নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো
প্রলয় কুমার নাথ
(১)
এই কাহিনীর পটভূমি হল ব্রিটিশ শাসনকালে অবিভক্ত বঙ্গদেশে মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত একটি জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট গ্রাম, নাম নারায়ণগঞ্জ। কয়েকশো ঘর প্রজা এবং স্থানীয় জমিদারের পরিবারটি নিয়ে সুজলা সুফলা এই গ্রামে সুখ শান্তি এবং সমৃদ্ধি ছিলো সর্বদা বিরাজমান। সেই সময় অখিলেশ চৌধুরী ছিলেন জমিদার বাড়ির কর্তা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং দানশীল ব্যক্তি, তাই প্রজাদের মধ্যে ছিলো না কোনো দুঃখ কষ্ট। সেই যুগেই অখিলেশ বাবু ছিলেন নারীশিক্ষার পক্ষে, তাই তার একমাত্র কন্যাসন্তান, মণিমালার গ্রামের স্কুলের গন্ডি পার হয়ে গেলে, তিনি তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা পাঠিয়েছিলেন।
কলকাতার কলেজে বিদ্যার্জনের সময় থেকেই মণিমালার আলাপ হয় তার এক সহপাঠী সুদর্শন যুবকের সাথে, নাম শুভময় ব্যানার্জী। স্থানীয় এক উচ্চবিত্ত পরিবারের এই একমাত্র বংশধরটি খুব ছোটবেলাতেই নিজের মা বাবাকে হারিয়েছিলো। ক্রমে মণিমালার সাথে শুভময়ের সম্পর্ক প্রণয়ের রূপ নিতে থাকে, এবং তারা বিবাহ করবার সিদ্ধান্ত নেয়। অখিলেশ বাবুরও শুভময়কে জামাই হিসাবে খুব পছন্দ হয়, তাই খুব ধুমধামের সাথে তিনি চার হাত এক করার ব্যবস্থা করেন। বর্তমান সময়ে বিয়ের পর এই প্রথম বার শুভময় কিছুদিনের জন্য তার শ্বশুরালয়ে এসেছে, নারায়ণগঞ্জ গ্রামে। তাই জমিদার বাড়িতে আনন্দ উৎসব এবং নতুন জামাইকে দেখার জন্য গ্রামবাসীদের ভিড় লেগেই আছে।
সেদিন সকালে মণিমালা তার স্বামীর জলখাবারের জন্য সবে আসন পেতে লুচির পাত্রটি সামনে রেখে তাকে ডাকতে যাবে, এমন সময় বাড়ির উঠোনে কেমন যেন একটা কোলাহলের আওয়াজ শুনে চঞ্চল হয়ে উঠলো তার মন। কৌতূহলী হয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সে নিচে নেমে দেখলো, সেখানে বাড়ির সকলেই উপস্থিত, এমনকি শুভময়ও। সকলের আকর্ষণের কেদ্রবিন্দু হল এই বাড়ির এক কাজের মেয়ে, হৈম। গায়ের রং কালো হলেও এই আঠেরো বছরের যুবতীটির দৈহিক গঠন বেশ আকর্ষণীয়। সে যেন হন্তদন্ত হয়ে চিৎকার করে জমিদার গিন্নির উদ্দেশ্যে বলে চলেছে, “না গো কত্তামা, কত্ত খোঁজা হল তাকে!…পাশের জঙ্গলের ভেতর, দীঘির ধারে, নদীর পারে, ধানক্ষেতের মাঝে, এমনকি আশপাশের দু-একটা গাঁয়েও লোক পাঠানো হয়েছিলো…কিন্তু কোত্থাও পাওয়া গেল না তাকে!”
মণিমালা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কার কথা বলেছিস তুই হৈম? কাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”
হৈমর হয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে তাকে উত্তর দিলেন স্বয়ং অখিলেশ বাবু, “আমার এক প্রজা শিবেনের বউ প্রতিমাকে! কাল সন্ধ্যের পর থেকে নাকি তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
“সে কি!” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো মণিমালা, ঠিক এমনই সময় তার চোখ গেল তার স্বামী শুভময়ের দিকে। সে যেন হাঁ করে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে হৈমর দিকে। এটা দেখে খুব অস্বস্তি লাগলো মনিমালার, কারণ তার বুঝতে বাকি রইলো না যে শুভময়ের মন প্রতিমার নিখোঁজ হওয়ার খবরের দিকে নেই, সে যেন হৈমর শরীরটাকে পা থেকে মাথা অবধি জরিপ করতেই ব্যস্ত।
কিন্তু হৈম বোধহয় তা আন্দাজ করতে পারেনি, সে সরল মনে বলেই চলল, “খুব অভাগী ছিলো প্রতিমা দিদি, জানেন তো কত্তামা। শিবেন দাদার সাথে বিয়ের দু’বছর ঘুরতে চললো, এদিকে এখনো ওদের কোনো বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি…এই নিয়ে সারাদিন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কথা শোনাতো ওকে, বলতো নাকি ওর শরীরে খুঁত আছে, ও বাঁজা! সেই দুঃখেই কি ঘরছাড়া হল প্রতিমা দিদি!”
