গল্প- হিরের লকেট

হিরের লকেট
– রাখী চক্রবর্তী

 

মহালয়ার দু’দিন আগে থেকেই প্রতি বছরই মা দুর্গার গয়না পালিশ করাতে নিয়ে যান চক্রবর্তী বাড়ির কর্তা বিনোদ বাবু।
বনেদি বাড়ির পুজো বলে কথা। এ বছরেও তার অন্যথা হয় নি। কিন্তু স্যাকরার দোকানের কর্মচারীর কথা শুনে বিনোদবাবুর মাথায় হাত। মা দুর্গার হিরের লকেটটা নাকি নকল। গত বছরও তো ঠিক ছিল তা হলে কে, কে এ কাজ করল?
স্যাকরার দোকান তো আজকের না। বহু বছরের পুরনো। অবিশ্বাস তো করা যাবে না।তাহলে কি বাড়ির কেউ, নানা রকম উল্টোপাল্টা ভাবনা বিনোদবাবুকে ঘিরে ধরেছে। বাড়ির ঐতিহ্য এই হিরের লকেট।আর তা কিনা কেউ আসলটা নিয়ে নকল লকেটটা দিয়ে গেছে। কাকে সন্দেহ করবেন উনি? তিন ছেলেই তো বড় বড় কোম্পানিতে কাজ করে। তিন বৌমা, কেউ তো খেলো ঘরের থেকে আসেনি। তাহলে কে, একরাশ চিন্তা নিয়ে চক্রবর্তী বাড়ির কর্তা বিনোদবাবু বাড়ি ফিরলেন।

গিন্নিকে মা দুর্গার লকেটের কথা সব বললেন। পুলিশের কাছে একটা রিপোর্টও করে এসেছেন। এখন কি হয়। চক্রবর্তী গিন্নি প্রভাবতীদেবী তো ভাবতেই পারছেন না। কি করে চুরি হল। যাই হোক সারা রাত ওনাদের চোখে ঘুম নেই।
খুব সকাল সকাল বিনোদবাবু বাইরে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। এমন সময় কে যেন জানলা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে।
এই…কে রে? বিনোদ বাবুর চিৎকার শুনে প্রভাবতীদেবী, ছেলেরা ও বৌমারা সব ছুটে এলো।
-কি হয়েছে বাবা?
-বাগানে দেখো তো কেউ আছে কিনা? কে যেন উঁকি মারছিল।
– নীরা বাগানে গিয়ে দেখল, পরনে ময়লা শাড়ি, চুলে জটা একটি মেয়ে আম গাছের নিচে বসে আছে।
– এই তুই এখানে কি করছিস? যা বলছি।চুরির ধান্দা না সব। পালা বলছি।
মেয়েটা দে ছুট।
– দেখে তো পাগলি মনে হল। চুরি করতে এসেছিল নিশ্চয়ই।
বিনোদবাবু মনে মনে ভাবছেন আসল চোরকে তো ধরতে পারলাম না। যততো সব..

