কণ্টকের জ্বালা
– রাখী চক্রবর্তী
অমাবস্যা রাতে ঘন জঙ্গল দিয়ে একাকী চলেছে পোড়া কপালী রূপা। রূপার জীবন অতিষ্ঠ করে দিয়েছে কালনাগিনী জবা, ওর প্রাণের সই। একসঙ্গে খাওয়া, নাওয়া। মেলাতে গিয়ে হৈচৈ করা। অবশ্য এখন সব অতীত।
রূপার বিয়ে ঠিক হয়েছে ধনীরামপুরের জমিদারের ছেলে অশোক শীলের সাথে। তখন কি আর জানত রূপা যে জবা মন দিয়ে বসে আছে অশোকবাবুকে!
যাইহোক ভালোভাবেই বিয়ে মিটল রূপা ও অশোকবাবুর। বিয়ের পরের পরের দিন
রূপার বৌভাত ছিল। অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছেন। বাড়ি সুন্দর ফুলের গন্ধতে মো মো করছে। আলোতে ঝলমল করছে বাড়ির উঠোন। রূপা বেশ ভাগ্য করেই শ্বশুর ঘর পেয়েছে। এত খাতির, আদর, যত্ন খুব কম মেয়ের ভাগ্যতেই জোটে।
রাতের খাবার খেয়ে প্রায় সব অতিথিরা চলে গেছে। কিন্তু জবা এখনও রূপার ফুলশয্যার খাট সাজাচ্ছে। তবে চুপিচুপি।
রূপা ভাবছে সই আমার সাথে দেখা না করেই চলে গেল। খাবার খেয়েছে তো সই?
রূপার ননদ রীতা, দাদা ও নতুন বৌকে নিয়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে চমকে উঠল। একি ফুলশয্যার খাট কণ্টক শয্যায় কি করে পরিণত হল? রূপাও অবাক হয়ে গেল এ দৃশ্য দেখে। বাড়ির সব লোক এ দৃশ্য দেখার জন্য চলে এল রূপার ঘরে।
অশোকবাবু হঠাৎ বলে উঠল, তুমি এ ঘরে কি করছো?
রূপা বলল, ঘর তো ফাঁকা। তাহলে তুমি কাকে বলছো এ সব কথা?
অশোকবাবু বলল, ওই তো জবা খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
রীতা বলল, কি ভুলভাল বকছ দাদা? পুরো খাটটা তো কাঁটাতে ভর্তি। যে হাত রাখবে তারই তো হাতে কাঁটা বিঁধে যাবে।
– জবা চলে যাও এখান থেকে।
রূপা খাটের সামনে যেতেই একটা আলোর ঝলকানি রূপার মুখের ওপর পড়তেই বাঁচাও, বলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল রূপা। সেই মূহুর্তেই একটা ছায়া মূর্তি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রূপা ছাড়া সবার নজরেই পড়ল ওই ছায়া মূর্তিটা।
ডাক্তার ডাকা হল। রূপার কপালটা পুড়ে গেছে। ব্যান্ডেজ করে ডাক্তার বাবু চলে গেলেন। ফুলশয্যা ডকে উঠল অশোকবাবুর। কোনোমতে ওদের রাতটা কাটল অন্য ঘরে।
পরের দিন সকাল বেলায় রূপা ফুলশয্যার খাটটা দেখতে গিয়ে যা দেখল তাতে ও খুব ভয় পেয়ে গেল।
খাটের মধ্যিখানে অশোকবাবুর বিয়ের ধুতি আর বৌভাতের দিন জবা যে শাড়িটা পড়েছিল নীল রঙের বেনারসি সেইটা অগোছালো ভাবে পুরো খাট জুড়ে পড়ে আছে।
রূপা চিৎকার করে ডাকল ওর ননদ রীতাকে। রীতা এসে দেখে রূপা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে আছে।
অশোকবাবুকে খবর দেওয়া হল।
রুপা চোখ খুলতেই অশোকবাবুর মুখটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল আর বিশ্রী একটা আওয়াজ করে বলল, আজ রাতেই তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর কোনোদিন এ বাড়িতে আসবে না।
রীতা বলল, কি বলছো দাদা এঈ সবে কাল তোমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠান হল। আর আজ..
রূপা বলল, জবার শাড়ি এখানে কি করে এল? ওই তো জবা সিঁদুর পড়ে আমার বিয়ের বেনারসি শাড়ি পড়ে খাটে বসে আছে।
রীতা বলল, কোথায় জবা! খাটে তো কেউ নেই?
অশোকবাবু গিয়ে খাটে শুয়ে পড়ল। জবা অশোকবাবুর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। এ দৃশ্য শুধু রূপা দেখতে পাচ্ছে।
– জবা আমার স্বামীকে ছেড়ে দে। তুই ফিরে যা।
রূপার শ্বশুর বাড়ির লোকজন সবাই ভাবছে রূপার মাথা খারাপ হয়ে গেছে তা না হলে নিজের সই সম্পর্কে এ সব কি বলছে!
রূপা পাগলের মতো আচরণ করতে লাগলো।
সারাক্ষণ শুধু জবা…জবা..
অশোকবাবু এই পাগলীর সঙ্গে ঘর সংসার করতে পারবে না। অসন্তুষ্ট হয়়ে রাতের বেলায় ঘর থেকে বের করে দিল অশোকবাবু রূপাকে। ঘন অন্ধকার যেন রূপাকে গ্রাস করতে আসছে। আশেপাশে কেউ নেই। এমন সময় বিকট একটা শব্দ শুনতে পেল রূপা। এদিক ওদিক ভালো করে দেখে রূপা বুঝতে পারল শব্দটা জঙ্গলের পেছন দিক থেকেই আসছে। রূপা দেরি না করে ওই দিকেই ছুট লাগালো। একটা তান্ত্রিক আগুন জ্বালিয়ে কি যেন করছে!
