গল্প- ভাগ্যের পরিহাস

ভাগ্যের পরিহাস
– রাখী চক্রবর্তী

 

“কৃষ্ণ কুঞ্জ”
অনেক সাধ করে বাড়ির নামকরণ করেছিল আমার ঠাকুরদা।

“কৃষ্ণ কুঞ্জ” নাম কেন দিল ঠাকুরদা? অমর কুঞ্জও তো দিতে পারত। কেন ছোট কাকুর নাম দিল না? আমার শিশুসুলভ প্রশ্ন শুনে জেঠু দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে আমাকে বলত কৃষ্ণ যে ভগবান।

তবে আজ ভগবানের এত অনাদর কেন? কাকের বিষ্ঠাতে ভরে গেছে আমাদের বাড়ির নেম প্লেটে লেখা নামটা।
দু’বেলা কেন খাবার জোটে না ভগবানের?

ঠামমি তো মরার সময় বাবার হাতে রাখা গোপালকে দেখিয়ে বলেছিল, কৃষ্ণর যেন অবহেলা না হয় দেখিস। তা কি শুধু পেতলের গোপালের ওপরই প্রযোজ্য। রক্ত মাংসে গড়া কৃষ্ণর জন্য না।

আমার বাবারা চার ভাই। ললিত,অমিত,কৃষ্ণ, অমর।
আমার বাবার নাম অমিত চৌধুরি। যৌথ পরিবার আমাদের। এত মিলমিশ বোধহয় আর কোন যৌথ পরিবারে নেই।
কিন্তু আমার জেঠুর ছেলের সঙ্গে আমার তেমন জমে না। জেঠিমা আবার সেজ কাকুর নামেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে তাই বোধহয় ঠাকুর ঘরে জেঠিমা কখনও যায় না।ঠাকুর ঘরে গোপাল আছে যে, ঠামমির গোপাল।

ঠামমি মারা যাবার পর থেকে ঠামমির ঘরে সব সময় তালা লাগানো থাকত। ইচ্ছে হলেও ঠামমির ঘরে যাবার উপায় নেই। সেদিন সকাল বেলায় মা, জেঠু মানে বাড়ির সবাই বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে গেল। ফিরতে ওদের রাত হবে। সামনেই আমার বিএ. পরীক্ষার টেস্ট, তাই আমি যাইনি।

দুপুর বেলায় খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে ছাদের বারান্দায় ঘুরছিলাম হঠাত্ মনে হল যাই একবার ঠামমির ঘরটা খোলার চেষ্টা করি।
ঠামমির ঘরের পরের ঘরটাতে সেজ কাকু থাকে মানে কৃষ্ণ চৌধুরি।
জানলার পর্দা সরিয়ে আড়াল থেকে সেজ কাকুকে দেখলাম ।খাবারটা অর্ধেক খেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে।
যাইহোক অতি কষ্টে ঠামমির ঘরটা খুললাম। দরজা খুলতেই কয়েকটা বাদুড় চিঁ চিঁ করতে করতে বেরিয়ে গেল। দু’ একটা পায়রা ডানা ঝাপটা দিয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।
ঠামমি দাদুর ছবিতে ধুলো জমেছে। আমি ছবিটা ভালো করে পরিষ্কার করে দেওয়ালে টাঙিয়ে দিলাম। ঠামমির খাটের নিচে একটা ট্রাঙ্ক দেখলাম। খুব কষ্ট করে সেটাকে খুললাম।
আমাদের ছোট্ট বেলার জামাকাপড় আছে ঐ ট্রাঙ্কের ভেতরে। আমি ছোট বেলায় যেই জামাটা কাঁচি দিয়ে কেটে ছিলাম সেই জামাটাও ঠামমি যত্ন করে রেখে দিয়েছে।নিজেই হাসছি মনে মনে, কি দুষ্টুই না ছিলাম।
এগুলো আবার কি প্যাকেটে? সাদা সাদা, কি এগুলো। আর কেই বা রাখল। তবে কি..