“এত সুর আর এত গান যদি কোনদিন থেমে যায় “
এত সুন্দর গানের গলা কে গাইছে? মনে হচ্ছে বাগানের দিক থেকেই গানের সুরটা ভেসে আসছে। পরন্ত বিকেলে এলোমেলো হাওয়ার সাথে নিজের চুলের গোছা সামলাতে সামলাতে চক্রবর্তী বাড়ির বড় বৌ নীরা নিজের খেয়ালেই কথাগুলো বলে চলেছে ।কিছুক্ষণ পর গানটা থেমে গেল।আবার গানটা শুরু হল। নীরা ভাবল
না..গিয়ে একবার দেখি কে বাগানে আছে।আর গাইছেই বা কে!
নীরা বাগানে গিয়েই, এই তুই ভর সন্ধ্যা বেলায় বাগানে কি করছিস? কে গান গাইছিল রে?
– জানি নে তো বড় মা।
– এই পাগলিকে নিয়ে মহা মুশকিল হয়েছে।যখন তখন বাগানে ঢুকে পরছে।
না, কেউ তো নেই বাগানে। তাহলে কে গান গাইছিল?
– বড় মা একখান গান গাইনে ‘ক্ষুনি
– নীরা ঝাঁঝিয়ে পাগলিটাকে বলল,এই চুপ কর। তোর গান শুনতে আমি আসি নি।বেরিয়ে যা এখান -থেকে।
– কিসের এত চিৎকার বড় বৌমা
– না মা ও কিছু না। ওই পাগলিটা আবার এসেছে।
প্রভাবতীদেবী পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন মহা ঝামেলায় পড়লাম তো।
-ওও কর্তা মা কাযির জন্য হননে হয়ে ঘুরতেসি। একখান কায দেন নে মা। সামনি পুজা ।
– ও বড় বৌমা পুজোর সময় তো লোকজন কম হয় না, তা ওকে কাজে রাখলে কেমন হয় বলতো।
-মা তুমি জানো না, এরা..
– থাক না বৌমা। কাজে রেখে দাও। দেখবে তোমাদেরই সুবিধা হবে।
– মা জননী তাহলি আমি আজ থিকি কাযে নেগে পড়ি।
– রাতের বেলায় অনেক কাজ, সব ঠিক করে করবি কিন্তু। এই বলে প্রভাবতীদেবী নিজের ঘরে চলে গেলেন।
নীরা পাগলি মেয়েটিকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে কি কি কাজ ওকে করতে হবে।
এই শাড়ি আর পড়বি না। আমি তোকে ভালো শাড়ি দিচ্ছি। ঠিক আছে। কি নাম তোর? সে সব তো কিছু বললি না
– ময়না বলে ডাকতি পারো আমায়
– আর কে আছে তোর?
– মরদ আছে একখান
– ওও, আর ছেলে মেয়ে?
বাজা বলে লোকে। হি হি ..
সেই রাত থেকেই ময়না কাজে লেগে পড়লো। সিঁড়ির তলায় ময়নার থাকার ব্যবস্থা হল। ইচ্ছে হলে ও বাড়ি যাবে নয়তো এখানেই থাকবে ময়না।

পরের দিন বেশ সকালেই পুলিশ এসেছে চক্রবর্তী বাড়িতে। মা দুর্গার হিরের লকেট চুরি হয়েছে এবার বাড়ির সবাই জানতে পারল। পুলিশ বিনোদবাবুকে আশ্বাস দিয়ে বললেন মহা ষষ্ঠীর দিনই মা দুর্গা হিরের লকেট পড়বে। কোন চিন্তা করবেন না।
পুজোর আনন্দ যেন এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল। চক্রবর্তী বাবুর তিন ছেলে বিজয় সুজয়, অজয় যে যার মতো ঘরে চলে গেল।তিন বৌমা অবশ্য মিটিং ছেড়ে গেল না। নীরা, সীমা, হৈমন্তী গুজুর গুজুর করেই যাচ্ছে।
ময়না সকালের জলখাবার নিয়ে সবাইকে দিতে গেল। বাড়ির কেউ মুখে খাবার তুলল না।
সবারই এক চিন্তা। লকেটটা কোথায় গেল?
বিনোদ বাবু পুলিশের সাথে থানায় গেলেন।কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। থানার বড় বাবু এসেছিলেন খুব সকালে বিনোদবাবুর বাড়িতে।
রাত্রি ঠিক আটটা বাজে বাড়ির পেছন গেট দিয়ে প্রভাবতীদেবী বেরিয়ে গেলেন। রাত নটার সময় বাড়ি ফিরলেন উনি।
-মা জননী এত রাতি আপনি কোথায় গেছিলেন?
-হ্যাঁ রে, ময়না তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি!
-না জননী এমনি কই ছিলাম

