ধূর্জটিবাবুর পাগলামি
– ইন্দ্রনীল মজুমদার
(গত ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে হিরোসিমা দিবস ও নাগাসাকি দিবস স্মরণ করে এই গল্পটি লেখা।)
৬ই আগস্ট। সকালে বৃষ্টির ধারা ধরণীকে বইয়ে দিল। বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেলাম। এমন সময় কলিং বেলের ঘন্টা। দরজা খুলতেই এক গাল হাসি নিয়ে তিনি হাজির। তিনি আর কেউ নন আমাদের সবার প্রিয় পাঞ্জাবি প্রতিবেশী সিংজী ওরফে রাম কিরণ সিং। ছাতাটা মেঝেতে মেলে রেখে সোফায় বসলেন। এরই মধ্যে চা ও সিঙারা হাজির। যাক ভালোই হল খেতে খেতে এই বাদলা দিনে বেশ জম্পেশ গল্প করা যাবে।
সিংজী প্রথমে একটা প্রশ্ন করে বসলেন, “ আপনি ধূর্জটিবাবুর কাহিনী শুনেছেন?”
আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, “না। কে তিনি?”
– সে অনেক বছর আগেকার কথা। দেশ স্বাধীনতার দু-বছর আগের অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ঘটনা। ধূর্জটিবাবু বলছি ঠিকই কিন্তু তাঁর পুরো নাম হল ড.ধূর্জটিপ্রসাদ পাকড়াশী। তা তিনি…….
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, “দাঁড়ান দাঁড়ান। উনি কি বিজ্ঞানী ছিলেন? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক কি?”
সিংজী উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, “এক্স্যাক্টলি! একদম ঠিক ধরেছেন।”
-এইবার মনে পড়েছে। পদার্থবিজ্ঞানী ধূর্জটিবাবু বোধ করি ‘Radioactivity’, ‘Einstein’s concept of the Universe’, ‘The future world’ ইত্যাদি নামকরা ইংরেজি বিজ্ঞান বইগুলির লেখক। আমি শেষ দুটো বই অনেকদিন আগে পড়েছিলাম। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলি জার্মানি,আমেরিকা,ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলোর নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। নানা দেশের নানা বৈজ্ঞানিক সভায় বক্তৃতা দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের এক বৈজ্ঞানিক যাঁর নামটা ঠিক মনে পড়ছে না তিনি বলেছিলেন- “Mr.Dhurjati Prasad Pakrashi’s written papers are gold mines. They are like treasures to all of us.” কিন্তু হাজার 945 সালের পর তিনি কি একটা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পাগল হয়ে যান অধ্যাপনা ছেড়ে দেন কেন যে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তাও আমার অজানা।”
সিংজী বললেন, “তিনি কেন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন সেটা আমি জানতে পেরেছিলাম যখন এই কলকাতায় প্রথম আসি। তিনি পাগল যখন হয়েছিলেন তখন থেকেই এমনকি মৃত্যুশয্যাতেও খালি বলে যেতেন,- “Man is the killer of himself-মানুষ নিজেরাই নিজেদের ঘাতক।” মাঝে মাঝে তিনি চিৎকার করে বলতেন,- “Oh God, save these illeterate persons. These modern human aka Homo sapiens don’t understand the concept of Humanism. Humanism shall live.Humanism-where are you? Save us God,save us, save the world.”
