বিশু
– অমরেশ কুমার
এক
এ পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে তাদের সব থেকেও কিছু নেই। তারা জন্মায় কেবল অবহেলার শিকার হয়ে, বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু সরঞ্জাম প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তাদের কপালে জোটে- তার বেশি পাওয়া তো দূরের কথা, কল্পনাও করতে পারে না।
ধনী গরীবের এই ভেদাভেদ চিরকাল আমাদের সমাজে। তার ছোঁয়া প্রতিটি পদক্ষেপে বজায় থাকে। টাকায় টাকা বাড়ছে আর কিছু মানুষ অনাহারে রাস্তায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়। কিছু মানুষ অট্টালিকাতে বসবাস করে থাকে, আর কিছু মানুষ রাস্তার পাশে ছেঁড়া চাদরের মধ্যে পুরো পরিবার নিয়ে থাকে। প্রথম শ্রেনীর মানুষ ভোগ করবার জন্য বেঁচে থাকে। তাদের জন্ম হয়েছে ভোগের থালা হাতে নিয়ে, আর দ্বিতীয় শ্রেনীর মানুষ সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য জন্মেছে। সুখ তাদের কপালে নেই, বাঁচতে হয় তাই বেঁচে রয়েছে ।ভুলবশত তাদের বাঁচতে বাধ্য করা হয়।
বাঁচবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই বিশ্বজিতের, তাও যেন বাঁচবার জন্য তাকে বাধ্য করা হচ্ছে। না বেঁচে থেকেও উপায় নেই, তিন তিন বার মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েও পিছপা হতে বাধ্য হয়েছে বিশ্বজিৎ। সে যখন যা করতে যায়, তখন কিছু একটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধার সৃষ্টি করে থাকে, আর তখনই বাধ্য হয়ে পিছিয়ে আসতে হয়।
বিশ্ব সংসারে আপন বলতে ঠাম্মা ছাড়া আর কেউ নেই বিশ্বজিতের। ঠাম্মা ছিল তার কাছে গোটা জগৎ, ঠাম্মাকে আঁকড়ে ধরে সে বড় হয়েছে।
প্রতিটি শিশুর সঠিক ঠিকানা হলো মায়ের আঁচল, মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা শিশুর কাছে প্রকৃত ভালোবাসা; যা প্রতিটি শিশু তার মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বজিৎ সে কপাল নিয়ে জন্মায়নি; মায়ের স্নেহ, মমতা সে কোথা থেকে পাবে? মাকে তো সে চোখেই দেখেনি কখনো।
তিন তিন বার মরতে গিয়েও ফিরে এসেছে শুধুমাত্র ঠাম্মার কথা ভেবে, ও ছাড়া যে ঠাম্মার আর কেউ নেই, ও না থাকলে ঠাম্মাকে দেখবে কে?
কিন্তু, প্রকৃতি কারো ইচ্ছানুযায়ী চলে না, চলে নিজের ইচ্ছানুযায়ী। কে থাকলো আর কে চলে গেল তাতে তার কিছু যায় আসে না; প্রকৃতি বড়ই কঠোর, বড়ই নিষ্ঠুর, প্রিয়জনদের কেড়ে নেবার জন্য সর্বদা অপেক্ষা করে।
প্রকৃতির এই রুদ্র নিয়মে ঠাম্মাও একদিন নাতিকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলো।
দুই
বিষ্ণুপুর গ্রামে বিশ্বজিতের বাড়ি। গ্রামের রাস্তাগুলি মাটির, বিদ্যুৎ এর আলোও পৌঁছায়নি, প্রায় সব বাড়িগুলি মাটির তৈরি এবং খড়ের ছাউনি দেওয়া, বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা জমে থাকে রাস্তায়।
বিশ্বজিতের ঠাম্মা শচীদেবীর স্বামী অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। বহু কষ্ট করে তিনি ছেলে সমরজিৎকে বড় করে তুলেছিলেন। তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন পাশের গ্রামের মেয়ে সরলার সাথে।
সরলার বাবার আর্থিক অবস্থা সমরজিৎ এর তুলনায় অনেকটাই ভালো, সে জন্য নিজের তুলনায় সচ্ছল পরিবারের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিতে প্রথমে রাজি ছিলেন না শচীদেবী। মেয়ে দেখতে শুনতে ভালো, তার উপর বিয়ের সমস্ত খরচ মেয়ের বাবা দিচ্ছেন সঙ্গে দশ হাজার টাকা; তাই শচীদেবী আর না করেননি।
এদিকে মেয়ের স্বভাব চরিত্র খুব একটা ভালো ছিল না। সেজন্য সরলার বাবা ভেবেছিলেন মেয়েকে নিজের ঘাড় থেকে যত তাড়াতাড়ি নামিয়ে বিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো ।