“বাজল তোমার আলোর বেনু”
বাহ্ কি সুন্দর গানের গলা। কে গাইছে এত রাতে। বাড়ির সব সদস্যদের মুখে একই কথা। নীরা জানলার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে গান গাইছে। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারল না নীরা তবে একটা ছায়া মূর্তি চলে গেল যেন।
যাইহোক যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ল। পুবের আকাশ একটু লালছে হয়েছে, প্রভাবতীদেবী চুপিচুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ভোর পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরলেন উনি।
ময়না তুই ভোর বেলায় বাগানে কি করছিস?
– মা জননী আপনি রাত বিরেতে একা একা বাড়ির বাইরে যাবেন না। বিপদ হতে পারে
– তোকে এ সব ভাবতে হবে না। যা নিজের কাজ কর। কাল পঞ্চমী। ঘর দোর সব পরিষ্কার কর।
বিনোদবাবুর এখনও ভেবে চলেছেন মা দুর্গার হিরের লকেটটা ঠিক সময় মার গলায় উঠবে তো। আর একটা দিন মাঝে আছে।
থানার বড় বাবু আজও এসেছেন। আশ্বাস দিলেন কালকের মধ্যে চোর ধরা পড়বেই তবে এখনই কথাটা চাউর করবেন না।ভালো ভাবে আগে মিটুক সব কাজ।
আজ পঞ্চমী,
বিনোদবাবু বড় বৌমা নীরাকে ডেকে বলে দিলেন বাড়ির থেকে আজ যেন কেউ না বের হয়। আত্মীয়দের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না হয়।
এর মধ্যে প্রভাবতীদেবী বলছেন আজকে ওনাকে যেতেই হবে ওনার ছোট বোনকে আনার জন্য। বিনোদবাবু তাতে কোন আপত্তি করলেন না। দুপুর একটার সময় প্রভাবতীদেবী স্টেশনে গেলেন ওনার বোনকে আনতে। বিকেল হয়ে গেল বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন। এখনও বাড়ির গিন্নি বাড়ি ফিরলেন না কেন?
সন্ধ্যা ছটার সময় বিনোদবাবুর শালী উমাবতী ব্যাগ পটরা নিয়ে হাজির। এসেই গজগজ করতে শুরু করে দিয়েছেন, জামাইবাবু আমাকে আনতে স্টেশনে কাউকে পাঠাতে পারতেন। এত জিনিস পত্র নিয়ে আমি একা কি করে এলাম সে আমিই শুধু জানি..

– হৈমন্তী বলল, কেন মাসিমনি মা যে তোমাকে আনতে গেল স্টেশনে সেই দুপুর বেলায়। তাহলে মা কোথায় গেল?

