আত্মার ধর্ম
– সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)
বিয়ের পর কেটে গেছে,পাঁচটা বছর। সুস্মিতা মা ডাক শোনার জন্য বড় আকুল। শাশুড়ি,শ্বশুর সর্বক্ষণ বলে চলেছেন “আমাদের ছোট্ট সোনার মুখ দেখাও”। ডাক্তারি পরীক্ষায় সুস্মিতার কিছু ত্রুটি ধরা পড়লো। সুস্মিতা সারাটা দিন মনমরা হয়ে থাকে। পুতুল নিয়ে খেলা করে। একদিন এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সে ও তার বর তন্ময় একটি অনাথ আশ্রম ঘুরতে যায়। কত মিষ্টি মিষ্টি শিশু খেলে বেড়াচ্ছে। সুস্মিতার মনে হয়, যদি তারা একটি শিশুকে দত্তক নেয়, শিশুটি মা বাবা পাবে আর ও পাবে চির আকাঙ্খিত মাতৃত্বের স্বাদ। আশ্রম কর্তৃপক্ষর সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা। কর্তৃপক্ষ বলে ব্যাপারটা একটু সময়সাপেক্ষ। কিছু অফিসিয়াল কাজকর্ম আছে এবং কোন শিশু তারা পাবে সেটা আশ্রম কর্তৃপক্ষই ঠিক করবে।
বাড়িতে জানালে, তন্ময়ের মা ঘোর আপত্তি জানায়,বলেন জাত কূল জানি না এমন শিশু কিছুতেই এ বাড়িতে আসতে পারে না। সুস্মিতার শ্বশুর কিন্তু রাজী হয়ে জান। বলেন একটি শিশুর কলতান এই বাড়িকে ভরিয়ে তুলবে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? যাও শিশুটিকে নিয়ে এসো,মুনিয়া (তন্ময়ের মা)কে বোঝানোর দায়িত্ব আমার।
আশ্রম তাদের একটা ছোট পুত্র সন্তান দত্তকে অনুমোদন দেয়, আইনি কাজকর্ম সম্পন্ন করে শুভদিনে শিশুটিকে নিয়ে আসে সুস্মিতা ও তন্ময়। দু’জনের নামের সাথে মিলিয়ে শিশুটির নাম দেওয়া হয় সুতনু। অন্নপ্রাশন দেওয়া হয়। মিষ্টি ফুটফুটে বাচ্চাটা প্রতিবেশীদেরও খুব আদরের হয়ে যায়। কিন্তু মুনিয়া মানে সুস্মিতার শাশুড়ি কোনো ভাবেই একে মেনে নিতে পারেন নি।
একটু একটু করে বড় হতে থাকে সুতনু। হামাগুড়ি দেয়। হামা দিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। টুকটুক করে মুনিয়ার ঠাকুর ঘরে ঢোকে। ঠাকুরের জিনিসপত্রতে হাত দেয়। “আমার সব ঠাকুরের জিনিসপত্র অশুচি করলো রে!” চিৎকার করে ওঠেন উনি। “বৌমা একে সরাও তাড়াতাড়ি।” সুস্মিতা রান্না করতে করতে ছুটে আসে। টলমল পায়ে হাঁটা শুরু হয় পুঁচকেটার। সারাবাড়ির জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করে। যা পায় কুড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে। পাড়ার দিদি দাদারা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাকে। গোলগাল মিষ্টি মিষ্টি সুতনু সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। এবার ভালভাবে ঠাকুরঘরে ঢুকতে শুরু করে,
নকুলদানা আর বাতাসার লোভে। ঠাকুর সিংঘাসনে গোপালকে দেওয়া প্রসাদ খেয়ে নেয় বলে“পীপী খেয়েছে”। পিঁপড়েকে পীপী বলে ও। মুনিয়া চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে। “হয় এই ছেলে এই বাড়ি থাকবে, নয় আমি! দিয়ে আয় যেখান থেকে এনেছিস।” সুস্মিতা বুকে নিয়ে ছেলে আগলায়। এ যে তার চোখের মণি। এর মা ডাকই তো তাকে ভরিয়ে রাখে।
