গল্প- অবশেষে

অবশেষে
– বিশ্বদীপ মুখার্জী

 

ছাদে এক কাঠের বেঞ্চিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনছিল বিউটি। অজস্র তারায় ছেয়ে আছে সমস্ত আকাশটা। এই অসংখ্য তারার মাঝেই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে তার মা। ছোট বেলায় তাকে মা বলতো, যে মারা যায় সে আকাশের তারা হয়ে যায়। এই ধারণাটাই তার মনে বাসা বেঁধে নিয়েছিল। ইচ্ছে আছে আজকের রাতটা ছাদেই থেকে যাওয়ার। কি জানি, কেন আজ বহু পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে আসছে? কিছু ভালো স্মৃতি, কিছু মর্মান্তিক। যত দিন মা ছিল, জীবনটা বেশ সুন্দর গতিতে এগোচ্ছিল। কিন্তু সে আর কত দিন? তখন কতই বা বয়স হবে তার? প্রায় দশ বছর। মায়ের স্নেহের ছায়া থেকে চিরকালের মত বঞ্চিত হয়ে গেল সে। মাতাল বাপকে নিয়ে তার সংসার। বেঁচে থাকা যেন দুর্বিসহ হয়ে উঠছিল তার জন্য। একটু বড় হতে না হতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করতে পারলো সে। শুরুতে এই অনুভূতির বিষয় কিছুই বুঝতে পারতো না সে। সে জানতো না কেন পাড়ার বিল্টুদা’র সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে। বিল্টুর পাড়াতেই এক সাইকেল মেরামতের দোকান আছে। সুযোগ পেলেই ছুটে আসতো শ্রেয়ার কাছে।

