অভিভাবক সেন্টার
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে বাঁকুড়ার বড়জোড়া গ্ৰামে ‘বীনাপানী’ অপেরার নাম ছিল বেশ। গ্ৰীষ্ম ও শীত এই দুই ছিল যাত্রার সিজন। ‘বীনাপানী’ অপেরার মালিক রাম দুলাল বাবু ছিলেন অতি সজ্জন ব্যক্তি। যখন থেকে দূরদর্শনের পরিবর্তে উল্টানো ছাতা টিভির প্রচলন গ্ৰামগুলোতে শুরু হলো তখন থেকেই গ্ৰামগুলিতে যাত্রার বাজারে মন্দা দেখা দিল। এই যাত্রা শিল্পের সাথে জড়িত সকল মানুষই বেশ বিপাকে পড়তে শুরু করল। রাম দুলাল বাবুও যাত্রা ব্যবসাটি ধরে রাখতে পারলেন না। আধুনিক প্রযুক্তি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি যত আমাদের গ্রাস করছে ততই আমাদের নিজস্ব শৈলী ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে।
রাম দুলাল বাবুর যাত্রা কোম্পানির অন্যতম ও প্রধান নায়ক ছিলেন ‘দেবকুমার’। একটা সময় ছিল দেবকুমার স্টেজে উঠলেই হাততালির শব্দে মেতে উঠতো যাত্রা প্রাঙ্গণ। লম্বা, ফর্সা, নাদুস নুদুস চেহারা, একমাথা চুল, পুরুষালী আওয়াজ আর তার সঙ্গে ছিল সুন্দর সুরেলা কণ্ঠ।
নিজের একতলা ভাঙাচোরা ঘরের বারান্দায় বসে দেবকুমার এইসব কথা ভেবে চলে অহর্নিশি। পুরনো সোনালী দিনকে সরিয়ে বর্তমানের কঠিন দিনগুলোর সামনাসামনি হতে ভয় পায় সে। সকাল হলেই স্ত্রীর মুখ ঝামটা আর ছেলেমেয়েদের নানা অভিযোগ। যাত্রা ছাড়ার পর থেকে দেবকুমার ভেবেই চলেছে কি কাজ তার করা উচিত। কিন্তু কুড়িটা বছর পার হয়ে বার্ধক্যের দোরগোড়ায় পৌঁছেও আজও তিনি রোজগারের জন্য কোন পথই খুঁজে পাননি। অভিনয় করা ছাড়া সে যে আর কিছুই করতে পারবে না এই বদ্ধমুল ধারণা তাকে কোন কাজেই যুক্ত হতে দেয় নি।
নিজের জমানো টাকা ও রামদুলাল বাবুর দয়া দাক্ষিণ্যে এতগুলো বছর কোনো রকমে কেটেছে। যাত্রা বন্ধ হওয়ার পর পর টালিগঞ্জ পাড়ায় যাতায়াত করতো সে। কিন্তু আধুনিক কলাকৌশল কিছুই রপ্ত করতে পারে নি। তাই সামান্যতম রোল তার কপালে জোটে নি।
এখন প্রায় পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব দেবকুমার হতাশার স্বীকার। অভাবের সংসারে ডিপ্রেশন রোগীর ট্রিটমেন্ট করানোর কথা কেউ ভাবতে পারে না। সারাদিন সহানুভূতির বদলে দেবকুমারের কপালে জোটে গঞ্জনা। একদিন সকাল বেলায় দেবকুমার হঠাৎই এসে হাজির হয় রামদুলাল বাবুর কাছে। রামদুলাল বাবুর একমাত্র ছেলের বিয়ের পাকা কথা ছিল সেদিন। পুরনো লোককে দেখতে পেয়ে রামদুলাল বাবু খুব খুশি হন। তিনি দেবকুমারকে বলেন ‘আমার ছোট ভাইয়ের জায়গা তোকে নিতে হবে আজ। কন্যাপক্ষ জানে আমরা দুই ভাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা একথা তারা জানে না এখনও। তাই আমি চাই বিয়ের আগে তারা যেন এই অপ্রীতিকর ঘটনার কথা না জানে। পারবে তো দেবকুমার তুমি আমার সম্মান রক্ষা করতে?’