“আহা রে!” বলে উঠলেন জমিদার গিন্নি, “আমার তো মনে হয়, দোষ ওর কিছু নেই! অমন তালপাতার সেপাই-এর মত চেহারা শিবেনটার, দেখলেই মনে হয় দোষ যদি কিছু থাকে তা শিবেনের, প্রতিমার নয়!”
শুভময় এখনো কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে হৈমর দিকে। আর সহ্য হল না মণিমালার, সে কোনরকমে এই কথোপকথনের ইতি টেনে, জলখাবারের অছিলায়, হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো শুভময়কে নিজের ঘরে। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে, ক্রোধে ঈর্ষায় ফেটে পড়ে, শুভময়ের সামনে এক ঝটকায় নিজের শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে দিলো নিজের সেমিজ পরিহিত সুডৌল স্তনযুগলের ওপর থেকে। তারপর চিৎকার করে বলে উঠলো, “নাও দেখো, চোখ ভরে দেখো…কার শরীরটা বেশি সুন্দর বল…আমার না হৈমর? ছি ছি, বাড়ির জামাই হয়ে লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে একটা কাজের মেয়েকে দেখে অমন ভাবে চেয়ে থাকতে পারলে তুমি!”
শুভময় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলো মণিমালার এই ব্যবহারে, সে দুই একবার ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করলো, “না না মণি…আমি তো…আমি তো শুধু…” কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও যেন সেটা তার মুখে এলো না!
(২)
রাতের অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে গোটা নারায়ণগঞ্জ গ্রাম। কোনো ঘরেই জ্বলছে না কোনো কুপির আলো, ভেসে আসছে না কোনো মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ। শুধু মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে গ্রামের রাস্তায় ঘোরা কুকুরগুলো বা পেছনের জঙ্গলে নৈশভোজে ব্যস্ত শেয়ালগুলোর ক্রন্দনধ্বনি। গ্রামের একপ্রান্তে অবস্থিত একটি মাটির বাড়ির দরজা ঠেলে অতি সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো এক যুবতী। চাঁদের হালকা আলো এসে পড়লো তার দুই চোখের ওপর, যা এই মুহূর্তে গাঢ় রক্তবর্ণ রঙ ধারণ করেছে। যেন কোনো অকল্পনীয় অমোঘ আকর্ষণের বশীভূত হয়ে সে তীব্র গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো গ্রামের শেষ প্রান্তে, শ্মশানের রাস্তা ধরে।
মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে কোনো রাতপাখির কর্কশ ডাক, সাথে যুবতীর পায়ের নুপুরের মৃদু নিক্কন ধ্বনি। শ্মশানে যেন তার জন্যই এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল এক দীর্ঘদেহি পুরুষ! তার কাছে আসতেই যুবতী নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরলো পুরুষটির দেহটিকে, তার নিঃশ্বাসের গতিবেগ হল আরো দ্রুত। শ্মশানের ছাইভস্মে ভরা মাটির ওপর খসে পড়তে লাগলো যুবতীর শাড়ি এবং সকল অন্তর্বাস। রাতের অন্ধকারের মধ্যে মিলেমিশে এক হয়ে গেল দু’টি শরীর। নারীর শরীরের ওপর বিচরণ করে শুরু হল পুরুষের চিরাচরিত পরিশ্রম। দু’জনের মৃদু সুখপ্রাপ্তির শব্দে মুখরিত হল শ্মশানের আকাশ বাতাস।
“কত্তাবাবুউউউ…”
পরদিন সকালে গ্রামের জেলে হারান পালিতের এই মর্মভেদী কণ্ঠস্বরে সচকিত হয়ে বাড়ির উঠানে ছুটে এলেন অখিলেশ বাবু। মাছ ধরার জাল এবং সকল সরঞ্জাম মাটিতে ফেলে তখন বিস্ফারিত চোখে হাঁপাচ্ছে হারান। ততক্ষণে বাড়ির বাকি সকলেও ছুটে এসেছে উঠোনে।
“কি রে হারান…অমন করছিস কেন… কি হয়েছে?” বলে উঠলেন অখিলেশ বাবু।
“বাবু…বাবু গো…আজ সকালে নদীতে যাচ্ছিলাম মাছ ধরার জন্য। শ্মশান দিয়ে গেলে অল্প সময়ে লাগে, তাই সেদিক দিয়ে চলেছিলাম”, কম্পিত গলায় বলতে শুরু করলো হারান, “কিছুটা গিয়েই সেখানে একটা ঝোপের পাশে দেখলাম আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়েটা পড়ে রয়েছে…কি যেন নামটা…হ্যাঁ, হৈম! শরীরে একটা সুতো অবধি নেই!…হৈম আর বেঁচে নেই বাবু, কেউ ওর সুখ নিয়ে ওকে মেরে ফেলেছে কাল রাতে!” আতঙ্কে থরথর করে কেঁপে উঠলো হারানের সর্বশরীর।
সেখানে উপস্থিত বাড়ির সকলের মাথার ওপর যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে গেল।
(৩)
প্রতিমার নিরুদ্দেশ হওয়া এবং হৈমর এই নিদারুণ পরিণতির জন্য যেন আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা গ্রামে। এর মধ্যেই এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে, কিন্তু স্থানীয় থানা থেকে অপরাধীর সনাক্তকরণের বিষয়ে এখনো কিছুই জানানো হয়নি। তবে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য ইতিমধ্যেই পেয়েছে গ্রামের মানুষ, সেটা হল যে হৈমর শরীর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে তাকে কিন্তু ধর্ষণ করা হয়নি। সেই রাত্রে সে নিজের ইচ্ছায় কোনো পুরুষের সাথে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে, এবং তারপর তাকে গলা টিপে খুন করা হয়েছে!