রূপা চুপ করে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখছে। একটা মেয়ে স্নান করে গায়ে গামছা জড়িয়ে তান্ত্রিকের কাছে এল।
তান্ত্রিক বলল, এই জল পান করে নিজ মূর্তি ধারণ কর। আর যার সর্বনাশ চাস তার নাম তিনবার উচ্চারণ কর ।
আস্তে আস্তে মেয়েটি জবার রূপ ধারণ করে রূপা, রূপা, রূপা উচ্চারণ করতে লাগল।
রূপার হাত পা ঠাণ্ডা হতে লাগল। সই এতটা নিচে নেমে গেছে। শেষে কিনা আমার সর্বনাশ করতে তান্ত্রিকের কাছে এসেছে। কাল রাত থেকে যা যা হয়েছে সব পূর্ব পরিকল্পিত। অশোকবাবু আমাকে ভুল বুঝলেন। বাড়ি শুদ্ধু লোক আমাকে পাগল মনে করল।
– এইবার যাকে ভালবাসিস তার নাম তিনবার উচ্চারণ কর
– অশোক শীল, অশোক শীল, অশোক শীল।
– কার রূপ ধারণ করবি এবার বল?
– রূপার রূপ ধারণ করে ঐ বাড়ি যাব।
– ওরা তো রূপাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
– আপনি সব কিছু ওদের ভুলিয়ে দিন মন্ত্র পড়া জল দিয়ে।
রূপা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। ওর ঘর সংসার জবা ভোগ করবে কিছুতেই না।
যেমন ভাবা তেমন কাজ তান্ত্রিকের সামনে রাখা দাঁ দিয়ে জবার গলায় এক কোপ দিল রূপা। জবা লুটিয়ে পড়ল। রক্ত রক্ত চারদিকে। রূপা অজ্ঞান হয়ে গেল। তান্ত্রিক রূপার শরীর টানতে টানতে জঙ্গলের এক কোণে ফেলে দিল। সকালে জ্ঞান ফিরে রুপা দেখল নির্জন একটা জায়গায় পাতার ওপর শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে আগের রাতের ঘটনা ওর মনে পড়ল। জঙ্গলের পাশেই গঙ্গা।
সোনা রোদের ঝিকিমিকিতে ঝলমল করছে গঙ্গার জল। রূপা কিছুক্ষণ ভাবল সেখানে দাঁড়িয়ে, কি করবে? কোথায় যাবে?
শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে তাকে। সবটা বলবে অশোকবাবুকে, রীতাকে। শ্বশুর বাড়ির সামনে যেতেই রূপা থমকে গেল। অশোকবাবুদের বাড়ির সামনে এত ভিড় কিসের! মাথায় ঘোমটা দিয়ে রূপা ওই বাড়িতে ঢুকল। থমথমে বাড়িটা। কেউ কোথাও নেই। সদর দরজার বাইরে লোকজনের জমায়েত। রূপা একটা আশঙ্কা নিয়ে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াল। ওই তো, রীতা ওদের ঘরের খাট ধরে বসে আছে মাথা নিচু করে। খাটে শুয়ে আছে অশোকবাবু। ওমা এ তো সেই কণ্টক শয্যায় অশোকবাবু শুয়ে আছেন। মুখটা বীভৎস ভাবে হাঁ হয়ে আছে। চাপ চাপ রক্ত সারা শরীর জুড়ে। এত কাঁটার মধ্যে উনি শুলেন কেমন করে!
ওপরে কার পা ঝুলছে, সিলিং ফ্যানের দিকে চোখ পড়তেই রূপা ভয়ে কাঁপতে লাগল। বিকৃত মুখ করে জবা হাসছে। সারা মুখ রক্তে লাল। কি বিকট হাসির শব্দ।
– রীতা বলো তোমার দাদার এই অবস্থা কি করে হল?
রীতা বলল, কাল রাত একটার সময় আমি বাথরুমে যেতে গিয়ে দেখলাম দাদা তোমাদের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম ঘরে মনে হয় দাদা পায়চারি করছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি দাদা নেই। ঘরের দরজা ভেজানো। ভাবলাম এত রাতে দাদা ঘরের বাইরে কি করছিল? দাদা, দাদা বলতেই গোঁ গোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। তখন দেখি কণ্টক শয্যায় দাদা শুয়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে খাট।
এর মধ্যেই রূপাকে হেঁচকা টেনে কে যেন ওই শয্যায় ফেলে দিল। রক্তে ভেসে গেল রূপার শরীর। কি ভয়ঙ্কর কান্নার শব্দতে সারা ঘর তোলপাড় হয়ে গেল। রীতা অবাক হয়ে গেল রূপার এমন অবস্থা দেখে। জবার আত্মা ঘরের ভেতর উল্লাস করছে আলমারি কাঁপিয়ে, খাট কাঁপিয়ে। কেউ জানল না নব বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর এমন করুণ দশা কে করল? তবে সদর দরজার বাইরে যে সব লোকজন দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা বলাবলি করছিলেন পুরো বাড়িটা কাঁপিয়ে একটা হাওয়া যেন আমাদের সবার চোখে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। অশোকবাবু, রূপা, জবা তিনজনের পরিণতির কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।