ষার। আনন্দে চোখ জল ভরে উঠলো তার। ইচ্ছা প্রতীক্ষার একমাত্র সন্তান। চারবছর আগে ইচ্ছা যখন পৃথিবীতে আসে তখন খুব খুশী ছিল পরিবারের সকলে। রবি ঠাকুরের কবিতার একটি পঙতি ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’ খুব প্রিয় ছিল প্রতীক্ষার। তাই মেয়ের নাম সে রেখেছিল ইচ্ছা। তাঁর যেন মনে হ’ত তার এই ছোট্ট সোনা একদিন তার সব ইচ্ছা পূর্ণ করবে।
শিশুটি ধীরে ধীরে যখন বড় হচ্ছে প্রতীক্ষা ও তার পরিবার বুঝতে পারে ইচ্ছা আর পাঁচটা শিশুর মত নয়, একটু অন্যরকম। শিশু বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলে জানা যায়, বুদ্ধি বা মেধার দিক থেকে ও তিন বছর পিছিয়ে আছে। ওর কথা বলা, ওর পড়াশোনা ওর স্বাভাবিক ব্যবহার সব কিছুই অন্য শিশুদের থেকে পিছিয়ে থাকবে। শুনে মনটা খারাপ হয়েছিল ইচ্ছার বাবা মায়ের। ডাক্তার আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, “সুদীর্ঘ জীবনে কয়েকটা বছর পিছিয়ে আছে বলে ও জীবনে কিছু করতে পারবে না, এমন কিন্তু নয়। একটা বয়সের পর কিন্তু এই বুদ্ধিবৃত্তির তফাৎটা আর থাকবে না। তখন ও সব অসুবিধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু মা বাবার পূর্ণ সহায়তা এই জন্য প্রয়োজন।

শুরু হয় প্রতীক্ষার পরীক্ষা। ইচ্ছার বাবাকে চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেকক্ষণ বাইরে থাকতে হ’ত। তাই মূল দায়িত্ব এসে পড়ে প্রতীক্ষার হাতে। সবটুকু ভালবাসা দিয়ে সে বড় করতে থাকে ইচ্ছাকে। ধৈর্যশীলা হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে পাশে থাকে ইচ্ছার। আজ ইচ্ছার চার বছরের জন্মদিনে প্রথম বড় জয় প্রতীক্ষার। “মা” ডাক শুনে ইচ্ছাকে জড়িয়ে আনন্দে কেঁদে ওঠে প্রতীক্ষা। ধীরে ধীরে টুকটুক করে আরো কিছু কথা শিখল সে। “এবার ওকে স্কুলে দেব।” “না না তার দরকার নেই বাড়িতেই পড়ুক।” ইচ্ছার ঠাকুরদাদা বলেন।

“কিন্তু কেন?”

“বুঝতে পার না আমাদের একটা সামাজিক সম্মান আছে, এই রকম মেয়ে আমাদের বংশে সবাই জেনে যাবে যে।” কঠিন গলায় বলেন ইচ্ছার ঠাকুমা।

“কিন্তু আমি তো ওকে স্কুলে পাঠাবোই।”

“তোমরা বরং ওকে কোনো হোস্টেল, হোম বা আশ্রমে দিয়ে দাও, এমনিতেই বাড়িতে অনেক সম্মানীয় লোকজন আসেন, তাদের সামনে আমি নাতনীকে আনতে পারি না, আমাদের সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়।”

“ পারবো না,শরীরের কোনো অঙ্গ বাদ দেওয়া যেমন মানুষের পক্ষে কষ্টকর তেমনই ওকে ছেড়ে আমরা বাঁচতে পারবো না।” একই সুরে কথা বলে প্রতীক্ষা ও তার জীবন সাথী,ইচ্ছার বাবা মা।