হৈমর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই, পরের সপ্তাহে এই অনুরূপ আরেক যুবতীর হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক জোরালো হয়েছে নারায়ণগঞ্জ গ্রামে। এই গ্রামে সুশীল নাপিতের বহু পুরুষের বাস। তার স্ত্রী বাতাসীকে গ্রামের সকলেই চেনে। নাপিত পরিবারের অন্যান্য স্ত্রীলোকদের থেকে একটু বেশিই সুশ্রী সে। সেদিনও সে জমিদার বাড়িতে এসেছিলো বাড়ির মহিলাদের নখ কেটে পা ঘষে আলতা পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। হৈমর মত সেও যে শুভময়ের নজরে পড়েছে, এটাও টের পেয়েছে মণিমালা!
কিন্তু তখন কি আর কেউ বুঝেছিলো, যে সেই হবে এই গ্রামের ‘নারীখেকো’-র পরবর্তী শিকার। পরদিন সকালেই তারও সম্ভোগ করা মৃত শরীরটা আবিষ্কৃত হয়েছে গ্রামের পেছনের জঙ্গলের ভেতর থেকে। স্থানীয় এক কাঠুরে প্রথম দেখতে পায় বাতাসীর নগ্ন মৃতদেহটিকে, এবং সেই কথা জানায় জমিদার বাড়িতে। এই ক্ষেত্রেও পুলিশের একই বক্তব্য, বাতাসী স্বেচ্ছায় কোনো পুরুষের সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়েছে, অতঃপর তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে!
দেখতে দেখতে কেটে গেল আর একটি সপ্তাহ। তবে এখনো ‘নারায়ণগঞ্জের নারীখেকো’-র কোনো সন্ধান পায়নি পুলিশ। নায়েব মশাই-এর মেয়ে কল্পনা মণিমালার ছোটবেলার বান্ধবী। খুব অল্প বয়সেই পাশের গাঁয়ের এক ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলের সাথে বিবাহ হয় তার। তার স্বামী আপাততঃ কলকাতার কলেজে ডাক্তারি পাঠরত। মণিমালা আর শুভময়ের আসার খবর পেয়ে, ছেলেবেলার বান্ধবী এবং তার স্বামীর সাথে দেখা করতে বাপের বাড়ি এসেছে কল্পনা। পরীক্ষা এবং পড়াশোনার চাপে তার স্বামী আসতে পারেননি। তবে গ্রামে ফিরে এখানে ঘটে চলা নারীহত্যাগুলির কথা শুনে সেও যথেষ্ট ভীত-ত্রস্ত।
জমিদার বাড়ির বৈঠকখানায় সকলের সাথে কথা হচ্ছিলো কল্পনার। শুভময়ের সাথে তার আলাপ আগেই হয়েছে। তবে এই আনন্দের মুহূর্তগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা বিভীষিকা দানা বেঁধে আছে সকলের মনে। কল্পনা অখিলেশ বাবুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, “আসলে উনি বলছিলেন, যে এই গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করা উচিত। আপনার কাছে সেই বিষয়ে পরামর্শ চাইতে বলেছিলেন, কাকাবাবু।”
অখিলেশ বাবু হেসে বললেন, “এতো অতি উত্তম প্রস্তাব। তুমি শুধু তাকে বোলো ডাক্তারিটা ভালোভাবে পাশ করে ফিরতে, বাকি সকল ব্যবস্থা আমিই করে দেবো…”
এমন নানা কথার মাঝে, আবার মণিমালার চোখ চলে গেল শুভময়ের দিকে। এবারও সে যেন নিজের দৃষ্টি দিয়ে গোগ্রাসে গিলে খেতে চাইছে কল্পনাকে। স্বামীর এই চরিত্রহীনতা যেন দিনে দিনে অসহনীয় হয়ে উঠছিলো মণিমালার কাছে। সেই মুহূর্তে সে অন্য কাজের অছিলায় বৈঠকখানা থেকে প্রস্থান করলো। শুভময়ও বোধহয় বিষয়টি আন্দাজ করেছিলো, তাই সেও উঠে এলো তার স্ত্রীর পিছু পিছু। মণিমালা আর নিজের মুখে কিছু বললো না শুভময়কে, তবে গোটা দিনটা যেন গুম মেরে রইলো তার প্রতি।
