গল্প- ভূত তাড়ানো

ভূত তাড়ানো
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

দিন চার হল সংঘমিত্রার বাবা মারা গেলেন। সাত-আট মাস কর্কট ব্যাধিতে ভুগে সংসারকে প্রায় সর্বস্বান্ত করে তিনি তার দুই সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে চলে গেলেন ভব পারে। সংঘমিত্রার সাথে তার বাবার সম্পর্ক যে খুব মাখোমাখো ছিল তা ঠিক নয় তবু বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই সংঘমিত্রা সর্বদাই বাবার উপস্থিতি উপলব্ধি করতে শুরু করল।

সংঘমিত্রার স্বামী একজন শিল্পপতি, তার দুই মেয়ে। বাপের বাড়িতে আসা যাওয়াও ছিল তার কম। বাবার শেষ কাজ করার জন্য ত্রেরাত্রির পর দূর্গাপুরে নিজের বাড়িতে চলে আসে। বিশাল সাজানো বাড়ি সংঘমিত্রার। দূর্গাপুরে দূষণের মাত্রা লাগামছাড়া তাই সে প্রতিটি ঘরে এয়ার পিউরিফায়ার লাগিয়েছে। গতকাল হঠাৎই ডাইনিং রুমে সন্ধ্যার সময় সিগারেটের গন্ধ পেয়ে অবাক হয়ে যায় সংঘমিত্রা। বাড়িতে কেউ নেই তাহলে গন্ধটা এলো কোথা থেকে। সংঘমিত্রা ভাবতে ভাবতে সোফায় বসে পড়ে। রাত নটা নাগাদ দুই মেয়েকে নিয়ে রূপক টিউশন থেকে বাড়ি ফিরলে রূপককে দেখা মাত্রই সে কাঁদতে শুরু করে, বলে বাবা এসেছিল।

রূপক একজন বি.ই.ইজ্ঞিনিয়ার, তার ওপর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার পক্ষে এই উদ্ভট কথা মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। রূপক সংঘমিত্রাকে শক্ত হতে বলে ভিতরের রুমে চলে গেল। সংঘমিত্রার মেয়েরা মাকে কাঁদতে দেখে তারাও কেঁদে ওঠে। সংঘমিত্রা মেয়েদের জড়িয়ে ধরে আবার বলে ওঠে ‘তোদের দাদুভাই এসেছিল’।

রূপক ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে খাবার রেডি করতে শুরু করল। অশৌচ বাড়ি তাই একদম সাদা খাবার। মেয়েদের খাওয়া হয়ে গেলে তারা রুমে চলে গেল ও সংঘমিত্রা খাবার নিয়ে বসে থাকে। রূপক তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে একজন শিক্ষিত মেয়ে হয়ে সে কি কথা বলছে! মৃত্যুর পর আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়। ভূত প্রেত এই সব কি আজেবাজে কথা বলছে সে।

পাঁচ দিনের দিন যথারীতি বাবার শ্রাদ্ধ্ শান্তির কাজ পরম নিষ্ঠা সহকারে সম্পন্ন করল সংঘমিত্রা। পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম মিটে গেলে ও প্রতিদিন তার বাবা যে খাবারগুলো খেতে ভালোবাসতো তা সে ঠাকুরকে দিয়ে রান্না করিয়ে পাঁচিলের একপাশে রেখে আসতো। পরে এসে দেখতো প্লেট ফাঁকা। সংঘমিত্রার ধারনা জন্মায় খাবারগুলো তার বাবার আত্মা খেয়ে যায় প্রতিদিন। এইভাবে চার পাঁচ মাস পর একদিন সংঘমিত্রার বড় মেয়ে অসুস্থ হলে আবার সে তার বাবার উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারল। বড় মেয়ে পেটের যন্ত্রনায় যত ছটপট করছে ততই সংঘমিত্রার পিঠে কেউ যেন করাঘাত করে চলেছে। এই প্রথম সংঘমিত্রা কোনো আত্মার সাথে কথা বলল। সংঘমিত্রা চিৎকার করে বলে ‘বাবা তুমি কেন এমন করছো। দেখছো মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। তুমি এবার এসো। মেয়েটাকে একটু শুতে দাও।’ মিনিট পনেরোর মধ্যে যে মেয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল কোনোরকম ডাক্তারি সাহায্য ছাড়া সে মেয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। এই ঘটনায় সংঘমিত্রা আরও সিওর হতে লাগলো তার বাবার উপস্থিতি নিয়ে। তবে এইসব কথা সে রূপকের কাছ থেকে চেপে যেতে লাগলো।