প্রথম প্রথম তাদের দাম্পত্য জীবন খুব ভালো ভাবে কাটতে থাকে, কিন্তু সে সুখ তাদের দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। অভাবের একঘেয়েমি সংসার সরলার আর ভালো লাগতো না। অভাবের কারণে মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে প্রচুর অশান্তি হতো ।
বছর দুই যেতে না যেতে বিশ্বজিৎ-এর জন্ম হয়। বিশ্বজিতের আগমনে সব থেকে খুশি হোন শচীদেবী, আনন্দে পুরো পাড়াময় গল্প করতে থাকেন। আমার নাতি হয়েছে, আমার নাতির নাম রেখেছি বিশু।
সংসারে কিছু নিন্দুক থাকে, যারা কিছু একটা পেলেই নিন্দা করতে ছাড়ে না। অবশ্য নিন্দা বললে ভুল বলা হবে, নিন্দুকেরা গ্রামের মধ্যে যা রটাচ্ছে তার পুরটাই মিথ্যা নয়, অধিকাংশই সত্যি।
গ্রামের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সরলা। গ্রামের দু’চার জন বউ একত্রিত হলেই সরলাকে নিয়ে চর্চা শুরু করে দেয়। পাড়ার বউরা মিলে বলাবলি করতে থাকে সরলার যে ছেলে হয়েছে তা সমরজিতের নাকি ওই পাড়ার অশোকের? এই নিয়ে হাসি ঠাট্টা কম চলে না।
সরলার চরিত্রের কথা অনেকেই জানত। অশোকের সাথে সরলার যে একটা সম্পর্ক রয়েছে তা অনেকেই অনুমান করত, তার উপর দু’জনকে মাঝে মাঝে একসাথে দেখাও গিয়েছে। পাড়ার লোকতো বলবেই , তারা যখন সব কিছু নিজের চোখে দেখছে তখন তাদের বলতে অসুবিধা কোথায়। খবর মুখে মুখে ছড়াতে থাকে এবং একদিন সমরজিৎ এর কানে গিয়ে পৌঁছায়।
শান্ত প্রকৃতির লোক ছিল সমরজিৎ, সে কারো কথাতে থাকতো না, নিজের মতো নিজে থাকতো। বউ এর কেচ্ছা কাহিনীতে সে এতটা ভেঙে পড়েছে যে সে নিজে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয় তার। সর্বদা নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করে চলতো। তার বউ এত নীচ, এত ছোট মনের। বউ এর কাছ থেকেও আগের মতো ভালোবাসা সে আর পায় না, সর্বদা প্রত্যাখ্যান। এত অল্প বয়সে সে যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলেছে, সংসার নিয়ে চিন্তা করতে তার আর ভালো লাগে না, বউ এর নোংরা স্বভাব তাকে জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে, পুরো গ্রামের মধ্যে বদনাম সে যেন আর সহ্য করতে পারছে না। তাই জ্বালা নিবৃতির সহজ উপায় সে বেছে নিলো- বৃদ্ধা মা, সদ্যোজাত ছেলে, বউ সবাইকে ছেড়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলো সমরজিৎ।
সমরজিৎ না থাকায় সংসারে আরও দারিদ্রতা নেমে আসে। কি ভাবে সংসার চালাবে বুঝতে পারছিলেন না শচীদেবী। একে বয়স হয়েছে তার উপর সন্তান হারা হয়ে আরো দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বৌমাকে কখনো ছোট বড় কথা বলেননি।
আজও কিছু না বলে, বৌমার মানসিক অবস্থার কথা বুঝে বৌমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। নিজে লোকের কাছে সাহায্যের জন্য ছুটে গিয়েছেন, নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন বৌমা ও নাতিকে সুস্থ রাখার।
কিন্তু, এভাবেই বা আর কদিন চালানো যায়, এক বেলা খাওয়া হয় তো এক বেলা খাওয়া হয় না। সরলা মনে মনে ভাবে এভাবে চলা সম্ভব নয়। তাকে কিছু রোজগার করতে হবে, কিন্তু কি করবে বুঝতে না পেরে সেই অশোকের শরণাপন্ন হয়। সে জানতো অশোক তাকে ফিরিয়ে দেবে না। অশোক বদ লোক, সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। অশোকের সাহায্যে সরলার সংসার মাস দুই চলতে থাকে, স্বাভাবিক ভাবে একজন বিধবার সাথে একজন পুরুষের মেলামেশার ফলে তাদের মধ্যে সম্পর্ক আগের তুলনায় দৃঢ় হয়। এরপর তারা ঠিক করে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে এবং সম্পূর্ণ নতুন ভাবে জীবন গড়ে তুলবে। কিন্তু, মাঝখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বিশ্বজিৎ। অশোকের মতে বিশ্বজিৎকে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়া যাবে না, কিন্তু সরলা নিজের ছেলেকে ফেলে পালাতে রাজি হয়নি।