শেষ রাত্রের ঘুমটা একটু পাতলা হয়ে এসেছিলো মণিমালার চোখ থেকে। খুট করে বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দে পুরোপুরি ঘুম ভেঙে গেল তার। সে বিছানায় উঠে বসে অবাক হয়ে দেখলো, যে তার পাশে শুভময়ের শোবার জায়গা ফাঁকা! এমন সময় এই ঘরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে কার যেন ওপরে উঠে আসার পদশব্দ শোনা যাচ্ছে! ওপরে এসে সে যেন এই ঘরের দিকেই ক্রমাগত এগিয়ে আসছে! সাত পাঁচ ভেবে, মণিমালা তৎক্ষণাৎ বিছানায় নিজের জায়গায় শুয়ে ঘুমানোর অভিনয় করতে লাগলো। কপালের ওপর হাত রেখে তার ফাঁক দিয়ে আধবোজা চোখে তাকিয়ে রইলো ঘরের দরজার দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শরীরে সেই ঘরে প্রবেশ করলো শুভময়। সে ঘরে প্রবেশ করে আলতো করে পালঙ্কে উঠে শুয়ে পড়লো নিজের জায়গায়। কৌতূহল আর উত্তেজনায় ঘুম আসছিলো না মণিমালার চোখে। এমন সময় জানলা থেকে একটি দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে উড়িয়ে দিলো ঘুমন্ত শুভময়ের পিঠের ওপর থেকে চাদরখানি। চাঁদের আলোয় সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো মণিমালা। শুভময়ের পিঠ এবং ঘাড়ের চারিপাশে বেশ কিছু স্থান কেটে ছড়ে গিয়েছে। খুব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে এর কারণ হল কোনো মেয়েমানুষের নখের আঁচড়!
(৪)
পরের দিন সকাল বেলায় আবার গোটা গ্রামের ওপর যেন নেমে এসেছে শোকের কালো ছায়া। নায়েব মশাই-এর মর্মভেদী চিৎকারের মাঝে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জমিদার বাড়ির সকল সদস্য। তার কারণ, গতকাল রাত্রে এই গ্রামের অজানা নারীভুকের কাম-পিপাসার শিকার হয়েছে তার একমাত্র মেয়ে কল্পনা। আজ ভোরে প্রাতঃক্রিয়া সারার জন্য পুকুরপারে যায় গ্রামের জনৈক ব্যাক্তি। সেই সেখানে সর্বপ্রথম খুঁজে পায় কল্পনার বস্ত্রহীন মৃতদেহটি। এই ক্ষেত্রেও সে নিজেই গভীর রাতে বাড়ি থেকে বার হয়ে যায় আততায়ীর সাথে সঙ্গমের ইচ্ছা নিয়ে। শরীরী খেলা মিটে যাওয়ার পর তাকেও হৈম এবং বাতাসীর মত গলা টিপে হত্যা করে আততায়ী!
নায়েব মশাই জমিদার বাড়ির একটি থামের সাথে মাথা কুটতে কুটতে উন্মাদের ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠলেন, “কত্তাবাবু, যেভাবেই হোক এই শয়তানকে ধরার ব্যবস্থা করুন…তাকে শাস্তি দিন, কত্তাবাবু…শাস্তি দিন তাকে…”
এই পরিস্থিতি যেন আর সহ্য হচ্ছিলো না মণিমালার। সে শুভময়ের হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে এলো নিজের ঘরে। তারপর সশব্দে ঘরের দরজা বন্ধ করে তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো, “আমি জানি এইসবের পেছনে তোমার হাত আছে, শুভময়!…কারণ কাল রাতেই আমি তার প্রমাণ স্বচক্ষে দেখেছি!…ছি! ভাবতেই লজ্জা লাগছে আমার, যে আমি তোমার মত একজন নিকৃষ্টতম অপরাধীকে একদিন ভালোবেসেছি!…তবে আর নয়, আমি নিজেই তোমার অপরাধের কথা সকলকে বলবো, তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে নিজেই মুছবো নিজের সিঁথির সিঁদুর…”
কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মণিমালা। অত্যন্ত শান্ত অবিচলিত কণ্ঠে বলে উঠলো শুভময়, “হয়তো তোমাকে সব কিছু খুলে বলার সময় চলে এসেছে, মণি! তুমি কি ভাবছো, যে হৈম, বাতাসী আর কল্পনা…এদের দিকে আমি চেয়ে থাকতাম কারণ তাদের দেহের প্রতি আমি আকর্ষণ অনুভব করতাম? নাহ্…এদের দিকে আমি চেয়েছিলাম কারণ এই তিনজনেরই ওই নিদারুন পরিণতির আগের দিনগুলিতে এদের শরীরের চারিপাশে এক অতি-প্রাকৃত পিশাচিনীর ছায়া আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি!”