সবাই চিন্তাতে পড়ে গেছে। রাত হতে চলল।
এদিকে নীরা ময়নাকে ডাকাডাকি করে তারও কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছে না।
বাড়ি শুদ্ধু হুলুস্থুলু কাণ্ড। ময়নার খোঁজ চলছে এ ঘর ও ঘর ছাদ, চিলে কোঠা কিছু আর বাদ নেই।
বিনোদবাবু বললেন আগে সব জিনিসপত্রগুলো দেখো কিছু চুরি করে পালাই নি তো ময়না।
রাত্রি 9টা বাজে। পুজোর ধুমধাম সব নষ্ট হয়ে গেল। প্রভাবতীদেবীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
কাল দুর্গা ষষ্ঠী। কি হবে মা দুর্গাই জানে।
রাত 10 টার সময় বিনোদবাবু তার তিন ছেলেকে নিয়ে থানায় গিয়ে বড় বাবুকে সব কথা বললেন এবং দু’টো মিসিং ডায়েরি করলেন। ময়না ও প্রভাবতীদেবীর নামে ।
বিনোদবাবুর ছোট ছেলে থানার দেওয়ালে একটা ছবি দেখে চমকে উঠলেন। ফিসফিস করে বললেন বাবা এই ছবিটা চেনা চেনা লাগছে। ভালো করে দেখে তো। ঠিক ময়নার মতো না।
– না রে ময়না হল পাগল ছাগল। এনি তো অফিসার। দেখছিস না
যাইহোক বিনোদবাবু ছেলেদের নিয়ে বাড়ি এলেন।
রাত একটার সময় চিৎকার চেঁচামিচি শুনে বাড়ির সব লোকেরা সদর দরজা খুলে বাইরে আসতেই সবাই হতবাক হয়ে গেল।প্রভাবতীদেবী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে আছেন। তিন চারটে পুলিশ অফিসার ও ময়না একজন তান্ত্রিককে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বিনোদবাবু জিজ্ঞাসা করলেন এ সব কি হচ্ছে আর ময়না তুই পুলিশের সাথে কি করছিস।
পুলিশ অফিসার বললেন, মাফ করবেন চক্রবর্তী বাবু ইনি ময়না নন। সি.আই.ডি. অফিসার রিমা দে। আপনি যেদিন হিরের লকেটা চুরি হয়েছে বলে থানায় এসেছিলেন, সেদিনই রিমা ম্যাডাম এই কেসটা হাতে নিয়েছিলেন। ময়না সেজে আপনাদের বাড়ি তে ঢুকেছিল।
তারপর কি হয়েছিল ময়নার মুখ থেকে থুড়ি রিমা ম্যাডাম এর মুখ থেকেই শুনুন
ময়না নাম নিয়ে আমি আপনাদের বাড়িতে কাজ নিলাম। বাগান আমার খুব প্রিয়। তাই সকাল সন্ধ্যা বাগানে গিয়ে গান করতাম।
নীরা বলল, তাই আমি ভাবতাম কে গান গাইছে কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। ময়না ছাড়া তো কেউ নেই এখানে। কি সুন্দর গানের গলা তোমার। স্যরি আপনার
বিনোদবাবু বললেন, আগে গিন্নিকে ঘরে নিয়ে চল। আপনারাও চলুন ভেতরে। সব কথা হবে ঘরে বসে।
পুলিশ অফিসার হিরের লকেটটা বিনোদবাবুকে দিয়ে বললেন আমি এখন তান্ত্রিককে নিয়ে থানায় যাব। রিমা ম্যাডাম এর মুখ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনে নিন।
রিমা ম্যাডাম বলতে শুরু করলেন,
প্রভাবতীদেবী বছর খানেক হল এই ভণ্ড তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়েছেন। উনি বলেছেন তোর গৃহে বিশাল বিপদ। যদি তুই মা দুর্গার হিরের লকেটা আমাকে এনে দিস তাহলে আমি মন্ত্র পড়ে আবার লকেটটা তোকে দিয়ে দেব। দেখিস কেউ যেন টের না পায়। তাহলে বিপদ মুক্ত হবে তোর গৃহ।
প্রভাবতীদেবী গত তিন মাস আগে হিরের লকেটটা তান্ত্রিককে দেন। তারপর তিনদিন পর মন্ত্র পড়া হিরের লকেটটা নিয়ে আসেন।বাড়ির কেউ কিছু টের পেল না।
বিনোদবাবু সোনার দোকানে গয়নাগুলো দিয়ে যখন জানতে পারলেন হিরের লকেট টা আসল না তখন বাড়ি ফিরে উনি সবার আগে হিরের লকেট চুরির কথা প্রভাবতীদেবী কেই বলেন। তখন থেকেই উনি বুঝতে পেরেছেন যে ভণ্ড তান্ত্রিক ওনাকে ঠকিয়েছে। রাতের বেলায়, সকাল বেলায় যখন যখন উনি বাইরে বের হতেন আমিও ওনার পিছু নিতাম। সেদিন ভোর বেলায় গিন্নি মা আমাকে প্রায়ই ধরেই ফেলেছিলেন। যাইহোক এবার তান্ত্রিক গিন্নি মাকে পঞ্চমীর দিন রাতের বেলায় আসতে বলেছিলেন এই বলে যে আসল হিরের লকেটটা ফেরত দেবেন।গিন্নি মা ডেরায় যেতেই ওনাকে আটক করল ভণ্ড তান্ত্রিক ও তার সাগরেদরা। আমি গত দু’দিন ধরে ওনার পিছু নিয়ে সব জেনে গেছিলাম। তাই আমিও পুলিশ ফোর্স রেডি রেখেছিলাম।প্রভাবতীদেবীর পিছু পিছু আমিও গেছিলাম। মন্ত্রপড়া জলটা খেয়েছেন বলে গিন্নি মা এখনও বেহুঁশ আছেন। খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবেন উনি। আজ দুর্গা ষষ্ঠী মার গলায় হিরের লকেটটা জ্বল জ্বল করবে।
নীরা গান পাগল মেয়ে। ময়না ঐ গানটা করো না প্লিজ, বাজল তোমার আলোর বেনু
– আগে খাতি দেও। খিদা লাগচে। কাল থেকে প্যাটে কিছু দেয় নাই।
– হা হা চলুন রিমা ম্যাডাম আজ
জলখাবার আমি বানাব
এর মধ্যে প্রভাবতীদেবীর জ্ঞান ফিরেছে ।ময়নার মাথায় হাত দিয়ে উনি বললেন, ভাগ্যিস আমি সেদিন তোমাকে কাজে রেখেছিলাম তা না হলে কি যে হত।
– না গিন্নি মা।আপনি না রাখলেও আমি থেকে যেতাম।
গিন্নি মা একটা মা দুর্গার সোনার লকেট ময়নাকে দিয়ে বললেন এইটা গলায় দিয়ে রেখো মা মঙ্গল করবে তোমার। ময়না লকেটটা নিয়ে পুজো মণ্ডপে গেল মা দুর্গাকে প্রাণ ভরে দেখে চক্রবর্তী বাড়ি থেকে বিদায় নিল। হিরের লকেটটা মা দুর্গার গলায় পড়িয়ে দিয়ে প্রভাবতীদেবী বললেন আমাদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করো মা।জয় মা দুর্গার জয়।

Loading

One thought on “গল্প- হিরের লকেট

Leave A Comment