ঠামমির আলমারিটা লক ছিল না। তাই অতি সহজেই খুললাম।
ঠামমির কয়েকটা শাড়ি ছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখলাম না। হ্যাঁ, তবে একটা ডায়েরি দেখলাম খুব যত্ন করে রাখা আছে।
ডায়েরিটা নিয়ে আমি ঠামমির ঘরে পুরনো একটা তালা দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম।
তখন বিকেল শেষ হতে চলেছে। আলো আঁধার লুকোচুরি খেলছে যেন পরস্পরের মধ্যে।

রাত্রি দশটার মধ্যে সবাই চলে এল। আমার জন্য খাবার এসেছে। জেঠিমা আমাকে খাওয়ার টেবিলে বসতে বলল।
আমি বললাম আজ সেজ কাকু আর আমি একসঙ্গে খাব।
– এত বড় সাহস তোমার!
– কেন সবাই বিয়ে বাড়ির খাবার খাবে শুধু সেজ কাকু খাবে না?

জেঠিমা ধমক দিয়ে বলল,আর সেজ কাকুর নাম নিতে হবে না। স্বার্থপর, বেইমান, লম্পট একটা লোক। খবরদার এই রকম কথা যেন আর তোমার মুখে না শুনি।

আমি রাগ করে ঘরে চলে এলাম। ঐ খাবার আর খেতে ইচ্ছে করল না।

সকাল হতেই বাবা, জেঠুর চিৎকার শুনতে পেলাম। ঠামমির ঘরের তালা নাকি কে যেন পাল্টে দিয়েছে।
মুচকি হেসে ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়লাম।
দুপুর বেলায় ঠামমির ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম।

“আমার কৃষ্ণ এ কাজ করতে পারে না।পুলিশে দিস না তোরা “

জয়া তো ভালো মেয়ে তবে ও কেন এই কাজ করল।
আমার মৃত্যু হয় না কেন ভগবান।

কিসের জন্য ঠামমি এই কথাগুলো ডায়েরিতে লিখল। জয়াই বা কে? ঠামমির ঘরে যেই ছবি টা তে মালা দেওয়া দেখলাম তবে সেই কি জয়া।

আজ মাকে সব জিজ্ঞাসা করব। মা নিশ্চয়ই সব জানে।
রাত্রি বেলায় মাকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম।সেজ কাকুকে কেন গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে?
সব জানতে চাই মা, তুমি বলো।

– কৃষ্ণ যখন এম. এ. পাস করেও কোন চাকরি পেল না। তখন তোর ঠামমি, দাদুর খুব চিন্তা হল। অনেককেই বলে রেখেছেন ওনারা কৃষ্ণর কাজের জন্য। অবশেষে
তোর জেঠুর সুপারিশে জাহাজে কাজ পেল কৃষ্ণ। তিন মাস অন্তর বাড়ি আসত কৃষ্ণ।তোর দাদু ঠামমি খুব খুশি হতো ও যখন বাড়ি আসত।

এইভাবে চলছিল। হঠাত্ একদিন বাড়িতে পুলিশ এল। কৃষ্ণ নাকি ড্রাগ পাচারের সাথে জড়িত। হাতে নাতে ধরা পড়েছে। এক ড্রাগ ব্যবসায়ীকে ড্রাগ শুদ্ধু ব্যাগ দিতে গিয়ে ধরা পড়েছে কৃষ্ণ।

তিন বছর জেলে ছিল। তারপর তোর বাবা আর জেঠু ওকে গৃহবন্দি করে রেখেছে।পাছে ঐ পেশায় আবার যায়।

– জয়া কে মা?
– জয়ার নাম কার মুখে শুনলি?
– তেমন কিছু না। সেজ কাকু একদিন জয়া বলে বিড়বিড় করছিল। তাই জানতে চাইলাম।