এক অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে গিয়েছিল সে। হঠাৎ যেন সে সংবিৎ ফিরে পেল। কী তার আসল নাম? বিউটি না শ্রেয়া? সে কি সত্যিই নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে? এক মর্মান্তিক ইতিহাস। যেটা মনে না করাই ভালো। কিন্তু তাও তো মনে পড়ছে সে সব কথা। নিজের মনকে আজ কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না সে। কাঠের বেঞ্চিতে উঠে বসলো সে। কিছুক্ষণ বসার পর ছাদময় শুরু করলো পায়চারি করা। কিসের একটা আওয়াজে চমকে উঠল সে। ছাদের এক কোণায় লোহার এক পুরনো আলমারি রাখা আছে। কেউ যেন সেই আলমারি থেকে লাফিয়ে কোথাও উধাও হয়ে গেল। কাঠবেড়ালি হবে হয়তো। রাতে কি দেখা যায় কাঠবেড়ালি? ঠিক জানে না বিউটি। তবে কাঠবেড়ালি চিরকাল তাকে আকৃষ্ট করে। অদ্ভুত স্ফূর্তি সেই প্রাণীর। কাঠবেড়ালির মত স্ফূর্তি যদি তার হতো তাহলে হয়তো সেই দিনটা তাকে দেখতে হতো না। কোনও না কোনও ভাবে ঠিক নিজেকে সেখান থেকে বের করে আনতো সে। আজ আকাশে চাঁদ ওঠেনি। চাঁদ ছিল না সে দিনও। ছিল না আকাশে একটা তারাও। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের রাতে একরাশ কালো মেঘ নেমে এসেছিল শ্রেয়ার জীবনে। রাত তখন ন’টা বাজে প্রায়। তার বাবা তখনও ফেরেনি। মজুরের কাজ করতো সে। সাতটা- সাড়ে সাতটা মধ্যেই ফিরে আসে সে। সাথে থাকে দেশি মদের এক বোতল। শ্রেয়া জানতে পারলো তার বাবা নাকি দেশি মদের ঠেকেতে বসে আছে। ঠেকটা বাড়ি থেকে বেশ দূর। বেশ অনেকটা অন্ধকার পথ পেরিয়ে যেতে হয়। মনে সাহস এনে সে দিকে আসতে আসতে পা বাড়ালো শ্রেয়া। কিন্তু মদের ঠেক থেকে নিয়ে আসতে পারলো না নিজের বাবাকে। ঠেকের মালিক বলল – ‘ও এখন যাওয়ার অবস্থায় নেই। রাতটা এখানেই থেকে যাক। কাল সকালে পাঠিয়ে দেবো। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রাতে দু’ জন থাকে এখানে।’
আবার সে অন্ধকার পথ বেয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া। উফ্ফ…. কি রাত ছিল সেটা! ক’ জন ছিল? এখনও মনে আছে শ্রেয়ার, ছ’ জন। ছাদের এক ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে বিউটি। হঠাৎ শরীরটা কেমন কেঁপে উঠল তার। সেই কথাগুলো এখনও তার কানে বিষাক্ত তীরের মত বেঁধে – ‘তুই পাপিষ্ঠা, তুই পতিতা। কী পেলি নিজের শরীর বিক্রি করে?’
এমন বিষাক্ত কথা আর কেউ না, বলেছিল তার বাবা। বাবার শেষ কথা ছিল – ‘আর কোনও দিন এ বাড়িতে পা রাখবি না।’
অভিমানী শ্রেয়া আর কোনও দিন পা রাখেনি সেই ভিটেতে। শ্রেয়া থেকে বিউটি হলো সে। এক বারও মনে ইচ্ছে জাগেনি যে, আবার ফিরে যাই।
তত দিনে সে ভালোবেসে ফেলেছিল বিল্টুদাকে। ঘটনার পর বিল্টুও পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেত। বিল্টু ইংরিজির কিছু শব্দ আয়ত্ত করেছিল। তার মধ্যেই একটা শব্দ ছিল ‘ভার্জিন’। সেই শব্দটাই সে ব্যবহার করেছিল শ্রেয়ার কাছে, যখন শ্রেয়ার সাথে তার শেষ দেখা হয়। বিল্টু বলেছিল – ‘সব ছেলেরই ইচ্ছে থাকে, তার বৌ যেন ভার্জিন হয়। কিন্তু তুই তো আর ভার্জিন রইলি না। তোর শরীরকে তো আগেই অন্য কেউ ভোগ করে নিয়েছে।’
প্রতি উত্তরে কিছুই বলতে পারেনি শ্রেয়া। শ্রেয়া জানতো সে কোনও দিনই ন্যায় পাবে না। পুলিশ, আদালত তার বাবা কোনও দিনই করতে পারবে না। তাকে এবার নিজের দুর্ভাগ্যের বোঝা কাঁধে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। দেখা যাক, নিয়তি কোন দিকে নিয়ে যায়।

নিয়তি দিলো তাকে নতুন জীবন, দিলো তাকে নতুন নাম, নতুন পরিচয়। রুক্মিণী মাসি প্রথম দিনই তাকে দেখে বলেছিল – ‘মেয়েটা কে দেখতে খুব সুন্দর। আজ থেকে তার নাম হবে, বিউটি।’
নিজের এই জীবনকে মেনে নিয়েছিল বিউটি। কোনও দোষ না করেই যখন সে সমাজের নজরে পতিতা, তখন না হয় পতিতা হয়েই জীবনযাপন করা যাক। এতে অপরাধ কোথায়?

