শুভদৃষ্টি
– রাখী চক্রবর্তী
পড়়ন্ত বিকেলে পশ্চিম আকাশে রোদের ঝলকানির লাল আভা ঝুল বারান্দায় বসে থাকা কৃত্তিকার মুখে এসে পড়েছে। কৃত্তিকা বরাবরই সৌন্দর্যের শিখরে থাকতে ভালবাসত। রূপের বাহার তো আর কম ছিল না। তাই রূপের অহংকার ওর বেশ ভালোই ছিল। আর থাকবে নাই বা কেন? মা বাবার সংসার ছিল দিন আনা দিন খাওয়া। ক্লাস নাইন অব্দি পড়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল কৃত্তিকা। রায় বাহাদুর সাহেব নিজে হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে কৃত্তিকাকে ঘরের বৌ করে নিয়ে এসেছিলেন। সবার ভাগ্যে এমন শ্বশুর বাড়ি জোটে না।
শুভদৃষ্টির সময় কৃত্তিকা প্রথম দেখল ওর স্বামী পলাশকে। রাগে ঘেন্নাতে পলাশের চোখে চোখ রেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল কৃত্তিকা সেদিন। কানাঘুষো শুনতে পাচ্ছিল ও, “কি মেয়ের কি বর।”
অভাবের সংসার বলে মা বাবা একবারও মেয়ের মতামত নেবে না। বাড়ির সবাই পাত্রকে দেখেছে। শুধু আমাকেই দেখাল না! নানা প্রশ্ন করছে বিয়ের পিঁড়িতে বসে সে নিজেকেই।
ইচ্ছা অনিচ্ছা যাইহোক বিয়ে সুসম্পূর্ণ হল। চারহাত এক হল।
অষ্টমঙ্গলাতে বাপের বাড়ি এসে মুখ ভার করে রেখেছিল কৃত্তিকা। ওর মা অনেক বোঝাল রূপ না থাকলেও জামাইয়ের অনেক গুণ। কত বড় ঘরের ছেলে সে। মানিয়ে নে মা। রূপ তো আজ আছে দু’দিন পর তো রূপের বাহার নাও থাকতে পারে।
বিয়ের দু’ বছরের মাথায় পলাশের বাবা রায় বাহাদুর সাহেব মারা গেলেন। ছেলের নিত্যদিনের অপমান, ঘরে অশান্তি এই সবের জন্যই মনমরা হয়ে থাকতেন রায় বাহাদুর। এর জের শরীরে তো পরবেই। তাই অকালে চলে গেলেন তিনি।
কৃত্তিকা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। শ্বশুর মশাই মারা যাওয়ার পর।
পলাশ চোরের মতো থাকতে শুরু করল নিজের বাড়িতে। কৃত্তিকা সকাল সন্ধ্যা রাত্রি সেজেই চলেছে, সেজেই চলেছে। কে দেখবে ওর রূপ? পলাশ তো ওর ধারে কাছে যেতে পারবে না।
এভাবেই হেলাছেদদা করে সংসার চালাচ্ছে কৃত্তিকা।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন কৃত্তিকা লক্ষ্য করল ওর সারা গায়ে কালো কালো দানার মতো কি যেন হয়েছে। যাক বাবা মুখে কিছু হয়নি। তাই ভয়ে ভয়ে ও ডাক্তারের কাছে গেল।
ডাক্তারের কাছে গিয়ে ও জানতে পারল বিরল রোগে আক্রান্ত সে। মুখও বাদ যাবে না। এখন বাঁচা মরা সব ভগবানের হাতে।
একরাশ ভাবনা চিন্তা নিয়ে বাড়ি এল কৃত্তিকা। দুর থেকে পলাশকে দেখল। কৃত্তিকার ঝুল বারান্দাটা আজ পলাশের দখলে। পলাশ দাড়িয়ে আছে ঝুল বারান্দায়। পলাশকে জড়িয়ে ধরে ওর খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে আজ। কৃত্তিকা ঝুল বারান্দার সামনে আসতেই পলাশ মাথা নিচু করে ঘরে চলে গেল।
রাত্রি বেলায় নব বধুর সাজে সেজে কৃত্তিকা পলাশের কাছে গেল। দু’ চোখ ভরে পলাশকে দেখছে। শুভদৃষ্টির সময় যা যা ভুল ত্রুটি করেছিল কৃত্তিকা এবার কিন্তু ও আর কোন ভুল করল না।
পলাশ বলল, কিছু বলবে?
– যদি বলি আমাকে ক্ষমা করতে। পারবে তো?
– তুমি তো কোন অন্যায় করো নি। পছন্দ অপছন্দ তো নিজস্ব ব্যাপার। পাপ তো কিছু করোনি।
কৃত্তিকা বুঝল কতটা অন্যায় সে করেছে।
আজ বাঁচতে ইচ্ছে করছে ওর। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করছে ওর। কিন্তু ডাক্তার আশঙ্কার কথা তো বলে দিয়েছে ওকে। তবুও যতদিন বাঁচি।
রাতে পলাশের কোলে মাথা রেখে কৃত্তিকা ঘুমোচ্ছে। পলাশ ওর মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে।
বাবা, বাবা, বাবা কোথায় গেলেন?
– বাবা এখানে কি করে আসবে?
– হ্যাঁ, বাবা এসেছিলেন আর বললেন,
“ঘর থেকে শ্মশান যাত্রা
একটু তো পথ পরিক্রমা”
আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলতে জ্বলতে অতি সাধের দেহটা সাদা ছাইয়ের ধ্বংস
স্তূপে পরিণত হবে। এই বলে বাবা কোথায় গেলেন?
– তুমি ঘুমাও এখন।
কৃত্তিকা পলাশের দু’হাত ধরে কেঁদে বলল,
সব অহংকারের জবাব পেয়ে গেলাম আমি। সব জবাব পেয়ে গেলাম।
সমাপ্ত