মাঝে মধ্যেই সংঘমিত্রা বলে তার শরীরটা ভাল লাগছে না। বিশেষ করে একা থাকলেই তার শরীরটা একটু বেশি খারাপ হয়ে যায়। রূপককে না জানিয়ে সে সাইক্রিয়াট্রিস্টের কাছে ছুটে। ডাক্তার তাকে নানা ধরনের টেস্ট, ঔষধ পত্র প্রেসক্রাইব করে তবুও কিছুতেই অদ্ভুত এই আতঙ্কের অনুভূতির হাত থেকে বের করে আনতে পারছিল না নিজেকে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সে শুধু অনুভব করতো তার বাবা তাকে কিছু বলতে চায়। পাছে লোকে তার অনুভুতিকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে তাই সে কারোর সাথে এই সব কথা শেয়ার করত না।

এক বছর পর বাৎসরিক ক্রিয়াকর্মের জন্য সংঘমিত্রা বাপের বাড়ি কলকাতায় আসে।বাৎসরিক ক্রিয়া কর্ম সম্পন্ন হয়ে গেলে সবার সাথে সেও খেতে বসে। আজও তার বাবা যা যা খেতে ভালোবাসতো তাই মেনু হয়েছে। সংঘমিত্রা রেডমিট খাওয়া মানা তাও সে এমন জিদ ধরলে যা দেখে সকলেই হতবাক। এক পিস মাংসের জন্য সংঘমিত্রার মত মেয়ে বাড়ির প্রতিটি লোককে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো। সংঘমিত্রা এই অদ্ভুত আচরণে রূপক অত্যন্ত ভয় পেয়ে যায়। সংঘমিত্রার ছোটমামা রূপককে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে আলোচনা করার জন্য। কিন্তু সংঘমিত্রাকে ডাক্তার দেখাবার কথা বললেই সে মারাত্মক ক্ষেপে যায়। পরিস্থিতি যখন মাত্রাতিরিক্ত বেগতিক তখন সংঘমিত্রার ছোটমামা খোঁজ নিয়ে এলো এক মুসলিম গুণীনের।

সংঘমিত্রাকে কিছু জানতে না দিয়ে তার মামাতো বৌদি ও মামিরা বেড়াতে নিয়ে যাবার ছল করে তাকে মসজিদে নিয়ে আসে। শুনশান জায়গা দেখে সংঘমিত্রা মসজিদের ভিতরে ঢুকতে রাজি হয় না কিছুতেই। সবাই প্রায় ধরে বেঁধে তাকে গুণীন এর কাছে নিয়ে আসে। গুণীন কি একটা জলের ঝাপটা দিলো যার আঘাতে সংঘমিত্রা দু-তিন ফিট দূরে গিয়ে পড়ল। তারপর সংঘমিত্রার চুলের মুঠি ধরে অমানুষের মত মার শুরু করল গুণীন মহাশয়। যখন সংঘমিত্রা মার খেতে খেতে ক্লান্ত তখন তার গলায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল একটা কাঁচের বোতলের অগ্রভাগ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গলার ভিতর থেকে বোতলকে টেনে বের করে একটা ছিপি দিয়ে বোতলের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলো। সেই বোতলটিকে মাঝ গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার আদেশ দিলেন গুণীন মহাশয়। সংঘমিত্রা ততক্ষণে জ্ঞানশূন্য হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। সে কখন তার বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছিল তা সে জানে না। আর এই সমস্ত ঘটনা সংঘমিত্রা নিজমুখে রিমাকে জানায়।