বিস্ফারিত চোখে শুভময়ের দিকে চেয়ে রইলো মণিমালা। সে বলেই চললো, “আমার জীবনের কয়েকটা কথা তোমার কাছ থেকে গোপন করেছিলাম আমি, তবে আজ সব কিছু খুলেই বলবো। তুমি তো জানো, যে খুব ছোটবেলায় আমি মা বাবাকে হারাই। আমি যেন ঠিক মেনে নিতে পারলাম না তাদের মৃত্যুটা। মরণের পরও তাদের নিজের কাছে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। তাই গোপনে যোগাযোগ করেছিলাম একজন তান্ত্রিকের সাথে। তার সাহায্যেই সিদ্ধ হয়েছিলাম নানা তন্ত্রবিদ্যায়। তবে এতে মা বাবার আত্মার সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছা ব্যর্থ হলেও, আমার মধ্যে জন্মেছিলো অশুভ অতি-প্রাকৃত শক্তিদের প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, যারা কোনো কারণ বশতঃ এই ইহলোক থেকে মুক্তি প্রাপ্ত হয়নি!”
“তাই সেদিন যখন বুঝলাম যে প্রতি সপ্তাহে এক একটি যুবতী ওই আততায়ীর শিকার হচ্ছে এবং এবার কল্পনার পালা, আমি গতকাল রাতে ঘুমোতে পারলাম না। নায়েব বাড়ি এই মহলের অনতিদূরেই, তাই তুমি ঘুমোবার পর বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নজর রাখছিলাম সেই দিকে। দেখলাম যে সঠিক সময়ে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো কল্পনা। আমি ছুটে গিয়ে তার পিছু নিলাম। তার পথ আগলে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললাম।”
“কিন্তু সেই মুহূর্তে তার শরীরটা সম্পূর্ণরূপে সেই অজানা অশরীরির কবলে। খোলা চুল, রক্তবর্ণ নিষ্পলক দৃষ্টি, মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে একটি চাপা গর্জনের আওয়াজ…কল্পনার এই রূপ আমি কখনো দেখিনি। সে অকল্পনীয় পৈশাচিক শক্তি দিয়ে আমায় দূরে ঠেলে ফেলে দিলো। মাথায় চোট পেয়ে জ্ঞান হারালাম আমি। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে উপলব্ধি করলাম যে পিঠে এবং ঘাড়ের চারিপাশে অসহ্য যন্ত্রনা। বুঝতে পারলাম আমায় না মেরে, শুধুমাত্র আমার শরীরে নখের আঁচড় দেওয়ার পেছনে কল্পনার শরীরে ভর করা এই পিশাচিনীর একটাই উদ্দেশ্য…সকলের সন্দেহের দৃষ্টি আমার দিকে আনা!”
মন্ত্রমুগ্ধের মত স্বামীর কথাগুলো শুনছিলো মণিমালা, এবার অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো, “তার মানে কোন গুপ্ত তন্ত্রবিদ্যার সাহায্যে ওই অশরীরিকে প্রবেশ করানো হচ্ছে এক একটি মেয়ের শরীরে, যাতে তারা নিজেই শয়তানটার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়! কিন্তু কে করছে এই কাজ? আর এটা কি ধরণের তন্ত্রসাধনা?”
“কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি, মণি…আজকের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছি!” দৃঢ় কণ্ঠে বললো শুভময়।
(৫)
শুভময়ের পা ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো শিবেন। তাদের চারিপাশে চারজন শক্ত-সামর্থ চেহারার লেঠেল দাঁড়িয়ে। তাদের প্রহারে শোচনীয় অবস্থা শিবেনের। সে চিৎকার করে বলে উঠলো, “ক্ষমা করে দিন…ক্ষমা করুন আমায় ছোট বাবু। আমি গ্রামের সকলের কাছে মিথ্যা কথা বলেছিলাম, যে প্রতিমা নিখোঁজ হয়েছে। আসলে আমার শরীরে খুঁত ছিলো, ছোট বাবু…বিছানায় কখনই সুখ দিতে পরিনি আমি প্রতিমাকে।”
“এদিকে ও সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও ওর মাথায় আসছে বাঁজা হওয়ার অপবাদ, তাই সেই রাত্রে ওর সাথে আমার খুব ঝগড়া বাঁধে। ও বলছিলো যে আর এই অপবাদ নিজের ঘাড়ে নেবে না, সকলকে জানিয়ে দেবে আমার নপুংসক হওয়ার কথা। তাই বাধ্য হয়েই ওকে গলা টিপে খুন করি আমি সেই রাত্রে! তারপর নদীর জলে ভাসিয়ে দিই ওর লাশটাকে। সকালে ও নিখোঁজ বলে সকলের সামনে মায়া কান্না কাঁদি…কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ওর লাশটাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি!”