দেবকুমারও ভাবল এই সুযোগ রাম দুলাল বাবুর পর্যাপ্ত ঋনের সামান্য প্রতিদান দেওয়ার। আর রোজদিন নিজগৃহে লাঞ্ছনা তার অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তার থেকে ভালো রামদুলাল বাবুর বাড়িতে একটা দিন কাটানো। বাড়ীর পুরানো কাজের মাসি এসে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি ও ধুতি দিয়ে গেল। নাপিতের কাছে গোঁফ দাড়ি কামিয়ে, সুগন্ধি সাবান তেল ব্যবহার করে পরিপাটি হয়ে দেবকুমার রাম দুলাল বাবুর বৈঠকখানায় এসে হাজির হলো।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই কন্যাপক্ষ এসে হাজির। তা হবে গোটা পাঁচেক মুরুব্বি লোক। কন্যা নিজেও সশরীরে উপস্থিত। আজকালকার শিক্ষিত ও চাকুরিরতা পাত্রী বলে কথা। নিজ চক্ষে সব কিছু দেখে যাচাই করে নিতে চায়। পাত্রী মা-বাবার একমাত্র সন্তান হলেও যৌথ পরিবারই তার বেশি পচ্ছন্দ। রাম দুলাল বাবু দেবকুমারকে নিজ ভাই বলে পরিচয় করিয়ে দেন। পাত্রী (রিমা) আর দেবকুমারের মধ্যে আলাপ জমে ওঠে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে। নাটকের সংলাপ, গান, কবিতা সব কিছুতেই দু’জন দু’জনকে টক্কর দিচ্ছে ভালোই। এহেন হবু কাকা শ্বশুর পেয়ে পাত্রী (রিমা) ভীষণ খুশি।
তবে বিয়ের পর রিমা সবকিছুই জানতে পারে। দেবকুমার তার আসল কাকা শ্বশুর নয় ভাড়াটে কাকা শ্বশুর। প্রথমটায় কষ্ট পেলেও দেবকুমারের রুচি, শিক্ষা দীক্ষা, সাংস্কৃতিক মনোভাব এইসব কিছুর জন্য রিমা দেবকুমারকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখতে শুরু করল।
রিমা যে অফিসে চাকরি করে সেখানে তার অন্তরঙ্গ কলিগের শুধুমাত্র কোন পুরুষ অভিভাবক নেই বলে বিয়েতে বাধা আসে। অভিভাবকহীন ফ্যামিলি থেকে মেয়ে নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছিল না ছেলের পরিবার। তখন রিমার দেবকুমারের কথা মনে পড়ে। রবিবার ছুটির দিন দেবকুমারকে বাড়িতে ডেকে পাঠায় সে।
– কাকা বাবু, আপনি যেমন কাকা শ্বশুর সেজেছিলেন আমার বিয়ের সময়, তেমনি আর একবার অভিভাবক সাজতে হবে আপনাকে।
দেবকুমার সহাস্য বদনে রাজী হয়ে যায় রিমার প্রস্তাবে। যথারীতি দেবকুমারের অভিভাবকত্বে রিমার বান্ধবী পেয়ে যায় একখানি সুন্দর পরিবার। আজও অনেককেই মনে করেন বাবা কাকার ছত্রছায়ায় বড় না হলে সেই সন্তান বেপরোয়া হয়ে যায়। অভিভাবক হচ্ছে সেই সুতো যা সন্তানদের নিয়ম শৃঙ্খলার বাঁধনে বেঁধে রাখে।
এইভাবে ডিপ্রেশনে চলে যাওয়া একজন দক্ষ অভিনেতা আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে থাকে। দেবকুমারের বাড়ির সামনে একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয় রিমা। ‘অভিভাবক সেন্টার’ ফোন-৮৬৯২০৭*৫৬০ সকাল থেকে নতুন মোবাইল ফোনে কল ধরতে ব্যস্ত থাকেন দেবকুমার। কেউ ফোন করে বলে ‘পালিয়ে বিয়ে করছি। আপনাকে মেয়ের বাবা সাজতে হবে।’ আবার কেউ বলে ‘পরীক্ষায় ফেল করেছি। আপনাকে বাবা সেজে যেতে হবে পেরেন্টস টিচার মিটিংয়ে’। এইসব ঝুট-ঝামেলার ফোনগুলো দেবকুমার উপস্থিত বুদ্ধির জোড়ে পাশ কাটিয়ে যায়। আগের মতো দেবকুমারের সংসারে অভাব নেই। স্ত্রীর মুখ ঝামটাও নেই বললেই চলে। নতুন অভিনয় জগতে দেবকুমার আবার তার অভিনয় প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পেরে খুব খুশী। রিমা এসে একটা লিস্ট বানিয়ে দিয়ে গেছে-
(১) ছেলে ও মেয়ের বাবা প্রতিদিন তিন হাজার টাকা।
(২) ছেলে ও মেয়ের দাদার প্রতিদিন দুই হাজার টাকা।
(৩) ছেলে ও মেয়ের কাকা, জেঠু প্রতিদিন দেড় হাজার টাকা।
(৪) ছেলে ও মেয়ের দাদু প্রতিদিন হাজার টাকা।
এই ভাবে দেবকুমারের অভিনেতা সত্তাকে অর্থ রোজগারের হাতিয়ার করে ও অভিভাবকহীনদের সাময়িক অভিভাবকত্বের ছত্রছায়ায় আনতে পেরে রিমা ভীষণ খুশি।