“দেখো কী কাণ্ড করেছে, সিংহাসন থেকে গোপালকে নামিয়ে কোলে বসিয়ে বাতাসা খাওয়াচ্ছে আর নিজেও খাচ্ছে, আমার ঠাকুরকে এঁটো খাওয়াচ্ছে.. গেল, গেল, আমার সব গেল, নাম হতচ্ছাড়া” গঙ্গাজল ছিটাচ্ছে চারিদিকে মুনিয়া। “ঠাকুর দোষ নিওনা দোষ নিওনা” বার পঁচিশেক বললো মুনিয়া। রেগে ঠাকুর ঘর তালা দেওয়ার কথা ভাবলো।
যেদিন সুতনুকে অনাথ আশ্রম থেকে আনা হয়েছিল, সেই দিনটিই তার জন্মদিন হিসাবে পালিত হয়। দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল। জন্মদিনে বাড়ি হৈচৈ মুখর। মাসি, পিসি, জেঠি, কাকি, কাকু, মামা সবাই হইহই করছে। আসন পেতে বসিয়ে সবাই আশীর্বাদ করছে। কত খেলনা। খুব মজা সুতনুর। “থাম্মি ছবাই তো আছির্বাদ করছে, তুমি কলো”। “না না তোকে কীসের আশীর্বাদ রে!জাতকূল জানিনা,ছোঁবোই না তোকে।”
শিশুটা শুধু বারবার ঠাকুর ঘরে গিয়ে দুষ্টুমি করে। আর রাগত মুনিয়া গালাগালি করে। আজ কয়েকদিন হ’ল সুতনুর জ্বর। তাপ যথেষ্ট বেশী। চুপ করে বিছানায় পরে আছে। কিছু খেতে চাইছে না। রান্না করতে করতে বারবার সুস্মিতা ছেলেকে দেখতে আসছে। কিন্তু এটা কি দেখছে সুস্মিতা? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার শাশুড়ি মুনিয়া সুতনুকে কোলে নিয়ে বসে মাথায় হাত বুলোচ্ছেন। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। আস্তে আস্তে কি সব যেন বলছেন শিশুটিকে। সুস্মিতা তার শ্বশুরকে ডেকে আনে। শ্বশুর কাছে গিয়ে দেখেন মুনিয়া বলছেন,“সোনা আমার তাড়াতাড়ি সুস্থ হও গোপালের প্রসাদ খেতে হবে তো?”
যে কটা দিন ছোট্ট সুতনু অসুস্থ ছিল, ঠাকুর ঘরে ঢোকেনি, মুনিয়ার বড় ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে। সে নিজেও বোঝেনি, মনের দিক থেকে কি ভীষণ ভাবে সে শিশুটার সঙ্গে জড়িয়ে পরেছে। গোপালের প্রসাদ থালাতেই পড়ে থাকছে, মুনিয়ার মনে হচ্ছিল, তার দেওয়া প্রসাদ বোধহয় সুতনুই গোপাল হয়ে খেয়ে যেত। সারাটা ঘর ঘুরে বেরাতো পুঁচকেটা। ঘর বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। স্নেহ অতি ভীষণ বস্তু। স্নেহের বাঁধনে কখন বাঁধা পরে গেছে মুনিয়া। মানবমনের গতি বড় বিচিত্র। কখন তার গতি কিভাবে বদলে যায়, মানুষ বোধ হয় নিজেও বুঝতে পারেনা। তন্ময় ডাকলো “মা তোমার পুজোর সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে, দাও ওকে আমার কোলে, তোমার গোপাল কিন্তু অভুক্ত আছে।”
“ও আজ আমার কোলেই থাকবে, বৌমা গোপালকে আজ তুমি খেতে দাও আমাকে আমার জীবন্ত গোপালকে নিয়ে থাকতে দাও, হে আমার ঈশ্বর তোমাকে প্রসাদ পেতে গেলে আগে আমার এই গোপালকে সুস্থ করতে হবে, ও প্রসাদ খেলেই আমার পুজো সার্থক।”
তন্ময় ও সুস্মিতা দু’জনেরই প্রাণের দেবতা মনের লেখক রবিঠাকুর। তাঁর লেখা অনধিকার প্রবেশ গল্পটা মনে পড়লো। যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তরে জাগ্রত মানবধর্মের চেয়ে বড় বোধ হয় আর কিছু নেই। সত্যিই সত্যি বড়ই সত্যি একথা।