Site icon আলাপী মন

অণু গল্প -একাকিত্ব

একাকিত্ব
-সুজিত চ্যাটার্জি

 

ভোলেবাবা পার করেগা।
বাঁকের দুমাথায় দুটো জল ভর্তি কলসি টাঙানো। গনশা চলেছে বাবার মাথায় জল ঢালতে। শ্রাবণ মাস এলো, আর বাই উঠলো। উদোম পায়ে ছুট ছুট ছুট। কাটুক ফাটুক কুছ পরোয়া নেই। কদম কদম বাড়ায়ে চল। পুণ্যি পুণ্যি, বাবার মাথায় জল ঢাললেই অঢেল পুণ্যি। এতো পুণ্যি রাখবি কোথায় গনশা?

গনশার বুড়ো বাপ সন্ধ্যে হলে এসে বসে মনসা তলায় । পাশে কেতোর ( কার্তিক) বাপ। সুখের গল্প নেই। তাকিয়ে থাকা আছে। জুলজুল করে তাকিয়ে থাকা। স্মৃতি ছাড়া সম্বল বলতে কিছু নেই। হ্যাঁ আছে, আক্ষেপ। গনশা টা মানুষ হলো না। খোঁজ নেয় না একটুও। বাপ মা মলো না বাঁচলো। একটাই সন্তান তো। এখন ভাবে , একটা মেয়ে থাকলে ভালো হতো হয়তো। অন্তত খোঁজ খবরটা নিতো।
মেয়েরা মায়ের জাত কিনা।
হ্যাঁ , আরও আছে । ভয়। বড্ড ভয়। যদি অসুখ বিসুখ করে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। কিংবা গনসার মা …. কে কাকে দেখবে , চিকিৎসা, খরচ?
বড্ড ভয় , যদি মরে যাই , গনশার মাকে দেখবে কে?
মনসা তলায় সন্ধ্যারতি হচ্ছে। গনশার বাপ ঘোলাটে চোখে, কাঁপা হাত কপালে ঠেকিয়ে অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে , আমায় আগে নিও না ঠাকুর। তাহলে ওকে কে দেখবে । অসহায় একাকিত্ব, মৃত্যুর চেয়েও অন্ধকার। দয়াকর করুণাময় , গনশার মাকে নিয়ে নাও। আমি না হয় তার পিছু পিছু যাবো। শুধু এইটুকু দয়া করো।
ঈশ্বরের কাছে এমন প্রার্থনা কেউ জানাতে পারে , তা বোধকরি ঈশ্বরেরও অজানা।

রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে হাজার হাজার গনশার দল।ভোলে বাবা পার করেগা।
গভীর রাত। দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। গনশার মা পঙ্গু । উঠে দাঁড়াতে পারে না। গনশার বাপ নেহাৎ অনিচ্ছায় দরজা খুলে দিলো। অবাক । একি তুমি? সামনে কেতোর বাপ। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। গলার স্বর আরও বেশি কাঁপছে।
ওরে, তোর ছেলে গনশা মরে গেছে রে।
জাগ হাঁড়ির মধ্যে প্রদীপের শিখা যেমন নিশ্চল অকম্পিত থাকে , গনশার বাপ তেমনই স্থির অবিচল রইলো।
মন্দিরের কাছে প্রবল ভীড়ের চাপে গনশা পড়ে যায়। তার গায়ের উপর দিয়ে চলে যায় হাজার হাজার পা। পায়ের তলায় চাপা পড়ে দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে গনশা।
অন্ধকার ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা করুণ মেয়েলী স্বর ভেসে এলো ।
ওরে গনশা রে…

মায়ের বুক ফাটা কান্না একাদশীর চাঁদও সহ্য করতে না পেরে , কালো মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো।
কেঁদো না, গনশার মা । সে তো আমাদের কাছে বেঁচেই মরে ছিল। আজ না হয় সত্যিই মরে গেল।
ভোলে বাবা পার করে দিয়েছে গো , পার করে দিয়েছে।
হে ভোলানাথ , আমার শেষ ইচ্ছেটাও পুরণ করে দাও অমরনাথ। গনশার মাকে গনশার সঙ্গে মিলিয়ে দাও ঠাকুর মিলিয়ে দাও।
এখন আমরা তিন জনই বড়ো একলা , বড়ো একলা।

Exit mobile version