ঘৃণার আগুন
– রীণা চ্যাটার্জী
খ্রিস্টমাস ডে’ র দিন সন্ধ্যায় ভাশুরের মেয়ের অন্নপ্রাশনের সবকিছু মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই ফোনটা বেজে উঠলো। পল্লবী দেখলো দিদি ফোন করেছে। ফোনটা ধরতেই পরিধি কান্না ভেজা গলায় বললো, ‘বৌদি আর নেই রে, চলে গেল… আমাদের ছেড়ে’
অপ্রত্যাশিত খবর নয়, তবে আকাঙ্খিতও নয়, পল্লবী মুহুর্ত চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কখন? বাপ্পা (বৌদির ছেলে) জানে কি?’
-‘আধঘন্টার মতো হয়েছে, বাপ্পাকে আনতে গেছে দূর্গাপুরে ওর কলেজ থেকে।’ পরিধি বললো।
ঘটনার সূত্রপাত আটদিন আগে। দিন আটেক আগে বেলা বারোটা নাগাদ দিদিই জানিয়েছিল ফোনে পল্লবীকে, বৌদি পূজো করার সময় প্রদীপের আগুনে পুড়ে গেছে। প্রদীপের আগুনে আর কত পুড়তে পারে! তাই খুব বেশী ভয় না পেয়ে পল্লবী বলেছিল দিদিকে, চিন্তা করিস না, প্রদীপের আগুনে কতোটা আর পুড়বে, ঠিক হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু ফোনে সোমেনদাকে (বৌদির স্বামী) পাওয়া যাচ্ছে না, বাপ্পাও বাড়িতে নেই, কি করি বল তো?’ ভীত গলায় পরিধি বলে, এমনিতেই পরিধি খুব শান্ত স্বভাবের। তাছাড়া ওর ছেলে তখন সবে বছর খানেক বয়স।
‘ঠিক আছে, আমি দেখছি ফোনে কাকে পাওয়া যায়’ পল্লবী বলে। সাথে সাথেই পল্লবী নিজের স্বামী, জামাইবাবু দু’জনকে ফোন করে। দু’জনেই সাথে সাথেই বৌদির বাড়িতে পৌঁছে বৌদিকে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পল্লবী-পরিধির মা-ও ওদের সাথে যান।
বৌদি আসলে পল্লবীর বাবার বাড়ির পাড়াতুতো বৌদি। কিন্তু সেই পরিচিতিতে সীমিত নেই ওদের সম্পর্ক। নিজের স্নেহ, ভালোবাসা সব দিয়ে বৌদি যেন কবেই বড়ো আপন হয়ে গেছে, বড়ো দিদির মতো। ওদের মা’ও দেবলীনাকে (বৌদি) ভীষণ ভালোবাসে, ভরসা করে। কেমন যেন আত্মিক সম্পর্ক আছে ওদের সবার মধ্যে। শ্বশুরবাড়িতে শাশুড়ি, দেওর, মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট দেবলীনা এদের দুই বোন, বাবা-মা’য়ের মাঝেই খুঁজে নিয়েছে নিজের আপন জন। দেবলীনার এক ছেলে বাপ্পা সদ্য পড়াশোনা করতে দুর্গাপুরে গেছে।
ক’দিন ধরেই দেবলীনা খুব চুপচাপ হয়ে গেছে আজকাল। ছেলে দুর্গাপুরে যাবার পর থেকেই। কি যেন চিন্তা করে সবসময়। স্বর্ণ ব্যবসায়ী পিতার, মাতৃহারা মেয়েকে বহু পণের বিনিময়ে বিয়ে দিয়ে এনেছিল ওর লোভী শাশুড়ি। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু করে মারধর, খেতে না দেওয়া, আরো নানান অত্যাচার। যদিও ছেলে হবার পর দেবলীনা খানিকটা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, শাশুড়ি ও দেওরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তবে মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার কমে না। এখন ছেলে বাড়িতে না থাকায় হয়তো আরো বেড়েছে.. তাই কি নতুন কিছু চিন্তা করে দেবলীনা! সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আর পাওয়া যাবে না। প্রশ্নের সাথেই চিরতরে হারিয়ে গেছে দেবলীনা।
স্বামী বাড়ি এলেই পরিধি সারাদিনের দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছে বৌদি? কিভাবে পুড়েছে? ডক্টর কি বলেছে? কিছু বলেছে বৌদি, কি করে পুড়ে গেল?’
