গল্প

গল্প- মানুষ

মানুষ
– দেবস্মিতা ঘোষ

 

গ্যারেজ টা এখন ফাঁকা, কেউ নেই। গ্যারেজের পিছনের দরজা দিয়ে বেরোলে একটা ছোট্ট পুকুর। পানে মজে গেছে, কেউ আসে না। কেউ আসে না বললে ভুল হবে, ছোটো থেকেই এটা প্রিয় জায়গা পিন্টুর।

রাস্তায় জন্মানো ছেলের আবার ভালো লাগার জায়গা থাকে নাকি।

না থাকার কি আছে? তারাও তো মানুষ।

নিজের সাথে নিজে তর্ক করে সে। পুকুরের ধারে বসে নিজের সাথে খানিকটা বোঝাপড়া না করলে তার দিন কাটে না। হঠাৎ যদি তার এই সংকীর্ণ জীবনে ঢেউ তোলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে তখন সে আসে এই জায়গায়। যদিও তার কুড়ি বছরের জীবনে এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে।
‘তবে কি দীপুদা সব জেনে গেছে।’
‘জেনে গেলেই বা কি আমি কি ওর পয়সায় খাই, ধুর…আমি বেশি ভাবছি।’

নিজের মনকেই মানাতে পারছে না সে। তিনবছর আগের ঘটনাটা কিছুটা এইরকম।
পিন্টুর বাবা তার জন্মের আগেই মারা যান। রাস্তার ভিখারি মা তাকেও ওর মনে নেই। দু’ বছর বয়সে ওর মা মারা যান। মৃত মায়ের কোলে বছরের পিন্টুর ক্রন্দনরত মুখ মনে হয় সাধারণ মানুষের ব্যাস্ত মনকে গলাতে পারেনি তবে একটি পকেটমারের মনকে আদ্র করে দিয়েছিল। দীপক দাস ওরফে সবার দীপুদা পকেটমারদের দলের হেড ছিল। সেই পিন্টুকে মানুষ করেছে। পয়সার কমতি থাকলেও ভালোবাসার অভাব ছিল না। দলের সবাই বিশেষ করে দীপুর সদ্দবিবাহিত বউটি পিন্টুকে নিজের ছেলের আসনেই বসিয়েছিল। পিন্টু ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। দিপু ওকে পকেটমারের কাজ শিখতে দেয়নি তবে নিজের পেশাকেও ওর থেকে আড়াল করেনি। যে কাজ পিন্টুর মুখে খাবার তুলে দিয়েছে তাকে অশ্রদ্ধা করেনি কখোনো।

বছর সতেরোর পিন্টু পড়াশোনা তেমন শেখেনি। তবে দিপুদার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে সে ও দীপুর স্ত্রী একটি ছোটো খাবারের দোকান খোলে। দিন ভালোই কাটছিল। দীপুও পকেটমারের কাজে বেশি যেত না।
কিন্তু কোনো সুখই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
শ্রাবণ মাসের দিন ছিল। সেদিন দীপু কোনো একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল। তার স্ত্রী জ্বরে কাতর থাকায় পিন্টু একাই দোকান সামলাচ্ছিল। রাত আটটা নাগাদ বৌদির জন্য খাবার নিয়ে বাড়ি এসেছিল সে। বৃষ্টির কারণে দোকান তাড়াতাড়িই বন্ধ হয়ে গেছিল। ঘরের তালা খোলা দেখে অল্প সন্দেহ হয় কিন্তু সে আমল দেয়নি কারণ বৌদি বাড়ির ভেতরেই ছিল। কিন্তু ঘরে ঢুকে যে দৃশ্য সে দেখে তাতে তার বুদ্ধি লোপ পায়।

জ্বরে প্রায় অচেতন বৌদির অশ্লীল ছবি তুলছে সমরদা। সেও দলের পকেটমার বলতে গেলে দীপুদার ডানহাত। বাড়ির একটা চাবি তার কাছেও থাকে।
পিন্টুকে দেখে থতমত খেয়ে যায় সে। রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে হাতে থাকা খাবারের থালা ছুঁড়ে মারে সে। ভুলবশতঃ সেই থালার আঘাতে পড়ে গিয়ে খাটের গায়ে মাথা ঢুকে যায় তার। রক্তপাত হতে থাকে।

দীপু বাড়ি ফিরে শুধু দেখেছিল তার স্ত্রী অচেতন অবস্থায় গায়ের কাপড় ঠিক নেই। একদিকে পিন্টু হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে কাঁপছে, অন্য দিকে পরে রয়েছে তার বিশ্বস্ত বন্ধুর রক্তে ভেসে যাওয়া মৃতদেহ। দীপু কি বুঝেছিল সেই জানে। লাশটা বাগে ভর্তি করে স্টেশনে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল। ঘর পরিস্কার করে, পিন্টুকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। কোনো প্রশ্ন করেনি।