কিন্তু, কিছু দিন পরে সরলা ভেবে দেখলো কি লাভ এই ভাবে গ্রামে পড়ে থেকে বিধবার জীবন যাপন কাটিয়ে, বিধবাদের যে সমাজে কেউ ভালো চোখে দেখে না। সারাজীবন বদনাম মাথায় করে নিয়ে বেরোনোর থেকে যার সাথে বদনাম রটেছে তার সাথে নতুন করে জীবন শুরু করাই শ্রেয়। কেউ জানতেই পারবে না তার পুরানো জীবন। নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার আশায় সন্তানের মায়া ত্যাগ করে অশোকের হাত ধরে গৃহ ত্যাগ করে সরলা।
তিন
একে বয়স হয়েছে তার ওপর মানসিক চিন্তায় ভারাক্রান্ত, সব কিছু মিলেমিশে শচী দেবীকে আরো জড়বস্তুতে পরিণত করে, তাও কিন্তু শচী দেবী ভেঙে পড়েননি। তার শেষ সম্বল- তার বিশু। বিশুকে বড় করতেই হবে, সেই দৃঢ় মানসিকতার উপর নির্ভর করে লোকের বাড়িতে কাজ, কখনো বা বাজারে শাক-পাতা, কচু, ঘেটু হেঁকে হেঁকে বিক্রি করেছেন। বয়স যত হয়েছে জীবনে বাঁধা ততো বেড়েছে। সব বাঁধা অতিক্রম করে, তার বিশুকে বড় করে তুলেছেন।
পনেরো বছর ধরে শচীদেবী নাতিকে বুকে করে জড়িয়ে রেখেছেন, শত কষ্টের মধ্যে নাতিকে আঁকড়ে ধরে বড় করেছেন। কিন্তু বার্ধক্যের কাছে কোনো কিছুই জয় লাভ করতে পারে না, বার্ধক্য সব সময় জয়ী হয়। এছাড়া সংসারের অভাব, হাজার অশান্তি, মানসিক অস্থিরতা সব কিছুর মাঝে আজ নাতির কোলে মাথা রেখে নাতির কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন শচীদেবী। বিশ্বজিতের দু’ চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে, আর চিৎকার করে কাঁদছে। আজ যে সে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ির কমলা কাকিমা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করে,
কি হয়েছে রে বিশু?
ভাঙা ভাঙা স্বরে উত্তর দেয় ঠাম্মা… ঠাম্মা.. আর নেই কাকিমা….
ঠাম্মা কিছুদিন ধরেই অসুস্থতায় ভুগছিলেন তা কাকীমা জানত। তাই কোনো উত্তর না করে ছুটে গিয়ে কাকাকে ডেকে আনে।
কমলা, সম্পর্কে বিশুর কাকীমা হয়, প্রায় একই সময়ে বিশুর মা সরলা এবং কমলার একই পাড়াতেই বিয়ে হয়। তাই পাশাপাশি বাড়ি থাকার কারণে ধীরে ধীরে কমলা সরলার বন্ধু হয়ে ওঠে। গ্রামে গঞ্জে এই রকম সম্পর্কে একে ওপরের দিদি বলে ডাকে কেউবা সমবয়সী হওয়ায় ভালোবাসার খাতিরে নাম ধরে ডাকে। সরলার বাড়ী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কম বেশি কমলা বিশুকে দেখে। শচী দেবী কাজের জন্য মাঠে ঘাটে চলে গেলে কমলার কাছে বিশু বেশি সময় থাকতো। তাই কমলা কাকীমা বিশুকে খুবই ভালোবাসে ।
ঠাম্মাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে চিতায় তুলে মুখে আগুন দিয়ে কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে বিশু কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমার কেউ নেই কাকিমা, আমি একা হয়ে গেলাম”
কাকিমা বিশুর মাথায় হাত রেখে বলে, “আমি তো আছি।”
কাকিমা বিশুকে খুব ভালোবাসত, বাবা- মা ছিলোনা বলে নিজের ছেলের মতই দেখত।
একমাথা ঝাঁকড়া চুল, উস্কখুস্ক দেহ নিয়ে রাত দিন বাড়িতে পড়ে থাকতো বিশু। কাকিমা, যা নিয়ে যেত তাই খেতো। কিন্তু, এই ভাবে তো চলা অসম্ভব, সবার অভাবের সংসার; তারপরে ওর সারাজীবন পরে রয়েছে, ও করবে কি? এইভাবে একা একা বাড়িতেই বা কদিন থাকবে? সবকিছু চিন্তা করে কাকীমা কাকাকে একদিন বলে, “বিশুর জন্য একটা কাজ দেখো না, ছেলেটা এভাবে কি করে কাটাবে।”
ঠিক আছে, দেখছি বলে কাকা চলে যায়।
দিন দুয়েক পরে কাকা কাকিমাকে বলে, “বুঝলে একটা কাজের খোঁজ পেয়েছি, বিশুর জন্য।”
– কি কাজ? কোথায়? কাকিমা আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে।
– দোকানের কাজ, কিন্তু..
