অধিকার বোধ
– সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)
আজ রবিবার প্রমিতার আজ অখণ্ড অবসর। অন্যদিন তার অফিসের তাড়া থাকে। মেয়েকে স্কুলের জন্য রেডি করার তাড়া থাকে। আজ বিছানায় অনেকক্ষণ গা এলিয়ে সে শুয়েছিল। সুশোভন আজ বাড়িতে নেই। অফিস ট্যুরে বাইরে। আজ সন্ধ্যায় ফিরবে। আলসেমি কাটিয়ে প্রমিতা আস্তে আস্তে নিজের এবং মেয়ের জন্য চা করলো। মা মেয়েতে গল্প করতে করতে চা খাওয়া শেষ হলো। তাদের মেয়ে সৃষ্টি নাচ অনুশীলন করতে দোতালার ঘরে গেল। প্রমিতা ঘর সাজাতে ব্যস্ত। সুশোভনের প্রিয় গোলাপী রঙের চাদর বিছানায় পাতছে। মিলিয়ে মিলিয়ে মাথা বালিশ আর কোলবালিশের ওয়ার। ফুলদানিতে সুশোর প্রিয় রজনীগন্ধা। প্রমিতা মাঝে মধ্যে সুশোভনকে আদর করে সুশো বলে ডাকে। মিষ্টি গন্ধে ভরপুর ঘর। সাতদিন পর, আজ সুশো ফিরবে। প্রমিতা মনে মনে সুশো ফেরার পর ওদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত গুলো কল্পনা করে নিচ্ছে। ওর মন খুশি খুশি। ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ প্রমিতার মোবাইলের রিংটোন। মোবাইলটা বাজছে। ভাবলো সুশো হবে। কিন্তু এতো অচেনা নম্বর।
“হ্যালো”,
“আমি প্রশান্ত বলছি,চিনতে পারছো আমার গলা’।
“এতদিন পর তুমি হঠাৎ ?”
“তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে,আমি জানি তুমি তোমার প্রথম প্রেমকে ভুলে যেতে পারো না, আমি একবার ডাকলেই তুমি আসবে”।
“বেশ তো কোথায় যেতে হবে বলো”। “নন্দনের কাছাকাছি, যেখানে আমরা রবীন্দ্র চর্চা করতাম,উদাত্ত গলায় গান করতাম, সেখানে কাল সন্ধ্যা ছয়টায় এসো। ”
“ও কে”। একই কলেজে পড়তো প্রমিতা ও প্রশান্ত। কলেজে একসঙ্গে গান গাইতে গাইতে, নাটক করতে করতে কখন যেন মন বিনিময় হয়ে যায়। ভালবেসে ফেলে দু’জনে দু’জনকে। ওদের প্রেম দেখে মনে হ’ত যেন একে অপরের পরিপূরক । আর নামের প্রথম অক্ষর দু’জনেরই প্র। দু’জনেই দু’জনের প্রথম প্রেম। বন্ধুরা জানতো এরা একে অপরকে একদিন ও না দেখে থাকতে পারে না। বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। দুই বাড়ির কারুরই আপত্তি ছিল না। দু’জনেই ঠিক করে যে ওরা দুজনেই চাকরি পেলে তবেই বিয়ে হবে। প্রশান্ত আই.টি. সেক্টারে বড় চাকরি পায়। প্রমিতা এস.এস.সি. দিয়ে স্কুলে চাকরি পায়। দু’জনের দেখা করার সময় কমে আসে। সপ্তাহে একবার কি দু’বার দেখা হয়। প্রমিতা লক্ষ্য করতে থাকে, প্রশান্ত যেন দেখা করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ আর দেখাচ্ছে না। কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে প্রমিতাকে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রমিতা জানতে পারে, প্রশান্তর অফিসে জুন নামক একটা মেয়ের সাথে প্রশান্তর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মনে