– জয়ার সাথে কৃষ্ণর বিয়ে ঠিক হয়েছিল।কিন্তু কৃষ্ণ জেলে যাওয়ার পর জয়া আত্মহত্যা করে।

আমার মনে হয় মা তুমি জানো সেজ কাকু নির্দোষ ।

– না না, আমি কিছু জানি না। আমার কাজ আছে আমি যাই।

– আমাকে যদি কেউ এই ভাবে ব্যবসার কাজে ব্যবহার করত। তখনও কি তুমি চুপ থাকতে মা।
আমি এখন বড় হয়েছি। তোমার কোনো ভয় নেই। বাবা, জেঠুর কুকর্ম আমি জেনে গেছি।
ঠামমির ঘরে অনেকগুলো সাদা প্যাকেট রাখা আছে। আমি কাল সব দেখেছি। তুমি সব বলো আমাকে।

– কৃষ্ণ যখন ছুটিতে বাড়ি আসত তখন তোর বাবা জেঠু একটা বড় ব্যাগ দিত জাহাজের ক্যাপ্টেনকে দেওয়ার জন্য। কৃষ্ণ কোনোদিন জানতে চায়নি ঐ ব্যাগে কি আছে। যেদিন পুলিশ হাতে নাতে ধরল তখন ও জানতে পারল ব্যাগে সাদা পুরিয়ার প্যাকেট ভর্তি। পুলিশকে ও বলল আমি কিছু জানিনা। আমার দাদারা সব জানে। সেদিন কেউ ওর কথা বিশ্বাস করেনি।

কিন্তু আমি জানতাম সব। ভয়ে কিছু বলিনি।তোর কথা ভেবে স্বার্থপরের মতো চুপ করে ছিলাম। তুই যে তখন খুব ছোট। যদি ওরা আমাকে বাড়ির থেকে বের করে দেয়। তোর থেকে যদি আলাদা করে দেয়। বড় হয়ে তুইও যদি, না না,তোকে আমি মানুষের মতো মানুষ করতে চাই।
কৃষ্ণ জেলে যাওয়ার এক মাসের মধ্যে তোর দাদু মারা গেল। ঠামমির শরীর আরো খারাপ হতে লাগল।
কৃষ্ণ জেল থেকে বাড়ি ফিরলে ওকে ঐ ঘরে নজর বন্দি করে রাখল তোর বাবা, জেঠু।আস্তে আস্তে কৃষ্ণ মুখ বুজে সব মেনে নিল।শুধু লাশ হয়ে বেঁচে আছে ও এখন। ভাগ্যের পরিহাস একেই বলে। দোষীরা হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর নির্দোষ গৃহবন্দি হয়ে পড়ে আছে।
– আমি বাবা, জেঠুর বিরুদ্ধে যাব। সেজ কাকুর জন্য লড়ব।
ঐ স্বার্থপর মানুষগুলোকে উচিত শিক্ষা দেব।তুমি আমার সাথে থেকো মা।
– আশীর্বাদ করি অনেক বড়ো মনের মানুষ হ তুই।

পরের দিন ভোরের অপেক্ষাতে ছিলাম। সময় মতো পুলিশকে খবর দিলাম। বাবা, জেঠুর মতো স্বার্থপর মানুষগুলোকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে মার চোখের জল মুছলাম আমি।কৃষ্ণ কুঞ্জ নামের ফলক আমার মা নতুন করে লাগালো।
সেজ কাকুকে আমি ঘর থেকে বাইরে আনলাম। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মা সেজ কাকুকে বরণ করে কৃষ্ণ কুঞ্জতে প্রতিষ্ঠা করল। ঠামমি দাদু ওপর থেকে দেখছে নিশ্চয়ই কৃষ্ণ কুঞ্জতে কৃষ্ণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

Loading

One thought on “গল্প- ভাগ্যের পরিহাস

  1. খুব সুন্দর। মন ভরে গেলো। ভালো থাকুন দিদি।

Leave A Comment