– কি কিন্তু?
– অনেকটাই দূরে, কলকাতা শহরে।
শহরের নাম শুনে চুপ করে যায় কাকীমা, একা একা শহরে কি করে থাকবে? কিছুক্ষণ চিন্তা করে, তারপরে বলে দূরে তো কি হয়েছে? কত লোকে এখান থেকে শহরে কাজের জন্য যায়। ও না হয় কষ্ট করে থাকবে ওখানে, ওতো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, বাইরের জগৎটাকে চিনতে পারবে। তুমি কাজের কথা পাকা করে ফেলো।
– আগে তুমি ওকে জিজ্ঞাসা করো যে ও কাজ করবে কি না।
– হ্যাঁ, করবে। আমি বললে ও ঠিক করবে।
– তাও, একবার ….
-ঠিক আছে ,একবার জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি।
কাকীমা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে দেখে বিশু ঘুমাচ্ছে, ঘরের যেখানে দুপুর বেলা খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে পড়ে রয়েছে। না ডাকাডাকি করে ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় ঘুম ভেঙে যায় বিশুর।
– কে, কাকিমা?
– জেগে আছিস?
– হ্যাঁ
– খাসনি কেন?
– ভালো লাগছে না।
– ভালো লাগছে না, বললে হবে, খেতে তো হবে।
কাকিমা জোর করে পাশে বসিয়ে খাইয়ে দেয়। খেতে খেতেই বিশু বলে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো কাকীমা?
– কি কথা?
– আমার মা কে কাকিমা?
কথাটা শুনে করুণ ভাবে বিশুর দিকে চেয়ে থাকে কাকিমা এবং উত্তর দেয়,
– জানিনা রে বাবা।
সব কিছু জানত কমলা, তাও উত্তর দিতে ভরসা পায়নি। বিশু যখন একদম ছোট তখনই সরলা তাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছে এ সব কথা তার জানা, সরলার সাথে কমলার ভালো সম্পর্ক ছিল, পাশাপাশি বাড়ি ছিল তাই কথাবার্তা ভালোই হতো।
খেতে খেতে বিশু বলে, না মাঝে মাঝে এসব কথা চিন্তা হয়, যদি কখনো মা কে সামনে পেতাম একটাই প্রশ্ন করতাম,
“মা, আমাকে জন্ম দিয়েছিলে কেন?”
কথাটা শুনে কাকিমা আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেনি। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। কমলা জানে মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, সেও একজন স্নেহাশীলা মা, মায়ের সব থেকে বড় সম্পদ হলো তার সন্তান; সন্তানের সুখ মায়ের সুখ। কোন নারী তখনই সবচেয়ে খুশি হয় যখন সন্তানের মুখে মা ডাক শুনতে পায়।
কাকীমা শুধু মৃদু স্বরে উত্তর দেয়, থাক না বাবা ওসব কথা।
ওদিন কাজের কথা বলতে পারেনি, তাই পরের দিন গিয়ে বলে,
বিশু, তোর কাকা তোর জন্য একটা কাজ দেখেছে।
– আমি কাজ করবো না।
– করবো না বললে হবে, কিছু তো করতে হবে। তা না হলে নিজের পায়ে দাঁড়াবি কিভাবে? সব সময় কি আমি থাকবো তোর পাশে?
– আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না কাকিমা।
– ছেড়ে যেতে কে বলেছে, তুই কাজ করবি, বড় হবি, মাঝে মাঝে আমাদের দেখতে আসবি। তারপর বিয়ে করবি, সংসারী হবি।
কাকীমা, বিশুকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে কাকার সাথে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়। যাবার আগে বলে যায়, “আমি আবার ফিরে আসবো কাকীমা তোমার কাছে।”
চার
কাকা বিশুকে দোকানে রেখে দিয়ে বাড়ি চলে যায়। একটি বিস্কুট দোকানে বিস্কুট বিক্রি করা ছিল বিশুর কাজ, দোকানদার প্রথম কিছুদিন বিশুকে নিজের বাড়িতে রেখেছিল। কিন্তু, শহরে কে বা কার কথা রাখে, সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। বিশু ছিল একটু খাম খেয়ালিপনা স্বভাবের। কখন যে ও কি ভাবে তা কেউ বুজতে পারতো না। বেশির ভাগ সময় একা একা থাকতো। দোকানদারের মনের মতো সে হয়ে উঠতে পারে নি। তাই , কিছু দিন পর নিজের আশ্রয় নিজেকে খুঁজে নিতে বলে মালিক।
একগুঁয়ে ধরনের ছেলে ছিল বিশু। কোথায় যাবে, কিভাবে থাকবে তার কিছুই জিজ্ঞাসা না করে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে। রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে মনে মনে ভাবে, এখন কী করবে? কোথায় থাকবে?
শহরের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত নতুন নতুন জিনিস দেখে সে। সুন্দর ঝাঁ চকচকে রাস্তা, যেখানে বর্ষাকালে কাদা হয় না; রাস্তার ধারে কত আলো, কিবা রাত কিবা দিন বোঝার উপায় নেই, চারিদিকে কত লোক… গ্রামের দিকে একটা মেলাতেও এত লোক একসাথে দেখা যায় না। চারিদিকে সুন্দর সুন্দর দোকান, সুন্দর সুন্দর গাড়ি, এসব দেখতে দেখতে ভাবে তার যদি এমন একটা গাড়ি থাকতো। কিছুক্ষণ পর নিজেই আবার বলে, যার নিজের থাকার জায়গায় নেই তার আবার গাড়ি-বাড়ির স্বপ্ন ।
আরো কিছুটা হাঁটার পর একটা জায়গায় বসে ভাবে তার এসব কিছুই লাগবে না তার কাছে তার গ্রাম অনেক ভাল, অন্তত থাকার জন্য একটা কুঁড়ে ঘর ছিল। ভাবতে থাকে তার গ্রামের কথা —- তার কাছে সব থেকে প্রিয়জন তার ঠাম্মা। ঠাম্মা যদি আজ বেঁচে থাকতো হয়তো তাকে এখানে আসতে হতো না, বারবার যেন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠাম্মার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো। ঠাম্মা তাকে বকতো, জোর করে বাজারে পাঠাতে কিন্তু সেসবের মধ্যে ছিল ভালোবাসার ছোঁয়া। আজ তার বকার কেউ নেই, মারারও কেউ নেই; বড় একা, নিঃসঙ্গ সে। চারিদিকে কত লোকের কত কোলাহল–অথচ সে নিজে বোবা। সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র সময় কারোও নেই। সবাই নিজের জন্য ব্যস্ত।
একটু আশ্রয়ের জন্য সারা শহরের রাস্তার দিকে ছুটে চলেছে বিশু। এমন যানবাহন চালিত রাস্তায় চলার অভ্যেস নেই তার। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পিছন থেকে একটা গাড়ি ধাক্কা মারে বিশুকে।
মা! বলে চিৎকার করে লুটিয়ে পড়ে রাস্তার উপর মাথা, নাক, মুখ দিয়ে তীব্র গতিতে রক্ত ঝরতে থাকে, তারপর আর কোন সাড়া শব্দ নেই।
তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন এক ভদ্রমহিলা। বিশুকে সন্তানের মতো করে কোলে তুলে হসপিটালে ভর্তি করেন ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলার সারা শরীর রক্তে ভিজে যায়।
