রমিতা
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
রমিতা ক্লাস নাইনে ওঠার পর থেকে পুলকার বন্ধ করে রোজ বাসে করে একা-একাই স্কুলে যাতায়াত শুরু করেছে।রমিতার মা একটু ভয়ে ভয়ে থাকে কারণ দিনকাল খুব একটা ভালো নয়। প্রায় সাত আট মাস হয়ে গেল রমি একা একা স্কুলে যাচ্ছে। একদিন হঠাৎ ফোন আসে স্কুল থেকে।
-আপনি কী রমিতার মা?
-হ্যা, বলুন।
-আমি রমিতার ক্লাস টিচার বলছি। আপনার মেয়ে প্রত্যেক সপ্তাহের দুই তিন দিনের বেশি ক্লাস এ্যটেন্ড করছে না। ও কী অসুস্থ? শরীর খারাপ থাকে বলছে।ও যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট এবং আগের ক্লাসে ওর এ্যটেন্ডডেন্স যথেষ্ট ভালো। তাই টিচার হিসেবে আমি ও চিন্তিত। ঠিক আছে ফোন রাখছি।
রমিতার মা মোবাইলটা হাতে ধরে চুপ করে সোফার ওপর বসে পড়ে। তাহলে আজ ও কী রমি স্কুলে যায়নি! অদ্ভুত শঙ্কায় মন ছটপট করতে লাগলো। উঠতি বয়সের মেয়ে কোনো বাজে সঙ্গে পরল না কি। এই সব নানা চিন্তা করতে করতে রমিতার মা অপেক্ষা করতে লাগলো। যথারীতি দুপুর দুটো নাগাদ রমি বাড়ি ফিরে আসে।
বাড়িতে ঢুকেই মায়ের মুখ দেখে রমিতা বুঝতে পারে কিছু একটা ঘটেছে। কিন্তু রমিতা আশা ও করতে পারে নি ক্লাস টিচার ফোন করে তার মাকে তার ক্লাস কামাই করার কথা জানিয়েছেন। রমিতার মা তার হাতে শরবতের গ্লাস তুলে দিতে দিতে বললেন ‘তুই আজ কোথায় গিয়েছিলি? ‘ রমি মায়ের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দেয়-‘কেন, স্কুলে।’ রমিতার মা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রমিতার জন্য লাঞ্চ রেডি করতে লাগলো। ফ্রেশ হয়ে রমিতা খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে টিউশনে চলে যায়। রমিতার মা ভিতরে ভিতরে অস্থির হলেও নিজেকে সংযত রাখে পরের দিনের জন্য।
যথারীতি পরেরদিন সকাল সাতটা নাগাদ স্কুলের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে রমিতা। রমিতার মাও চুপচাপ রমিতাকে অনুসরণ করে নিরাপদ দুরত্ব থেকে। রমিতা বাস স্টপ থেকে বাস ধরে স্কুলের অভিমুখে রওনা দেয়। কিন্তু স্কুলে না নেমে তারই একটু আগে নেমে পড়ে। রমিতার মাও অটোয় করে সেখানে উপস্থিত হয়। রমিতা রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকান থেকে চার পাঁচটা কোয়াটার পাউরুটি কিনে তারই পাশের গলি ধরে হাঁটতে থাকে। রমিতার মাও অজানা শঙ্কা ও উৎকন্ঠা নিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখে রমিকে অনুসরণ করতে থাকে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর রমিতা একটা ঝুপড়ি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভিতর থেকে দু’টো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বেড়িয়ে আসে।রমিতা তাদের সাথে ভিতরে চলে যায়। জায়গাটা এত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর রমিতার মায়ের সারা শরীর ঘিন ঘিন করে উঠলো।
তবুও এগিয়ে যায় রমিতার মা। ঝুপড়ি ঘরের সামনে এসে রমিতার মা স্তব্ধ, হতবাক। একি তার ছোট্ট রমি! ঝুপড়ির নোংরা চৌকিটার ওপর চার পাঁচটা ছয় সাত বছরের বাচ্চাদের নিয়ে বসে আছে। তাদের সকলের হাতে একটি করে খাতা। খাতাগুলো খুব চেনা মনে হলো। এগুলো তো রমির পুরানো খাতা যার বেশ কিছু পাতা বেঁচে গিয়েছিল। সেই খাতাগুলো বিক্রি করতে না দিয়ে এই গরিব বাচ্চাগুলোর জন্য নিয়ে এসেছে। নিয়ে এসেছে তার পুরনো প্রাইমারির বইগুলোও। আর ও একটা জিনিষ দেখে রমিতার মা অবাক হয়ে যায় যে বাচ্চা গুলোর গায়ে ছোট্ট রমির পুরানো ড্রেস গুলো। রমির সাথে ছোট ছেলে মেয়েগুলো সুন্দর করে রাইমস পড়ছে।রমি কখনও আদর করে তাদের জড়িয়ে ধরছে। রমিতার মা বাক্ শূন্য। তার ছোট্ট মেয়ের মধ্যে এত দয়া মায়া, সহমর্মীতা। সে নিজের কেরিয়ার ফিউচার এইসব নিয়ে না ভেবে গরীব মানুষগুলোর পাশে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়িয়েছে।
কোন কথা না বলে রমিতার মা চুপচাপ বাড়ি ফিরে আসে। যথারীতি সঠিক সময়ে রমিতা স্কুল থেকে এলে তার মা তাকে প্রশ্ন করে ‘তুমি কি বস্তির ছেলে মেয়েদের জন্য সত্যি কিছু করত চাও?’ রমিতা ক্ষণিকের জন্য অবাক হয়ে ওঠে। সে মাকে জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কি করে জানলে’? রমিতার মা তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। রমিতা মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘মা ওরা খুব গরিব।’ রমিতার গায়ে স্নেহের হাতখানি বোলাতে বোলাতে তার মা বলে ‘কাল থেকে তুমি স্কুলে যাবে আর আমি গিয়ে ওদের পড়াবো,রুটি ও নিয়ে যাবো। তুমি লেখাপড়া করে যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে দেখবে সেদিন তুমি এই গরিব মানুষগুলোর জন্য আরও বড় বড় পদক্ষেপ নিতে পারছো। রমি আমি তোমার জন্য খুবই গর্বিত। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।’
সমাপ্ত