“তবে তোমরা এবাড়ি ছেড়ে চলে যাও, আমাদের সমাজে একটা পরিচয় আছে, একজন অপরিণত শিশু, একজন অর্ধেক মানুষের জন্য আমরা সামাজিক সম্মান হারাতে চাই না।” অন্য বাড়ি খুঁজে নিতে হ’ল তাদের। বেসরকারী সংস্থার কর্মী নিশীথ (ইচ্ছার বাবা) ছোট্ট একটা বাড়ি তারা ভাড়া নিল। কিন্তু এই বাড়িতে খুব সুন্দর একটা বাগান ছিল। মা মেয়ের কাছে সেই বাগানটা ছিল ভগবানের আশীর্বাদের মত। একটা গুণ অবশ্য এর মধ্যে ইচ্ছার মধ্যে প্রকাশ পায়, সে একটু একটু করে বাঁশী বাজাতে শিখে যায় তার মা প্রতীক্ষার কাছ থেকে। বিকাল বেলা বাগানে বসে সে বাঁশী বাজাতো। গাছগুলো যখন হাওয়ায় দুলতো ইচ্ছার মনে হ’ত গাছেরা তার গান শুনে যেন আনন্দ প্রকাশ করছে। পাখিরা নীড়ে ফেরার আগে বাগানে কিচির মিচির করতো। ভোরবেলা বাগানে গিয়ে ইচ্ছা পাখিদের দানা খেতে দিত। রোজ রোজ পাখিরা আসতো। আসতো চারটে কুকুরছানা, দুটো বিড়াল ছানা। সবাই ইচ্ছার কাছের বন্ধু ছিল। ভোরের সূর্যর লাল আলো দেখে সে খুব আনন্দ পেত। ভালবাসতো বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে। প্রকৃতি তার খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেত না প্রতীক্ষা কারণ সেখানে নানা ভাবে হেনস্থা করা হ’ত ইচ্ছাকে। স্কুলেও নানা রকম ভাবে জালাতন করা হ’ত ইচ্ছাকে। এরই মধ্যে কিছু শিক্ষিকা খুব ভাল ছিলেন, যারা যথেষ্ট স্নেহ দিয়ে শিশুটিকে বিকশিত হতে সাহায্য করতেন। “মা ওরা আমায় পেনসিল দিয়ে খোঁচা মারে, টিফিন খাওয়ার সময় ধাক্কা মারে,কেন মা?” চোখ ভরে জল আসে প্রতীক্ষার মানুষ কেন এত নিষ্ঠুর হয়। একই ক্লাশে একবার রেখে দেওয়া হ’ল ইচ্ছাকে। পরে আরেক বার একই কাজ করা হ’ল। আস্তে আস্তে ইচ্ছা কলেজে পৌঁছালো। উচ্চ মাধ্যমিকের সময় থেকেই ইচ্ছার মধ্যে পরিণত ভাব আসতে শুরু করেছিল। ডাক্তার ঠিকই বলেছিলেন, একটা সময়ে এই অসুবিধা অতিক্রান্ত হবে। উচ্চমাধ্যমিকে ভাল রেজাল্টই করলো। মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছে সে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড নম্বর পেল। অন্যদিকে দিকে দিকে তার বাঁশি বাজানোর সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। একদিন সে মায়ের একটা ডায়েরী খুঁজে পেল, মাকে জিজ্ঞাসা করলো “মা তোমার ব্যক্তিগত ডায়েরী আমি কি পড়তে পারি?” মা তাকে অনুমতি দিলেন। ডায়েরী থেকে সে তার মায়ের সমাজের বিরূদ্ধে পরিবারের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে বড় করে তোলার কথা সে আরো বেশী করে জানতে পারলো, অনেকটা তো সে জানতোই। “তোমার ঠাকুরদাদা আর ঠাকুমা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন,প্রণাম করো।” ইচ্ছার মনে হচ্ছিল বলে যে যাদের আমি শ্রদ্ধা করি না,তাঁদের পা ছোঁবো না। কিন্তু মায়ের কথা সে অমান্য করে না, তাই প্রণাম করলো।

“দিদিভাই আমার এত বড় বাড়ি বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, ফিরে চলো সব্বাই, তোমাকে আমি বিদেশে পড়তে পাঠাবো, তোমার বাঁশি চর্চার ও যথাযথ ব্যবস্থা করবো, আর তোমার সাফল্যে সবাইকে নিয়ে পার্টি দেব, ফিরে চলো।”

কিন্তু আমি এবাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না, বাবা এখন বাড়িটা কিনে নিয়েছেন। এবাড়ির ফুল পাখি পশু গাছপালা এরাই আমার প্রকৃত বন্ধু। আর এরা মানুষের চেয়ে অনেক আপন।” আরো বললো “আমি এই বাড়ির একটা ঘরে পিছিয়ে থাকা শিশুদের নিয়ে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছি। বিদেশ তো কোন দূর এই বাড়ি, এই শহর, এই বাগান কাউকে ছেড়ে আমি যাব না এরাই আমার আপন জন।”

“তোকে সম্বর্ধনা দিতে চায় আমাদের ক্লাব, কত সম্মান পাবি,আর_____”

“না দাদু একদিন সামাজিক অসম্মানের ভয়ে যাকে গ্রহণ করোনি, আজ তার সম্মান নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। ওই দেখ আমার ছোট্ট বন্ধুরা এসে গেছে।”

“ও পিয়ান ফু নাও”,ও পী বাছি বাও” ও মিছ্ কো উথবো”। কচি কচি গলায় ঘর ভরে উঠলো। এরা সবাই দেরী করে কথা শিখেছে, এখনো কথা স্পষ্ট হয়নি। এম.এ. পড়তে পড়তেই এদের নিয়ে আলাদা জগৎ গড়ে উঠৈছে ইচ্ছার। প্রতীক্ষার প্রতীক্ষা আজ সব দিক থেকে সার্থক।

Exit mobile version