জীবন যুদ্ধ
– পারমিতা চ্যাটার্জী
চলতে চলতে পা দু’টো বড় ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে,
মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে একদম ভিজে যাচ্ছি, ঝড়ে বাতাসে ছাতাটাও ওলোটপালোট খাচ্ছে। সামনে একটা বাঁশের সাঁকো আছে, ইদানীং বড় খুব পিচ্ছল হয়ে যচ্ছে, পার হতে গিয়ে পড়ে না যাই।
অন্ধকারে অনুভব করলাম কে যেন এসে আমার হাতটা ধরল, চমকে তাকালাম
দেখলাম অল্প বয়সী একটি ছেলে, হাত ধরে আমায় সাঁকোটা পার করে দিচ্ছে, বলল চলুন ভয় নেই, পড়বেন না।
রাস্তায় নেমে সে অন্যদিকে চলে গেল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, ভাবলাম বৃষ্টিটা একটু কমে এলে বাড়ীর পথ ধরব…তারমধ্যে যদি একটা অটো বা রিক্সা পাই নিয়ে নেব। রাস্তার আলোগুলো টিমটিম করে জ্বলছে,
ভালো করে দেখতে পাচ্ছিনা।
হঠাৎ একটা দামী গাড়ী এসে সামনে প্রায় গা ঘেসে দাঁড়াল, মুখ তুলে বকতে যাচ্ছিলাম,
কিন্তু গাড়ী থেকে যে নামল তাকে দেখব আশা করিনি, একজন সুসজ্জিত ভদ্রলোক, অনেক দিনের চেনা, এই বৃষ্টিতে একা কোথায়? উঠে এসো নামিয়ে দিচ্ছি।
মনে তখন কত প্রশ্নের ভীড় গাদাগাদি করছে, গাড়ীতে উঠব কি?
মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম-তুমি? গাড়ীর ভেতর একজন সুসজ্জিতা মহিলা। বলল- হ্যাঁ, আমি বছর দুই হল এসেছি।
ভেতরের মহিলাকে দেখিয়ে বলল আমার স্ত্রী সুধা। আর এ আমার এক পুরানো বন্ধু।
বৃষ্টির জলে এমনি চোখটা ঝাপসা হয়েছিল, এখন আবার কোথা থেকে রাশি রাশি চোখের জল আসতে লাগল। কোনরকমে টাল খেতে খেতে আমাদরর এঁদো গলিটা পার হয়ে যেন এক ঘোরের মধ্যে বাড়ী ফিরলাম।
ছেলেটা তখনও ফেরেনি, মা এসে বলল কিরে কাপড়টা ছাড়, বিছানায় এমন করে বসে পড়লি যে…
-মা বাবুন কোথায়?
বাবুন তো সোনাইকে নিয়ে বেড়াতে গেল, এসে যাবে এখন, তুই কাপড়টা ছেড়ে একটু চা খা আগে, বলি এই বৃষ্টির মধ্যে বার হসনা, আজকাল তো চোখের পাওয়ারটা এতে বেড়েছে। মুখ ঝামটেই জবাব দিলাম খেটে খেতে হয় মা। বাবুন এলে বল তো নেট দেখে আজ রাতেই শান্তিনিকেতন যাবার টিকিটটা যেন কেটে দেয়, ওখানকার চাকরিতে এ মাসেই জয়েন করতে বলেছিল। মা বললো, তোর সবেতেই জেদ, কাল সকালে গেলে কি হয়? এতো রাতে আমি একলা যেতে দেব না।
পরদিন সকালে চলে গেলাম শান্তিনিকেতন।
আঃ কি শান্তি!
আসার সময় মা ভাইদের খুব মন খারাপ হল, কিন্তু কি করা যাবে, একাই যখন বাঁচতে হবে তখন লড়াই আরম্ভ করে দেওয়াই ভালো।
পরদিন সকালে ঘরের কিছু জিনিস কিনতে যাব বলে তৈরী হচ্ছি, এমন সময়ে অজয়দা ঘরদোরের যাবতীয় জিনিস নিয়ে এসে, লোক দিয়ে নিজের হাতে সব সাজিয়ে দিয়ে গেল।
–তুমি?
কি করে খবর পেলে আমি এসেছি…
অজয়দা কোন উত্তর না দিয়ে কাজ সারতে লাগল।
–বলল, এখন যাচ্ছি। বাস্কেটের মধ্যে চা, দুধ চিনি, রুটি, মাখন, ডিম কলা আছে। এখনকার মতন হয়ে য়াবে, সঙ্গে একজন মাসীকেও এনেছে।
আবার বলল রান্নাঘরে চাল, ডাল তেল নুন সব আছে এখনকার মতন হয়ে যাবে।
আমার দু’ চোখ দিয়ে হু হু করে জল পড়তে লাগল। সেই কবে থেকে অজয়দা আমায় ভালোবাসত, সেই ভালোবাসা এখনও অম্লান। সেই একই পোষাক, চেক্ চেক্ লুঙ্গি, খালি গা বুক ভর্তি লোম, যা দেখে সেদিন দেমাক করে বলেছিলাম, কোথাকার একটা চাষা ভুসা, সাহস কত…আমায় ভালোবাসতে এসেছে..
ভগবান বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন…
আজ সেই চাষার দয়ায় জীবনটা হয়তো বাঁচবে…।