“যাও গিয়ে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দাও”, লেঠেলদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলো শুভময়। ওরা শিবেনকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল, শুভময়ের মুখে ছেয়ে গেল চিন্তার রেশ।
সেদিন ছিলো গ্রহণের রাত্রি। শ্মশানের এক কোণে, একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে একাকী ডাকিনী সাধনায় বসেছে শুভময়। শ্মশানের ভূমির বেশ কিছুটা স্থানের জঙ্গল সাফ করে গোবর জল লেপে দেওয়া হয়েছে। একটি কালো কাপড় পেতে তার ওপর মাটির পাত্রে রাখা হয়েছে ছাগলের টাটকা কলিজা এবং মাংস। অপর একটি পাত্রে আছে সুগন্ধি দেশি মদ। ধুপ-ধুনোর সাথে ছাগলের চর্বির তেল দিয়ে জ্বালানো হয়েছে প্রদীপের মিটিমিটি আলো। অন্ধকার রাত্রে দক্ষিণ দিকে মুখ করে সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে ডাকিনী মন্ত্র জপ করছিলো শুভময়, তার কপালে সিঁদুরের তিলক, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা।
নিস্তব্ধ রাতের মাঝে হঠাৎ একটি মৃদু নারী কণ্ঠে নিজের নামটি শুনে চমকে উঠলো শুভময়। চোখ খুলে দেখলো, যে একটি অপরূপ সুন্দরী নগ্ন নারী তার সামনেই শুয়ে আছে, মুখে মৃদু হাসি। ক্রমে উঠে দাঁড়ালো সেই নারী, ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো তার আরো কাছে। তার ঠাণ্ডি হাতের স্পর্শ পেলো শুভময় নিজের বুকে, পিঠে এবং পুরুষাঙ্গে। মেয়েটি হিসহিসিয়ে বলে উঠলো, “কিরে ভোগ করতে চাস না আমায়? আমি কি সুন্দরী নই…হাহাহাহা!”
তবুও বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে একমনে মন্ত্র জপ করতে লাগলো শুভময়। এবার একটি হাড় হিম করা আর্তচিৎকারে শুনতে পেলো সে। সেই সুন্দরী রমণী কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আশেপাশের শুকনো পাতার ওপর কাদের যেন পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তারা যেন দল বেঁধে শুভময়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। রাতের শ্মশান মুখরিত হয়ে উঠলো ক্রমাগত বিকট চিৎকারের আওয়াজে, সাথে ভয়ঙ্কর কিছু প্রেতমূর্তি একজোট হয়ে শুভময়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লো। সকলেরই রক্তবর্ণ জ্বলন্ত চোখ, অর্ধদগ্ধ কঙ্কালসার বীভৎস শরীর। তারা নিজের দুই হাত দিয়ে নিজেদের মুণ্ডুগুলিকে একটানে নিজেদের ধর থেকে ছিঁড়ে ফেললো, তারপর নিজেদের মস্তক হাতে করে কবন্ধগুলি গোল করে ঘুরতে লাগলো শুভময়কে ঘিরে। তবুও অপার সাহস বুকে করে মন্ত্র জপ করে চললো শুভময়।
কিছুক্ষণ পর সকল প্রেতমূর্তিগুলি যেন আগের মতই হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল। শুভময় চোখ খুলে দেখলো, যে তার সামনে একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ উলঙ্গ এলকেশী নারী দাঁড়িয়ে আছে। সে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনে রাখা মদ আর মাংসের দিকে। শুভময় বুঝতে পারলো যে অবশেষে ডাকিনী তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। সে ওই নারীকে মদ আর মাংস অর্পণ করলে, সে খুশি হয়ে বলে উঠলো, “তোর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়েছি আমি। বল, তোর জন্য কি করতে হবে আমায়?”
(৬)
গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে রাতের অন্ধকারে ডাকিনীর পিছু পিছু এগিয়ে চলছিলো শুভময়। অবশেষে তারা গ্রামের পুব কোণে একেবারে জঙ্গলের ধারে এসে পৌঁছলো। এই স্থানে খুব একটা জনবসতি নেই। ঝোপঝাড়ের মাঝে রয়েছে একটি মাত্র কুঁড়ে ঘর। তার ভেতর থেকে মিটিমিটি জ্বলছে কুপির আলো। সেই দিকে আঙুলের ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে গেল ডাকিনী। অতি সন্তর্পণে শুভময় এগিয়ে গেল সেই দিকে। এই বাড়ির মালিককে গ্রামের সকলেই চেনে, কারণ সে হল এই গ্রামের পাঠশালার বহুদিনের শিক্ষক, সুকুমার পন্ডিত। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়সের সুকুমার বহু বছর ধরে বিপত্নীক। রোগা কালো কুৎসিত চেহারার মানুষটি সকল গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধার পাত্র তার ছাত্র পড়ানোর দক্ষতার গুণে।
শুভময় কুঁড়ে ঘরটির পেছনের খোলা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ রাখলো ঘরের ভেতরে। ঘরের ভেতর খাটিয়ার ওপর বসে মদ্যপান করছে সুকুমার। খাটিয়ার নীচে মেঝের ওপর চোখ পড়তেই শিউরে উঠলো শুভময়। সেখানে রাখা রয়েছে একটি উলঙ্গ নারীর লাশ। পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে তার সর্বশরীরে লাগানো হয়েছে কোনো অজানা দ্রব্যের প্রলেপ। লাশটি আর কারোর নয়, শিবেনের মৃত স্ত্রী প্রতিমার!