একদিন দুপুরের দিকে কিঞ্চিত সাহস সঞ্চয় করে রিমা ওই মসজিদের দিকে যাত্রা করে।মসজিদটা একটু বেশি ফাঁকা জায়গার বুকে গড়ে উঠেছে। মুখ্য দরজার কাছে আসা মাত্রই রিমার বুকেও কেমন যেন একটা চাপা ভয় অনুভূত হল। তবুও ঈশ্বরের নাম নিয়ে ভিতরে ঢুকে রিমা জানতে চাইল ভূত তাড়ানো গুণিনের কথা। মসজিদের মজুত সকল ব্যক্তি অবাক চোখে রিমাকে দেখতে লাগল। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক রিমাকে সেই গুণীনের কাছে নিয়ে এলো। যে ঘরটাতে গুণীন মহাশয় অবস্থান করে আছে সেটা ভীষণ অন্ধকার। রিমাকে দেখা মাত্রই বাইরে তক্তা পেতে বসার হুকুম দিলেন তিনি। দু’ তিন মিনিটের মধ্যে লম্বা দাড়িওয়ালা, মোটাসোটা গুণীন মহাশয় রিমার সামনে এসে রাশভারী কণ্ঠে বললেন ‘কি চাই এখানে’? রিমা নিজের ভিতরে শক্তি সঞ্চয় করে বলে ‘আপনি কি সত্যিই ভূত তাড়াতে পারেন?’এই ধরনের প্রশ্ন শুনতে গুণীন মহাশয় একদমই অভ্যস্ত নন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন ‘ঠিক কি জানতে চাইছো?’

রিমা তার বান্ধবীর এখানে আসার সেই সব পুরনো কথা গুণীনের সামনে তুলে ধরল। তখন গুণীন মহাশয় সামান্য হেসে বললেন-‘বেটি ভূত তাড়ানোটাই আমার রোজগার। তোকে কথা দিতে হবে তুই কাউকে বলবি না যা আমি তোকে বলবো। আত্মার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা মোটেই সহজ কাজ নয়। আমাদের মত অতি সাধারণ লোকের পক্ষে তো মোটেই নয়। লোকজন যে বিশ্বাস নিয়ে গুণীনের কাছে আসে সেটাকে আমরা কাজে লাগাই মাত্র। তোর বান্ধবী বড়লোকের বউ। কাজকর্ম কিছু করে না সারাদিন। শুধু বসে বসে অ্যালবাম দেখে বেড়াতো। ওর মামা আমাকে এইসব কথা বলেছে। অলস মস্তিষ্ক নানা ধরনের দুর্বুদ্ধি বাসা। সেইরকম একটা দুর্বুদ্ধি তোর বান্ধবীর মধ্যে জন্মেছিল। তাই আমি ওকে এত মেরে ছিলাম যে এরপর থেকে ওই রকম দুঃখ বিলাসিতা করার সাহস যেন ওর মনে কখনো না জন্মায়। ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্ট কি জিনিস এইসব বড়লোকের মেয়ে বৌ-রা কিচ্ছু জানেনা। তাদের জন্য কঠিন হতে আমরা বাধ্য হই। শরীরের যন্ত্রণা যখন তীব্র হয় তখন অবান্তর মানসিক ভাব তার কাছে তুচ্ছ লাগে।’

গুণীনর মহাশয় সম্বন্ধে যে ধারণা নিয়ে রিমা মসজিদে প্রবেশ করেছিল তার সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেল। রিমা নমস্কার করে উঠে পড়ে। গুণীন মহাশয় আবারও অনুরোধের স্বরে বলেন ‘গোপন কথা লো যেন গোপন থাকে।’

Loading

2 thoughts on “গল্প- ভূত তাড়ানো

Leave A Comment