এক সাহসী পদক্ষেপের পরিণাম
– বিশ্বদীপ মুখার্জী
শান্তিপুর
নদীয়া।
12/08/2019
আমার মিতু,
আজকাল চিঠি লেখার চলন উঠেই গেছে। এটা তো হোয়াটসঅ্যাপ আর ম্যাসেঞ্জারের জমানা। তাও তোকে চিঠি না লিখে থাকতে পারলাম না। হ্যাঁ, তোকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করবো। জানি, তোর কোনও আপত্তি হবে না। আমাদের ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ তে আসা, আর ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’ তে আসা একটা ইতিহাস। জানিস, প্রায় মনে পড়ে সে দিনের কথা, যে দিন প্রথম বার তোর সাথে ফোনে কথা হয়েছিল। সেই থেকে শুরু। তার পর কী ভাবে যে কী হয়ে গেল, সেটা না তুই বুঝতে পারলি, না আমি। তুই লিখতে ভালোবাসতিস। নানা কারণে, সংসারের নানা ঝামেলার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল তোর লেখা। তোর লেখা কবিতা ডায়রীর পাতায় বন্দি হয়ে রয়ে গিয়েছিল। যে দিন প্রথম তুই নিজের কবিতা পড়াস আমাকে, সে দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিলাম যে তোর কবিতা কে ডায়রীর পাতা থেকে বের করে জনসমূহের সামনে নিয়ে আসবো। আজ আমি তোর থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমাদের এই দূরত্বটা তোর লেখার প্রতি আমার ভালোবাসা কে বিন্দু মাত্র কম করতে পারেনি। তোর সব লেখা, সব বই পড়ি আমি। তোকে তো বলেছিলাম, তোর লেখা কে আমি নিজের সন্তানের মত ভালোবাসি।
জীবনের এক বড় অধ্যায় জুড়ে শুধু তোরই নাম লেখা আছে মিতু। জানতাম তুই কোনও দিনই আমার হবি না। তাও তোর প্রতি যে ভালোলাগাটা আমার হৃদয়ে নিজের বাসা বেঁধেছিল সেটা প্রতিনিয়ত পূর্ণতা পাচ্ছিল। তুই যখন নিজের ইতিহাস আমায় বলতিস, কষ্ট হত আমার। ইচ্ছে হত তোর চোখের জল নিজের হাত দিয়ে মুছে দিই। অবশেষে এক দিন আমার হাত নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকলো না। অজান্তেই এগিয়ে গেল তোর গালের দিকে। মুছে দিলো তোর চোখের জল। সে দিন তোর চোখের জল কোনও বাধা মানেনি। আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলি তুই। তুই কাউকে কোনও দিন নিজের কাছে পাসনি। কেউ ছিল না যাকে তুই মনের দুটো কথা বলে শান্তি পেতিস। কেউ ছিল না যে তোকে বুঝতো। একটা নির্বিকার মানুষের সাথে জীবনযাপন করা যে কতটা দুষ্কর, সেটা তোকে দেখে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। আমি কারোর বিষয় খারাপ মন্তব্য করতে চাই না মিতু। শুধু একটি প্রশ্ন মনে বারবার জাগে। তোর কষ্ট, তোর চোখের জল কি সে দেখতে পেল না, যার জন্য তুই নিজের সর্বস্ব খুইয়ে দিয়েছিলিস? নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত খুইয়ে দিয়েছিলিস তুই। আসলে কি জানিস মিতু…. নারী চরিত্র চিরকাল আমাদের সামনে অবলা। স্বাধীন হয়ে বাঁচার অধিকার যেন সে জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই খুইয়েছে। প্রত্যেক নারী কে জীবনের প্রতিটি হিসেব মেলাতেই হবে। সে হিসেব মেলার মত হোক বা না হোক। তুইও অনেক এমন হিসেব মিলিয়েছিস যে হিসেব কোনও ভাবেই মেলে না। কিন্তু জীবন এমন ভাবে চলে না মিতু। প্রত্যেক প্রাণীর নিজের জীবনে নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। এটা ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার। তোরও অধিকার আছে নিজের জীবন নিজের মত করে বাঁচার। জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছিস তুই। অনেক চোখের জল ফেলেছিস। কেউ ছিল না রে তোর পাশে। কেউ ছিল না যে তোর দুঃখ কে নিজের দুঃখ মনে করতো। জীবনের দীর্ঘদিন নিজের বুক ফাটা আর্ত চিৎকার কে নিজের বুকের মধ্যেই চেপে রাখার পর এক দিন তুই আমায় পেলি। তোর জীবনে এই পরিবর্তনটা দরকার ছিল। মিতু, বলতে দ্বিধা নেই, আমি যদি তোর জীবনে না আসতাম তাহলে তোর বুকের ভিতর চেপে থাকা আর্তনাদ এক দিন আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হতো। তখনও কি কেউ থাকতো তোর পাশে? জলে ডুবতে থাকা মানুষ হাতের কাছে যা পায় সেটা ধরেই বাঁচতে চায় সে। কেন না বেঁচে থাকা তার অধিকার।