তার পরের ঘটনা নিয়ে খুবই হইচই শুরু হয়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পিন্টু কয়েকদিন ঘর থেকে বেরোয়নি। কিন্তু যখনই সে শুনল দীপুদাকে পুলিশ আরেস্ট করেছে সে আর থাকতে পারেনি। সোজা পুলিশকে গিয়ে সব বলে দেয়। দীপুদার চোখে ভর্ৎসনা ফুটে উঠেছিল কিন্তু তাতে গর্বও মিশে ছিল। এইসব এর মধ্যে “অনিচ্ছাকৃত খুন” এর অপরাধে সে জেলে যায়।

আজ পিন্টু মুক্তি পেয়েছে। সে আশা করেছিল দীপুদা তাকে আনতে যাবে কিন্তু সে যায়নি। এমনকি গত তিন বছরের মধ্যে একবারও তার সাথে দেখা করতে যায়নি। ইতস্তত করে সে দীপুদার বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে তালা দেখে তার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এই পুকুর ধারে বসে সে তাই আবার আগের মতো নিজের সাথে তর্ক তর্ক খেলছে।

“তিনবছরে অনেক লম্বা হয়ে গেছিস তো।”
চেনা একটি গলার আওয়াজে মাথা ঘোরালো পিন্টু। তিনবছরে অনেকটা বুড়িয়ে গেছে দীপুদা। তবে মুখের হাসিটা একই আছে। গলার আছে আটকে থাকা কান্নাটা চেপে মুখ খুলল সে।

“তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে থাকব”

“ছোটবেলায় তুই যখন কথা বলতে পারতিস না তখন কোনো অসুবিধা হলেই তুই কাঁদতিস তখন আমি বুঝে নিতাম তোর কি দরকার। আর এইটুকু জানব না যে দুঃখ হলে তুই কোথায় যাস”

“এতই যখন ভালোবাসো তাহলে এতদিন যাওনি কেন একবারও” আর আবেগ চেপে রাখতে পারল না পিন্টু। চোখ তার বিশ্বাসঘাতকতা করল।

“সেটা বলব বলেই এসেছি আজ। চল আমার সাথে।”

“কোথায়”

“আরে চল না”

দিপুদার পুরোনো সাইকেলটা বাইরে দাঁড় করানো ছিল। মিনিট কুড়ি পরে, একটা মাঝারি মাপের দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল তারা। বাড়ির বাইরে একটি উবের রাখা।
পিন্টুর অবাক চাহনিকে অগ্রাহ্য করে তাকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে দীপু। ঘরের ভিতর বছর দশ বারোর পাঁচটি শিশু। তাদের সামলাচ্ছে দিপুদার স্ত্রী। তাকে দেখে এগিয়ে এল।

“তুই চলে যাবার পর আমি তোর বৌদিকে সেদিনের ব্যাপারে সব খুলে বলি। ও তখনই তোর সাথে দেখা করতে যেতে চায় কিন্তু আমি ওকে আটকাই। আমরা তোকে চমকে দিতে চাই। বিশ্বাস কর পকেটমারের জীবন থেকে আমি সরে আসি। ব্যাংকের টাকায় লোন নিয়ে উবের কিনি আর তোর বৌদি দোকানে জীবন ঢেলে দেয়। তার পর ধীরে ধীরে দু’জনের সঞ্চয় দিয়ে এই জায়গাটা গড়ে তুলি।” দিপুদা থামল।

বৌদি বলল,” পিন্টু তুই আমার ছেলে। আর আমি চাই কোনো ছেলে মেয়ে রাস্তায় পড়ে যেন কষ্ট না পায়। তাই এই পাঁচজনকে দিয়েই শুরু করলাম। আর উবেরটা এখন থেকে তোর। আমি জানি তুই গাড়ি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিস অবসর সময়ে। তুই যা করেছিস তাতে ধন্যবাদ বলে ছোটো হবো না।”

দিপুদার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল পিন্টু। ধরা গলায় বলল, “আমি চাইনা বড়লোকের বাড়ি জন্মাতে। প্রতিজন্মে যেন রাস্তার অনাথ হয়ে জন্মাই যাতে তোমাদের মতো মানুষদের কাছে আসতে পারি।”
হঠাৎ বাচ্চাগুলো ছুটে পিন্টুর কাছে এল। “এটাই কি আমাদের দাদা গো মনিমা, সেই যার কথা বলতে গেলে তুমি কেঁদে ফেলতে”

“হ্যাঁ, আমিই তোদের সেই দাদা” বলে ওদের কোলে তুলে নিল পিন্টু।

সমাপ্ত

Loading

2 Comments

  • Anonymous

    প্রথমেই ধন্যবাদ জানাবো এরকম একটা গল্প আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।গল্পটার কিছু জায়গায় এমন ধাক্কা দেওয়া ঘটনা আছে যেগুলো খুবই হৃদয়বিদারক বাস্তব। এরকম আরো হৃদয় ছোঁয়া গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম…

  • subhendu

    daaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaaarrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrrruuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuuunnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnn hoyeche…… mon chuye gelo

Leave A Comment

You cannot copy content of this page