আজ কাজ করার ইচ্ছে খুব একটা নেই বিউটির। ছাদেও এখন আর থাকতে ইচ্ছে করছে না তার। নিচে রুক্মিণী মাসির চোখের সামনে গেলেই কোনও না কোনও গ্রাহক তার কাছে পাঠিয়ে দেবে। এই মুহূর্তে রুক্মিণী মাসির চোখের আড়ালে থাকাই ভালো। ছাদে পায়চারি করতে করতে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো বিউটি। কারোর যেন গলার আওয়াজ শুনতে পেল সে। খুবই চেনা আওয়াজ। রুক্মিণী মাসির সাথে কথা বলছে সে। রুক্মিণী মাসি তাকে বলছে- ‘কিছু মাস আগেই একটা খুব সুন্দর জিনিস এসেছে। কিন্তু রেট হাই।’
‘রেটের চিন্তা করবেন না আপনি। জিনিস যদি ভালো হয়, তাহলে রেটও ভালো পাবেন। আমার মনের মত যদি হয়, তাহলে রেটের থেকে বেশিও পেতে পারেন।’
‘হে হে হে হে। আপনাদের মত লোকেদের জন্যই তো আমাদের মত গরীবদের পেট চলে। দাঁড়ান, দেখি ঘরে আছে কি না।’
সিঁড়ির আড়াল থেকে নিচের দৃশ্যটা দেখছিল বিউটি। সে পরিস্কার দেখতে পেল রুক্মিণী মাসির সাথে যে কথা বলছে সে বিল্টু। এই ছেলেরাই নাকি ভার্জিন বৌয়ের কথা বলে। পরনের জামা কাপড় দেখে তো মনে হয় এই কিছু মাসে বেশ ভালোই টাকা উপার্জন করেছে সে। বিউটির এটা বুঝতে সময় লাগলো না যে রুক্মিণী মাসি তারই কথা বলছে। না, সে কিছুতেই যেতে পারে না বিল্টুর সামনে। এই বিল্টুই এক দিন বড় বড় প্রেমের কথা বলেছিল। বহু রঙ্গিন স্বপ্ন দেখিয়েছিল তাকে। যখন শ্রেয়ার কঠিন সময় এলো, তখন এই বিল্টুই তাকে ‘ভার্জিন’ কথাটা বলেছিল। না, আজ বিল্টুর ফুর্তি আর শারীরিক সুখের জন্য সে নিজের শরীর দিতে পারবে না। বিল্টু ফেরত গিয়ে কোনও না কোনও ভাবে এ কথাটা ছড়িয়েই দেবে যে শ্রেয়ার নতুন নাম বিউটি। বিউটি জানে না তার বাবা এখন বেঁচে আছে কি না। যদি বেঁচেও থাকে, তাহলে এই খবরটা শুনে বেঁচে থাকা তার পক্ষে দুষ্কর হয়ে যাবে। না, সে কিছুতেই যেতে পারে না বিল্টুর সামনে। কিন্তু লুকোবার জায়গাও তো নেই কোত্থাও। সে জানে, ঘরে তাকে না পেয়ে রুক্মিণী মাসি ঠিক ছাদে আসবে তাকে খুঁজতে। নিচে নামলেও সব থেকে আগে তাকে বিল্টুর সম্মুখীন হতে হবে। কোনও উপায় না পেয়ে সে উল্টো পায়ে ছাদের দিকেই ছুটল। খানিক পরেই শুনতে পেল রুক্মিণী মাসির আওয়াজ।
‘বিউটি, এই বিউটি! কোথায় মরে গেলি রে মুখপুড়ি?’
ছাদে উঠে এলো রুক্মিণী মাসি।
‘আমি যাবো না মাসি।’
‘যাবি না মানে? মোটা খদ্দের এসেছে। হাতছাড়া করবো নাকি?’
‘তুমি আমার কাছে অন্য খদ্দের পাঠাও। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ওর কাছে আমি যাবো না।’ দু’ হাত জোর করে মিনতি করলো বিউটি।
‘মাগীর ঢ্যামনামো দেখো। সহ্য হয় না। চল মাগী।’
রুক্মিণী মাসি এগিয়ে এলো বিউটির দিকে। বিউটি এক পা- এক পা পিছনে সরে যাচ্ছে। রুক্মিণী মাসি এক লহমায় ঝাঁপিয়ে পড়লো বিউটির উপর। নিজের মুঠোতে বিউটির চুল ধরে হিঁচড়তে হিঁচড়তে নিয়ে চলল।
‘মাসি ছেড়ে দাও। পায়ে পড়ি তোমার। ছেড়ে দাও মাসি।’ আর্তনাদ করতে থাকে বিউটি।