মিতু, জানি আমাদের সম্পর্ক কে দুনিয়া কোনও দিনই ভালো নজরে দেখবে না। মানুষের মনের গভীরে ঢুকে তার কষ্ট কে বোঝার ক্ষমতা এই সমাজের নেই। সমাজ কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম বানিয়ে দিয়েছে। মানুষের হাজার কষ্ট হোক, তাকে সেই নিয়ম মেনেই চলতে হয়। সেই নিয়মই মাঝে মাঝে মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের মধ্যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে তারা জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে পারে। তুই সমাজের কিছু নিয়ম কে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলিস। তবেই আজ তুই জীবন যুদ্ধে অনেকটাই এগোতে পেরেছিস। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি মিতু। কারোর পরিচয়ে বেঁচে থাকা মানুষের দুর্ভাগ্য। মানুষের নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাকা উচিত। তবেই সে আসল সম্মান পায়। প্রায় অর্ধেক জীবন তুই অন্যের পরিচয়ে বেঁচে থাকলি। তাই যথেষ্ট সম্মান কোনও দিনই পাসনি তুই। আজ তোর নিজেস্ব পরিচয় আছে, তাই আছে যথেষ্ট সম্মানও। তোর একটা সাহসী পদক্ষেপের জন্য যে সমাজ এক দিন তোর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল, আজ সেই সমাজই তোর পদধুলি নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এটাই তো আমি চাইতাম মিতু। তুই নিজের পরিচয়ে বেঁচে থাক, এটাই ছিল আমার স্বপ্ন।
সত্যি বলতে আজ নিজের উপর আমার গর্ব হয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক মানুষ কে নতুন জীবন দিতে সক্ষম হয়েছি আমি। এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। মনে আছে, তুই আমায় বলেছিলিস যে যদি সম্ভব হতো তাহলে তুই আমার সাথে ঘর করতিস। আমাদের সন্তান হতো, হতো এক ছোট্ট পরিবার। চিন্তা করিস না মিতু। আমাদেরও ছোট্ট পরিবার আছে, আমাদেরও সন্তান আছে। আমরা তিন জন.. আমি, তুই আর তোর লেখা সমস্ত কবিতা। তোর লেখা কবিতাই তো আমাদের সন্তান মিতু, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন তোর কবিতা। আরও বড় কর আমাদের সন্তান কে। উন্নতির শিখরে নিয়ে যা তাকে।
আমি আজ দূরে চলে এসেছি মিতু, তার পিছনে কারণ ছিল। আমার হয়েও পুরোপুরি আমার না হতে পারাটা কোথাও না কোথাও তোর মনে কষ্ট দিচ্ছিল। যখনই আমাকে দেখতিস, তোর এই কষ্টটা তোর মুখে ফুটে উঠতো। প্রভাব পড়ছিল তোর লেখাতেও। নিজের কলমের মাধ্যমে চাবুক চালাতে তুই অভ্যস্ত। চারিদিকে ঘটে যাওয়া নোংরামির উপর তোর কলম মারাত্মক চাবুক চালাতে পারে। অদ্ভুত ধার তোর কলমে। সেই ধার আমি কমে যেতে দেখছিলাম। শুধু প্রেম আর বিরহের লেখা পাচ্ছিলাম আমি তোর থেকে। তোর মনের কষ্ট ফুটে উঠছিল তোর কলমে। না মিতু, না…. তুই এক প্রতিবাদী কবি। প্রেম, বিরহের কবিতা তো অনেক মহিলা কবিই লিখতে পারে। ক’জন মহিলা কবির মধ্যে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা আছে? ক’জন মহিলা কবি নিজের কলমের মাধ্যমে সমাজে ঘটে যাওয়া নোংরামির উপর মোক্ষম চাবুক চালাতে পারে? তুই পারিস সেটা। আমি চাইতাম তোর এই পরিচয় বজায় থাকুক। তাই তোর থেকে দূরে সরে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমাকে। তুই নিজেকে মজবুত করে নিয়েছিস মিতু। তুই এই সত্যটা মেনে নিয়েছিস যে আমি এক দমকা হাওয়া হয়ে তোর জীবনে এসেছিলাম। এতেই আমি খুশি।
অনেক লেখা হলো। আর নয়। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি মিতু। এই দমকা হাওয়া তোর থেকে দূরে গিয়েও তোর পাশেই আছে। তোর প্রতিটি নিঃশ্বাসে আছে এই দমকা হাওয়া, তোর লেখা প্রতিটি অক্ষরে আছে এই দমকা হাওয়া। যেখানেই থাকি না কেন, চিরকাল তোর হয়েই থাকবো আমি। ভালো থাকিস মিতু। ভালো রাখিস আমাদের সন্তান কে। আরও অনেক বড় করিস তাকে। এখানেই শেষ করলাম।
ইতি,
তোর দমকা হাওয়া।
এম পি নগর
ভোপাল।