গল্প- আবার বৃষ্টি পরবে

আবার বৃষ্টি পরবে
– পারমিতা চ্যাটার্জী

 

কতদিনের পর আবার এসে দাঁড়িয়েছি রাঙামাটির পথে।
তোমার মনে আছে অনু?
আমরা যখন রাঙামাটির পথে পা মিলিয়ে হাঁটতাম, তুমি আমার হাতটা তখন গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলতে- “এই মাটিতে কবির পায়ের গন্ধ মিশে আছে।
-আমি তাকিয়ে থাকতাম টলটলে দিঘীর মতন তোমার শান্ত দীঘল চোখ দু’টিতে।
– মনে হত যেন মিশে গেছি ওই চোখের তারায়।
মনে আছে তোমার আচমকা মেঘের গর্জনে তুমি ভয় পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরেছিলে।তারপর হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে ছেড়ে দিলে। তেমার সেই লজ্জারাঙা চোখ দু’টি আজও আমার মনের ক্যানভাসে আঁকা আছে।
দোল পূর্ণিমায় পলাশ গাছের গোধূলি ছায়ায় মাখিয়ে দিতাম তোমায় আমার মনের আবীর।
খোয়াইয়ের ধারে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ আব্দার করলে, রতন কাকার দোকানে চা খেতে যাবে?
– আমি বললাম তোমার আব্দার রাখবনা, এমন সাধ্য কি আমার আছে?
তুমি কি তখনও বোঝনি অনু আমার মনের কথাটা?
হঠাৎ একদিন মেঘ করে এলো। দেখতে দেখতে পূবের আকাশটা কালো হয়ে গেল।
তুমি বললে, অয়ন মেঘ করেছে, এখুনি বৃষ্টি আসবে। ভিজে যাবো যে..
আমি আস্তে আস্তে বললাম, আমি তো তোমার মন থেকে ঝরে পরা বৃষ্টির জলে রোজই ভিজে যাই অনু। তুমি না বুঝেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলে। তোমার মায়াবী চোখ দু’টি আমায় প্রবল আকর্ষণে তোমায় কাছে টানতে লাগল। কিন্তু আমি জয় করলাম আমার নিজেকে, নিজের মনের দুর্বলতাকে। মুখে বললাম, একদিন না হয় একটু ভিজলাম কি আসে যায় তাতে?
বলতে বলতে মুষল ধারে বৃষ্টি নামল। তুমি একেবারে ভিজে গেলে। ভিজলাম আমিও কিন্তু আমার চোখ দু’টো ছিল তোমার ভেজা হলদে শাড়িটার ওপরে যা লেপ্টে রয়েছে তোমার শরীরের প্রতিটি কোণায়। তেমার ভেজা চুলগুলো লেপ্টে গেছে তোমার চোখে মুখে। আমি হাত দিয়ে তোমার চোখের ওপরের চুলগুলো সরিয়ে দিলাম।
আমার শিল্পী মনের প্রতিটি কোণায় কোণায় তোমার এই ভেজা শরীরটা তোমার অজান্তে আঁকা হয়ে থাকল। আমার আঁকার সব ছবিই তোমার মনে দাগ কাটে। শুধুু জানিনা আমি মানুষটা তেমার মনে কতটা দাগ কাটতে পেরেছি। তোমায় নিয়ে কত ছবি এঁকেছি তাও তুমি জানোনা। কিন্তু আজকের এই ছবিটা বোধহয় জীবনের সেরা ছবি হবে।
হ্যাঁ, ওই ছবিটা আমার জীবনে কিছু দিয়েও অনেকটা কেড়ে নিল।
ওই ছবিটার জন্য আমি পেলাম আন্তর্জাতিক পুরস্কার আর তোমার কাছে চরম তিরস্কার। সে তিরস্কারের ভাষা ছিল যেমন সত্য তেমনি নির্মম।
তুমি সেদিন যখন বলেছিলে, ছিঃ আমাকে একেবারে সবার সামনে নামিয়ে আনলে– সামান্য পুরস্কারের লোভে?
তখন আমার চোখ ফুটল, সত্যি তো এ আমি কি করলাম? যাকে ভালোবাসি, তার সিক্ত যৌবনের ছবি কি করে আমি সবার সামনে মেলে ধরলাম?
তোমার ক্ষমা আমি পেলাম না। তুমি বললে, আমি ক্ষমার অযোগ্য।
আমি নীরবে এ তিরস্কার মাথা পেতে নিলাম।
নিজেকে হারিয়ে ফেললাম অনেক দূরে, যাযাবরের মতন ঘুরে বেড়াতাম। কখনও আধপেটা খেয়ে কখনও না খেয়ে। শেষকালে ফিরলাম। কলকাতায় মায়ের চোখের জলের মূল্য দিতে। চাকরি নিলাম রবীন্দ্রভারতীতে অঙ্কন শিক্ষক হয়ে। ফিরতে পারিনি আর আমার প্রিয় সেই রাঙামাটির দেশে।
প্রায় কুড়িবছর পর কিসের এক অমোঘ টানে এলাম আবার পৌষমাসের মেলার প্রাঙ্গণে।
হঠাৎ দেখলাম তোমায়, আর্ট গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে কি যেন খুঁজে যাচ্ছো তন্ময় হয়ে।আমি আস্তে আস্তে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম- কি খুঁজছ?
তুমি চমকে তাকালে আমার দিকে। তারপর হতাশ গলায় প্রশ্ন করলে, পালিয়ে গেলে কেন?
আমি বললাম, কি করে থাকব একই শহরে তেমার ঘৃণা নিয়ে?
শুধু ঘৃণাটাই দেখলে?
না আরও কিছু দেখতে চেয়েছিলাম।
– কি?
-ৎভালেবাসা?
– পাওনি?
– হয়তো পেয়েছিলাম, কিন্তু নিজেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
– আজ আমার একটা ছবি আঁকবে? এ ছবি কোন প্রদর্শনীতে যাবে না। থাকবে শুধু তোমার আমার মাঝে।
– আমি আকুল হয়ে তোমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললাম,অ..নু..
তুমি তেমনি ভাবে বললে, বললে না তো আঁকবে কি না?
আমি শুধু নিজের এতদিনের না ঝরা অশ্রুকে সংযত করে তোমার দু’টো হাত তেমনি ভাবে জড়িয়ে রেখে বললাম আঁকব।
তুমি হেসে আমার হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললে, আবার বৃষ্টি পরবে।

Loading

Leave A Comment