বিউটির আর্তনাদ রুক্মিণী মাসির কানে যায় না। নিজেকে ছাড়াবার শেষ চেষ্টা করলো বিউটি। কোনও ক্রমে রুক্মিণী মাসির হাতে এক কামড় দিয়ে কোমরে এক ধাক্কা দিলো বিউটি। ধাক্কাটা হয়তো একটু জোরেই দিয়ে ফেলেছিল সে। নিজের টাল সামলাতে না পেরে রুক্মিণী ছিটকে গিয়ে পড়লো ছাদের এক কোণায়। পুরনো এক লোহার আলমারি সেখানে বিরাজমান। যতক্ষণে রুক্মিণী মাসি নিজেকে সামলাতে পারবে, তার মাথাটা সজোরে ঠুকে গেল সেই লোহার আলমারিতে। দু’ রকমের বিকট আওয়াজ বেরোল। প্রথম আওয়াজ আলমারিতে রুক্মিণীর মাথা ঠোকার এবং দ্বিতীয় আওয়াজ বেরোল তার গলা দিয়ে। চকিতে ভয়ে শিউরে উঠল বিউটি।
‘এ কী হয়ে গেল? কোনও অনর্থ ঘটেনি তো?’ কথাটা ভেবে সে দিকে ছুটে গেল। আলো আঁধারির মধ্যে দেখতে পেল রুক্মিণী মাসি মাটিতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। বিউটি তার মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো। মাথার নিচে হাত দিতেই হাতে এলো রক্তের ধারা। বেশ কয়েক বার নিথর পড়ে থাকা রুক্মিণী মাসিকে ঝাঁকালো বিউটি। লাভ হলো না। মাথার পিছন থেকে ক্রমাগত রক্তপাত হয়েই চলেছে। বলাই বাহুল্য কিছুক্ষণের জন্য দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল সে। কী হবে এবার? চারিদিকে জানাজানি। পুলিশ আসবে, উঠিয়ে নিয়ে যাবে তাকে। তার কি প্রমোশন হলো? পতিতা থেকে খুনি? না, ‘খুনি’ উপনামটা বিউটি নিজের নামের সাথে লাগাতে নারাজ। এই মুহূর্তে ছাদে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা কি কেউ মানবে? কেউ কি মানবে এটা নিছকই এক এক্সিডেন্ট? না, কেউ মানবে না সেটা। কিছুক্ষণ পরেই ছাদে ভিড় বাড়বে। রুক্মিণী মাসিকে নিচে না পেয়ে অনেকেই হয়তো ছাদে তাকে খুঁজতে আসবে। আচ্ছা, বিল্টু কি এখনও নিচে অপেক্ষারত? নানা প্রশ্ন যেন এক সাথে ভিড় করে এলো তার মস্তিষ্কে। কোনও প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর তার কাছে নেই। অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছল বিউটি। সিদ্ধান্তটা ঠিক না ভুল, সেটা ভাবারও তার কাছে অবকাশ নেই। কেউ বিউটির দিকে আঙ্গুল তুলে তাকে ‘খুনি’ বলুক এটা সে চায় না, তাই তাকে এই কাজটা করতেই হবে। ধীর কদমে সে এগিয়ে গেল রেলিংএর দিকে। মস্তিষ্ক একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে এখন একেবারেই ঠান্ডা। চোখের সামনে শুধু ভেসে উঠছে এখন তার মায়ের ছবি। এখন সে বিউটি নয়, এখন সে শ্রেয়া। নিজের মায়ের শ্রেয়া, যে নিজের মায়ের কোলে মাথা রেখে শোবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। রেলিংএর কাছে গিয়ে শ্রেয়া দাঁড়ালো। তাকালো একবার নিচের দিকে। রাস্তায় বেশ কিছু লোকের ভিড় এখনও। আকাশের দিকে তাকালো শ্রেয়া। অজস্র তারা মিটমিট করছে। হয়তো এদের মধ্যেই কোথাও আছে তার মা। শ্রেয়া মনে মনে বলল- ‘আমি তোমার কাছে যেতে চাই মা। শুতে চাই তোমার কোলে মাথা রেখে। কত দিন শুইনি বলতো? আমাকে গ্রহণ করবে মা? আমার মত পতিতাকে গ্রহণ করবে তো?’

সমাপ্ত।

Loading

Leave A Comment