ওদিকে মদের নেশায় অনর্গল বকে চলেছে সুকুমার, “কি ভেবেছিলিস তোরা? আমি কুৎসিত, বিপত্নীক, দরিদ্র…তাই কি আমার প্রেম করার কোনো অধিকার নেই? আমার মনে কি জাগতে পারে না নারীসঙ্গের লোভ? অনেক আশা করে তোদের তিনজনের কাছে এক এক করে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম আমি…কিন্তু তোরা আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিলি! আমায় অপমান করে বললি নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখতে! এত অহংকার তোদের!…এখন বুঝেছিস তো, তোদের কি অবস্থা করলাম আমি!…এখন বাকি রইলো শুধু একজন, সেও আমার প্রণয় নিবেদনকে অস্বীকার করেছিলো, পরের সপ্তাহে তার পালা…হাহাহা!”
পরদিন সকালে বাড়ি ফিরলে, মণিমালা উদগ্রীব হয়ে শুভময়ের কাছ থেকে জানতে চাইলো গতকাল রাত্রের সকল ঘটনা। শুভময় তাকে এক এক করে সব কথা বলে শেষে বলে উঠলো, “তন্ত্রশাস্ত্রে একটি ভয়ঙ্কর অনিষ্টকারী সাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা প্রয়োগ করেছে সুকুমার পন্ডিত। একে বলা হয় ‘কাম পিশাচিনী’ সাধনা!”
“যে সকল নারী পুরুষের দেওয়া শারীরিক সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েই কোনো অপঘাতে মারা যায়, তাদের আত্মার মুক্তি হয় না। পুরুষের সাথে সম্ভোগ করার অতৃপ্ত বাসনার ফলে তারা প্রেতযোনিতে প্রবেশ করে ‘কাম পিশাচিনী’-তে পরিণত হয়। এরা সর্বদা সেই অপেক্ষায় থাকে, কখন কোনো পুরুষ এই সাধনা করে এদের ডেকে পাঠিয়ে প্রবেশ করাবে অপর কোনো জীবন্ত নারীর শরীরে। এই প্রেতাত্মার প্রকোপে সেই নারী নিজের ইচ্ছায় নিজের শরীরকে তুলে দেবে সাধকের হাতে!…এই ক্ষেত্রে এই পিশাচিনী হল প্রতিমার অতৃপ্ত আত্মা, এবং সুকুমার তাকে একে একে প্রবেশ করিয়েছে হৈম, বাতাসী আর কল্পনার শরীরে! সে নিশ্চয় সাধনার জন্য প্রতিমার দেহটিকে সেই রাত্রে নদীর জল থেকে সংগ্রহ করেছিলো!…কিন্তু সহবাসের শেষে মুহূর্তের মধ্যে নারী শরীর থেকে কাম পিশাচিনী বিদায় নেয়, ফিরে আসে নারীর নিজস্ব সত্তা। তাই এই তিনজন যাতে সুকুমারের কীর্তিকলাপ সকলের কাছে ফাঁস করতে না পারে, তাই ভোগ করার পর এদেরকে একে একে খুন করেছে সুকুমার!…যতদিন প্রতিমার মরদেহ অবিকৃত থাকবে, ততদিনই সে সাধনার ফলে এই অপরাধ চালিয়ে যাবে!”
আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শুভময়ের দিকে তাকিয়ে কম্পিত গলায় বলে উঠলো মণিমালা, “সুকুমারকে তুমি পুলিশের হাতে তুলে দাও!”
“নাহ, আপাততঃ নয়”, বলে উঠলো শুভময়, “এই সপ্তাহের শেষেই ওর খেলা সমাপ্ত করার ব্যবস্থা করতে চাই আমি, শুধু জানতে হবে ওর চতুর্থ শিকার কে হতে চলেছে!”
(৭)
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে পরবর্তী ছয়টি দিন। কল্পনার মৃত্যুর পর আজ এক সপ্তাহ পূরণ হতে চলেছে। সেদিন সকালে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো মণিমালা। অদূরে আরামকেদারায় সকালের চায়ের কাপ হাতে বসেছিলো শুভময়। হঠাৎ সশব্দে কাপ সমেত চা নীচে পড়ে গেল শুভময়ের হাত থেকে। সচকিত হয়ে মণিমালা আয়নার সামনে থেকে চোখ সরিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, যে সে বিস্ফারিত চোখে আরষ্ঠ হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।
মণিমালা ছুটে আসতে গেল শুভময়ের কাছে, কিন্তু সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ে আরো দূরে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার কারণ, তার চোখে মণিমালা শুধু একা নয়, একটি কুচকুচে কালো অতি-প্রাকৃত অবয়ব যেন নিজের দুই বহু দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে মণিমালাকে! এ আর কেউ নয়, সেই কাম পিশাচিনী!