জোর আঘাত লাগে প্রমিতার। এরপর প্রশান্ত একদিন প্রমিতাকে জানায়,তার লাইফপার্টনার হিসাবে জুন-ই উপযুক্ত । জুন স্মার্ট সুন্দরী দুর্দান্ত ইংরাজী বলে। প্রশান্ত কদিন পর আমেরিকা যাচ্ছে। জুনকে বিয়ে করে। জোর ধাক্কা খায় প্রমিতা। সবসময় বড় বিষণ্ণ দেখায় তাকে। গান করা আবৃত্তি করা সব ছেড়ে দেয় সে। স্কুলের পর লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ের সাথেই সে কাটিয়ে দিত অনেকটা সময়। এই লাইব্রেরিতেই তার আলাপ হয় সুশোভনের সাথে। খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দু’জনের মধ্যে। সুশোভন প্রমিতার চোখে বিষণ্ণতা দেখতে পায়। ক্রমে প্রমিতার প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরী হয় সুশোভনের। সে প্রমিতাকে জানায় তার দুর্বলতার কথা। প্রমিতা তাকে বলে যে এখনও তার মন জুড়ে প্রশান্তই আছে। ওদিকে প্রমিতার বাবা মা’ও চাইছিলেন, প্রমিতার জীবনে কেউ আসুক,যে ওর মনকে ভাল করে দিতে পারবে। ওনারা সুশোভনের কথা জানতে পারেন। প্রমিতাকে বোঝান। প্রমিতা সুশোভনকে বলে “কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝে যে প্রশান্ত সবসময় থেকে যাবে, আমি হয়তো কোনোদিনই তোমায় ভালবাসতে পারবো না, আর ভাল না বাসলে কাছেও আসতে পারবো না”। সুশোভন কিন্তু প্রমিতাকে ভালবেসে ফেলেছিল। সে বলে, “বেশ তো আমরা বন্ধুর মত পাশাপাশি থাকবো, কিন্তু বিয়ে না করে তো একসঙ্গে থাকা যাবে না, তাই সামাজিক বিয়ে আমাদের করতে হবে। ”বাবা মা একটু স্বস্তি পাবেন এই ভেবে প্রমিতাও রাজী হয়ে যায়।
শুরু হয় প্রমিতা ও সুশোভনের নতুন জীবন। না স্বামীর দাবী নিয়ে সুশোভন কখনও আসে না প্রমিতার কাছে। প্রমিতার সব প্রয়োজনে সুশোভন তার পাশে থাকে। বিনিময়ে সে কিছুই কখনই দাবী করে না প্রমিতার কাছে। সে প্রমিতাকে বলেছিল, দু’টো মন কাছাকাছি না এলে, কখনই দু’টো শরীর কাছাকাছি আসতে পারে না। তাই কখনই কোনোরকম দাবী সে করেনি। বলেছিল, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানে শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কই নয়, এক অনন্ত বন্ধুত্বও বটে। দিন কাটতে থাকে, প্রমিতার ক্রমে মনে হতে থাকে ওর দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ সুশোভন। শ্রদ্ধা তো ছিলই, কিন্তু শ্রদ্ধাটা কেমন যেন অন্য এক অনুভূতিতে বদলিয়ে যাচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারে না, এই অনুভূতিটাকেই কি ভালবাসা বলে? কিন্তু
একদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে এসে বই পড়ছিল সুশোভন। প্রমিতাও স্কুল থেকে এসে একটু ফ্রেশ হচ্ছিল, স্নানঘর থেকে গা ধুয়ে বেড়িয়ে এল, একটা হালকা রঙের নাইটি গায়ে দিয়েে। ভীষণ গরম তাই গায়ে শুধু নাইটি। আজ ওপর থেকে ওড়নাটাও নেওয়া নেই। বই থেকে মুখ তুলতেই সুশোভনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় প্রমিতার। বিনা সাজেও ভীষণ সুন্দর লাগছিল প্রমিতাকে। নাইটি ছাপিয়ে বেড়িয়ে আসছিল ভরা যৌবনের চিহ্ন। সংযত করে নিল সুশোভন নিজেকে। উঠে স্টাডি রুমে চলে গেল। বই পড়তে পড়তে একটু চোখটা লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ ঠোঁটে আলতো ছোঁয়া অনুভব করলো। চমকে দেখে প্রমিতার অধর তার ওষ্ঠকে ছুঁয়ে আছে। সচকিত হয়ে সরে যেতে চাইলো সে, এবার বাহুবন্ধনে নিল প্রমিতা সুশোভনকে।
“তুমিই বলেছিলে দু’টো মন কাছাকাছি না আসলে দু’টো শরীর কাছাকাছি আসতে পারেনা, কবে কেমন করে আমার মনটা তোমার হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি”। তোমার সংযত ভালবাসা, তোমার আত্মত্যাগ কখন যে আমার মনকে জয় করে ফেলেছে। দু’টো মন আজ কাছাকাছি আজ অবশ্যই এসে গেছে,তাই… ” আর কিছু বলতে পারে না প্রমিতা আবেগে গলা বুজে আসে। দু’চোখ বেয়ে বয়ে চলে অশ্রুধারা। কাছে টেনে নেয় সুশোভন প্রমিতাকে। তাদের ভালবাসার সাক্ষী স্বরূপ পৃথিবীতে আসে সৃষ্টি । ভালবাসা প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হতে থাকে। সোমবার সন্ধ্যা ছটা ওইতো প্রমিতা আসছে। দূর থেকে দেখতে পায় প্রশান্ত। তাহলে ঠিক যা ভেবেছিলাম, আমার প্রমিতা আমারই আছে। কিন্তু সঙ্গে কে?
“প্রশান্ত আলাপ করিয়ে দিই- সুশোভন, আমার জীবনসাথী আমার মনের মানুষ আমার প্রাণ।” যেন বিদ্যুতের শক খেল প্রশান্ত। প্রশান্ত বড় অদ্ভূতভাবে দেখছে প্রমিতাকে। সে যে ভেবেছিল..
“শোনো প্রশান্ত তুমি আমার কাছে ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতি মাত্র, আমার জীবনে আমার মনে তোমার কোনো স্থান নেই, আমার একমাত্র ভালবাসা এখন সুশোভন”। চলো সুশো এখানে আর দাঁড়াবার দরকার নেই- চলি”।
সুশোভন সব কথা শোনার পরেও কিন্তু একাই পাঠাতে চেয়েছিল প্রমিতাকে, বলেছিল, “তোমার যদি ওর সংস্পর্শ ভাল লাগে যাও দেখা করে কথা বলে এসো”। প্রমিতা রাজী হয়নি। সে তার সুশোকে সঙ্গে নিয়েই গেছে।
বাড়ি ফিরে প্রমিতা সুশোভনকে বললো “তোমার কাছে একটা জিনিষ চাইবো দেবে?”
“তোমাকে অদেয় তো আমার কিছু নেই,বলো কি চাও”।
“অধিকার বোধ, আমার প্রতি তোমার অধিকার বোধ থাকুক, এইটুকুই চাই,আমি চাইনা তুমি আমায় যখন তখন যার তার সাথে দেখা করতে দাও, একটু অধিকার বোধ, একটু পসেসিভনেস চাই আমার প্রতি তোমার। ”এই কথা সে তো মনে মনে কবে থেকেই আছে, কিন্তু তোমার স্বাধীনতায় আমি কখনও হস্তক্ষেপ করতে চাইনি, জানো তো একটা কথা আছে ভালবাসাকে মুক্ত আকাশে উড়তে দাও, সে যদি তোমার কাছে ফিরে আসে, তবেই জানবে তোমার ভালবাসার জয় হয়েছে, আর আমার ভালবাসা তো আমার কাছেই ধরা দিয়েছে। ভালবাসার নিবিড় বন্ধনে চিরতরে বাঁধা রইলো দু’টো মন।