‘মুখে তো কিছু হয়নি দেখলাম, বাকি কি করে বলি বলো? শাল জড়িয়ে রেখে ছিল, তারপর তো হসপিটালে ভেতরে নিয়ে গেল। তবে বৌদি কথা তো বলছিলো, বেশী কষ্ট হলে কি আর কথা বলতে পারতো! তাছাড়া বার্ণ কেস, পুলিশের ঝামেলা আছে তুমি একবার দেখো এসো কাল।’ পরিধির স্বামী বলে।
দু’দিন পর পারিবারিক অনুষ্ঠান, আত্মীয়রা আসবে বাইরে থেকে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও পল্লবী বেরিয়ে পড়ে হসপিটালে যাওয়ার জন্য। হসপিটালে পৌঁছে বেড নম্বর খোঁজ করে, সামনাসামনি পৌঁছে দেখে বৌদি বসে আছে, চুপ করে। বার্ণ ইউনিটে সবার চীৎকারের মাঝে যেন এক খন্ড নীরবতা। তখনো বৌদিকে দেখতে কেউ আসে নি। পল্লবীকে দেখে হেসে বলে,
‘তুমি এতো কাজের মধ্যে এখানে এলে আবার!’
পল্লবী বৌদির মুখ দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়, একটুও পোড়ে নি, একদম স্বাভাবিক। তাও চাপা জায়গাটা দেখতে একটু উদগ্ৰীব থাকে, শুনেছে অনেক সময় পেট বা পেটের নিচে না পুড়লে ভয় কম থাকে। তাই নার্সকে ডেকে জানতে চায়,
‘দেখতে পারি একটু কি? যদি কোনো অসুবিধা না থাকে..’
নার্স ইশারা করে ফিসফিস করে বলেন, ‘অদ্ভুত সহ্য শক্তি! মুখে একটা আওয়াজ নেই! কি করে যে চুপ করে আছেন? দেখি নি কখনো এমন!’ নার্স যা দেখালেন দেখে চমকে উঠলো পল্লবী। পুরো শরীর কালো হয়ে আছে ফোস্কায়, কোথাও কোথাও দগদগে, শুধু মুখটা বাদ দিয়ে। জিজ্ঞেস করলো,
‘কি করে হলো বৌদি?
‘হলো, হয়ে গেল..’ খুব নির্লিপ্ত উত্তর।
‘খুব জ্বালা করছে গো? খুব কষ্ট…’
‘না গো, আমার মনের জ্বালা থেকে এই জ্বালা কম, সব তো জানোই।’
উল্টো দিকে দেখলো সোমেনদা আসছে, বললো-
‘সোমেনদা আসছে।’ একরাশ ঘৃণা চোখে নিয়ে চোখটা দেওয়ালের দিকে সরিয়ে নিল। আর কোনো কথা বললো না। একে একে অনেকেই এলো, জিজ্ঞেস করলো, কারোর কথায় উত্তর দিলো না। শুকনো চোখ দিয়ে শুধু অবহেলা, আর ঘৃণা ঠিকড়ে বেরোচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলো পল্লবী,
‘বাপ্পা জানে বৌদি?’ আবার খুব হালকা উত্তর,
‘জানি না তো..’ গলার স্বরের উদাসীনতা বুঝিয়ে দিল ঘৃণা মায়ার বাঁধনকেও আজ হারিয়ে দিয়েছে। খানিকটা সময় থেকে ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে এলে পল্লবী বললো,’আসি’, ঘাড় নেড়ে বললো, ‘এসো’ চলে এলো আস্তে আস্তে পল্লবী ভারাক্রান্ত মনে। মন বলছিল প্রিয়জন হারানোর সময় হয়তো আসন্ন!
সংসারের চাপে, সামাজিক দায়বদ্ধতায় আর যেতে পারে নি। ভেবেছিল এদিকের কাজ মিটে গেলেই যাবে। নাহ্, সেইসময় আর পায়নি। তার আগেই খবর এলো সব শেষ। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। জীবনে কতোটা ঘৃণা জমিয়ে রাখলে এইভাবে মুখ বুজে সহ্য করা যায়! ঘৃণার আগুনে কি সব অনুভূতি আগেই পুড়িয়ে দিয়েছিল মানুষটা! মনে পড়ছিল শুধু স্নেহময়ী বৌদির ঘৃণা মাখানো খরখরে চোখ দু’টো।