“আজ রাতে তুমিই হতে চলেছো সুকুমারের চতুর্থ শিকার, মণি!”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো শুভময়।
কিছুক্ষণ আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে রইলো মণিমালা, তারপর কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো, “এই কথা জানতাম আমি…শুধু চক্ষুলজ্জার খাতিরে তোমাকে বলে উঠতে পারিনি। বিয়ের কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে কিছুদিনের ছুটিতে এখানে আসার পর, পাঠশালার একটি বাচ্চার হাত দিয়ে সুকুমার আমাকে প্রেমপত্র পাঠায়! তাকে যে শুধু আমি অস্বীকারই করিনি, বরং তাকে এই বাড়িতে ডেকে বাবা চরম অপমান করেন। বলেন যে অন্য কারোর সাথে এমন কাজ করলে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দেওয়া হবে! এরই প্রতিশোধ নিতে চায় সুকুমার!”
কান্নায় ভেঙে পড়লো মণিমালা, শুভময় কুঞ্চিত ললাটে কি যেন ভেবেই চললো।
সারাদিনের চিন্তা-ভাবনার মাঝে মধ্যরাতে দুইচোখের পাতা এক হয়ে গিয়েছিলো শুভময়ের। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার তন্দ্রা কেটে গেল, যখন মনে হল যে মণিমালা তার পাশ থেকে উঠে অতি সন্তর্পণে দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে!
“দাঁড়াও, কোথায় যাচ্ছ তুমি?” চিৎকার করে উঠলো শুভময়।
মণিমালা তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো…সেই একই রক্তবর্ণ চোখ, হিংস্র চাহনি, খোলা চুল, ঠোঁটের কষ দিয়ে লালা ঝরছে, মুখ দিয়ে চাঁপা গর্জনের শব্দ!
“আমাকে যে যেতেই হবে তার কাছে…সে যে আমায় ডাকছে আমার দেহের আগুন নেভাবে বলে…আমাকে আটকানোর সাধ্য কোনো মনিষ্যির নেই!”, হুঙ্কার করে উঠলো মণিমালার শরীরে বসা পিশাচিনী।
“মানুষের সেই সাধ্য না থাকলেও ডাকিনীর তা আছে!” চিৎকার করে উঠলো শুভময়।
ঠিক সেই সময় সশব্দে খুলে গেল ঘরের দরজাটা, আর অন্ধকারের মধ্যে সেই কৃষ্ণবর্ণ এলকেশী নগ্ন নারীর অবয়বটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ঘরের ভেতর। তাকে দেখে চমকে উঠলো মণিমালা রূপী পিশাচিনী। তারপর একটি বিকট হুঙ্কার ছেড়ে ছুটে গেল তার কাছে। ডাকিনী নিজের ডান হাত প্রসারিত করে ধরে ফেললো মণিমালার গর্দন। শুরু হল দুই অতি-প্রাকৃত মানবীর মধ্যে অকল্পনীয় সংগ্রাম। তবে শুভময়ের পরিকল্পনাই সফল হল, কাম পিশাচিনীর থেকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন ডাকিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই মণিমালার শরীরটা তুলে ফেললো সম্পূর্ন শূন্যে। নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে, মণিমালার হাঁ করা মুখ দিয়ে কালো ধোঁয়ার মত বেরিয়ে এলো পিশাচিনীর প্রেতাত্মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের খোলা জানলা দিয়ে বিদায় নিলো সে। অতঃপর অদৃশ্য হল ডাকিনী। মণিমালার অচৈতন্য শরীরটা ঢলে পড়লো শুভময়ের কোলে।
পরদিন সকালে যখন জ্ঞান ফিরে এলো মণিমালার, তখন আবার জমিদার বাড়ির আঙিনা লোকে লোকারণ্য। আজ ভোরেও গ্রামের জঙ্গলের সীমানায় একটি ছিন্ন-ভিন্ন রক্তাত্ব মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এই লাশ কোনো যুবতীর নয়, তা হল গ্রামের সুপরিচিত সুকুমার পন্ডিতের! কেউই বুঝে উঠতে পারছে না যে কে তাকে এভাবে হত্যা করলো।
ওদিকে শুভময় মণিমালার কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো, “কাম পিশাচিনী সাধনার প্রধান শর্তই হল, যে প্রতি সপ্তাহে এক দিন করে এই পিশাচিনীকে কোনো না কোনো নারীর দেহে প্রবেশ করিয়ে, সাধককে তার সাথে সহবাস করতে হবে। কোন একটি সপ্তাহে তা কোনো ভাবে না করতে পারলে, সাধকের শর্তভঙ্গের অপরাধের শাস্তি হিসেবে এই পিশাচিনীই হবে সাধকের হত্যাকারিণী!…যা এই ক্ষেত্রে ঘটেছে!”
একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মণিমালা আঁকড়ে ধরলো তার স্বামীর সুঠাম বুকের ছাতিটাকে।
(সমাপ্ত)
খুব ভাল লাগল
ধন্যবাদ