আসলে যে ঘটনাটি তার মনে দাগ ফেলে দিয়েছিল, যার জন্য তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন, সেই ঘটনায় আসি। ১৯৪০ সালের ধূর্জটিবাবু দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা, নানা বইপত্র ঘেঁটে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নাল পড়ে এবং মারি ক্যুরি, পিয়ের ক্যুরি, রাদারফোর্ড, বেকরেল ইত্যাদি
বিশ্ববিখ্যাতদের লেখা পড়ে বহুকষ্টে ‘Radioactivity’ নামক একটি বই লেখেন। এই বইটি সারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত লাভ করে। এর ভাষা এতোটাই সাবলীল ছিল যে একজন উচ্চ শ্রেণির স্কুল ছাত্রও বুঝতে পারবে এই বইয়ের বিষয়বস্তু। আসলে ধূর্জটিবাবু অধ্যাপক হিসেবেও দুর্দান্ত ছিলেন। এখনকার অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাই হয়তো তারঁ মতোন নয়। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সমস্যাগুলি সুন্দর করে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে মেলে ধরতেন আর তার সাথে জটিল গাণিতিক ব্যাপারগুলিও সহজভাবে বোঝাতেন। এবার আসল ঘটনায় প্রবেশ করা যাক। এক ঐতিহাসিক ঘটনা যা সবার জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন বিশ্বজুড়ে চলছে, তখন ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৪১-এ আমেরিকার পার্ল হার্বারে জাপান আক্রমণ চালায় যাতে আহত হন বহু। কিন্তু এই ঘটনা ধূর্জটিবাবুর মনে দাগ কাটেনি। এই পার্ল হার্বারের বদলা আমেরিকা এমনভাবে নেয় তা বিজ্ঞানের মাধ্যমে হলেও চিরকালের জন্য বিজ্ঞানের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হবার মুখে। পৃথিবী বিশ্বযুদ্ধের দাপাদাপিতে যখন হাঁফ ছেড়ে উঠেছে ঠিক তখনই ৬ই আগস্ট,১৯৪৫ সালে হিরোশিমার বুকে সকাল ৮ টা ১৫-এ পড়ে ‘লিটিল বয়’ নামক অ্যাটম বোম যা কেড়ে নেয় ৯০,০০০ থেকে ১,৬৬,০০০ জনের প্রাণ। বলা যায়, শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষের প্রাণ চলে যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনে ধূর্জটিবাবু প্রায় অর্ধ-উন্মাদ হয়ে ওঠে। ধূর্জটিবাবুর পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গেলেন মাত্র তিনদিনে যখন রেডিওতে শুনলেন যে ৯ই আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ফ্যাট ম্যান’ নামক আরেকটা অ্যাটম বোমা জাপানের নাগাসাকিতে বেলা ১১ টা বেজে ২ মিনিটে নিক্ষেপ করে দিয়ে যা কেড়ে নেয় ৬০,০০০-৮০,০০০ মানুষের প্রাণ এবং শেষ করে দেয় শহরের অর্ধেক বাসিন্দাদের। জাপান এই ঘটনার ছ-দিনের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে আর সেইসঙ্গে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ধূর্জটিবাবু যখন শুনলেন যে ঘটনাটির দু- চার মাস পরে ওই দুটি অভিশপ্ত শহরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব মানুষের জীনে ঢুকে তার ক্ষতি করে চলেছে তখন বিজ্ঞানের এই অভিশাপ তাঁর মনে এমন এক গভীর চাপ ফেলে দায় যে তাঁকে আর মানসিক অসুস্থতার থেকে বা বদ্ধ পাগলের দশা থেকে সুস্থ করা আর কোনোদিনও যায়নি। বলাবাহুল্য, ওই তেজস্ক্রিয়তার ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেখানে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছে। তাঁর মতে বোধহয় তাঁর ‘Radioactivity’ বইটি এসবের মূল কারণ। সেই বই তিনি সাধ্যমতো বাজার থেকে তুলে নিলেও পরে তাঁর সেই বই বিক্রিও হয় তবে সেটি নিঃশেষিত হয়ে গেলে আর তা পুনঃপ্রকাশ করতে দেননি। অধ্যাপনা তো ছেড়েই দেন। বাড়িতেই থাকতেন আর মনে মনে কি সব বিড়বিড় করতেন। তবে ১৯৫৬ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে সবসময় এমনকি ঘুমের ঘোরেও বলতেন, “Oh God,save this world,save people,save Humanism.” সত্যিই আজ পৃথিবীতে মানবিকতা কমে গেছে, মনুষ্যত্ব আজ অনেকটাই লোপ পেয়েছে।
অনেকক্ষণ সিংজী বলার পর আমি বলে উঠলাম, “We want Humanism. We want such a person who will work for the betterment of the world not by killing people. He/she must save the world from all kinds of dangers.আমরা মানুষের মতো মানুষ চাই, পশুর মত মানুষ নয়, কৃত্রিম মানবিকতার মানুষ নয়। ডিগ্রিধারী রোবট নয় বরং কাজের মানুষ চাই। বিজ্ঞান হোক আশীর্বাদ, অভিশাপ নয়। বিজ্ঞান হোক বিজ্ঞানের অভিশাপের বিরুদ্ধে পরম অস্ত্র। প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্কট, পরিবেশ দূষণ কমুক। এই আমাদের রইলো আশা।”
সিংজী হাসলেন।