বিশুর কাছে দোকানের একটা কার্ড ছিল সেই কার্ড দেখে দোকানে খবর দেওয়া হয়, সেখান থেকে খবর পৌঁছে যায় তার কাকীমার কাছে।
একটুও দেরি করেনি কাকিমা, কাকাকে সঙ্গে করে যত দ্রুত সম্ভব এসে পৌঁছলো।
হসপিটালে ঢুকে রক্তমাখা মহিলাকে দেখে চমকে উঠে কমলা, বিস্ময় ও হতাশা নিয়ে মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখে না, চিনতে একটুও ভুল হয়নি। এ যে সরলা, বিশুর গর্ভধারিণী মা। সরলাও চিনতে ভুল করেনি কমলাকে। তাদের পাশাপাশি বাড়ি ছিল, পনেরো বছর আগে ঘর ছেড়ে চলে এলেও, আজও সব কিছু স্পষ্ট মনে আছে সরলা।
কমলার কথা বলার সময় ছিল না সরলার সাথে, ছুটে যায় বিশুর কাছে। কিন্তু, অনেক আগেই সব শেষ, ডাক্তার বিশুকে মৃত বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
বিশুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে কাকিমা, “তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বিশু, আমি তোকে জোর করে কাজে পাঠিয়েছিলাম। তার পরিণাম তুই আমাকে এইভাবে দিবি আমি ভাবতে পারিনি, তুই বলেছিলিস, ‘আমি তোমার কাছে ফিরে আসব কাকিমা’, তুই আমার কাছে ফিরে আসিস বাবা, আমার গর্ভে” বলতে বলতে মুখ আঁচল দিয়ে চেপে বাইরে বেরিয়ে আসে।
বিশুর মা সরলা বিশুকে ফেলে রেখে অশোকের হাত ধরে চলে এসেছিল এই শহরে। অশোক চিরকাল বদবুদ্ধির লোক। সরলাকে সঙ্গে করে এনে মাস ছয়েক পরে সরলাকে ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যায়। ছেলের কথা মনে পড়লেও গ্রামে ফিরতে পারেননি সরলা, গ্রামের মানুষের মাঝে কি ভাবে মুখ দেখাবে সেই ভয়ে। কলকাতা শহরেই থেকে যায়। এ শহরে টাকা উপার্জনের বহু উপায় রয়েছে, নিজের ইচ্ছা মতো পথ বেছে নিতে পারলেই হলো। দেখতে-শুনতে ভালো ছিল সরলার। রূপের অহংকার এখন আর নেই, নিজের দেহের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছে তার। তাই এই দেহকেই মেলে ধরে অর্থ রোজগারের সিদ্ধান্ত নেয় সে। মাস গেলে ভালো আয় হতো, আর বর্তমানে সে তো পতিতালয়ের একজন লিডার এ পরিণত হয়েছে । কলকাতার মতো শহরে থেকে গাড়ি বাড়ি বানাতে তার একটুও অসুবিধা হয়নি। গাড়ী,বাড়ী সব থাকলেও মনে কোনো শান্তি ছিল না সরলার।
অর্থের অভাবে ভালো ভাবে খাওয়া হতো না, খিদের টানে ঘুম আসতো না, সর্বদা অশান্তির ঢেউ; আজ অর্থের পাহাড়ে ঘুমায় সে, পেটে খিদে নেই তবুও কিন্তু মনে শান্তি নেই ; আজও সেই ঢেউ তবে তফাৎ শুধু পরিস্থিতির।
কমলা ঘর থেকে বের হতেই সরলা এগিয়ে বলে,
– চিনতে পেরেছিস কমলা?
চোখের জল মুছে উত্তর দেয় কমলা,
-চিনতে পারবো না তোকে, তা তুই এখানে?
সরলা, কিভাবে হাসপাতালে উপস্থিত হল তার পুরো ঘটনা কমলাকে বলতেই, কমলা কিছুটা হাসি মুখে বলে, “বিধাতার কি পরিহাস, যার গর্ভে জন্ম তারই হাতে মৃত্যু, জন্ম – মৃত্যু একই কোলে।”
কথাটা সরলার মনে একটু খটকা লাগে, তাই একটু উত্তেজিত হয়ে বলে,
– কি বলছিস কমলা?
– পনেরো বছর আগে গ্রামের কথা মনে পড়ে তোর, কাউকে ফেলে এসেছিস?
কথাটা বুঝতে আর বাকি থাকল না সরলার, কমলার প্রতি উদ্দেশ্য করে বলে, আমার ছেলে.. বিশ্বজিৎ!
কমলা শুধু আস্তে করে ঘাড় নাড়ল।
সরলার ছুটে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল.. আমার বিশু! বাবা, চেয়ে দেখ বাবা, আমি — আমি তোর মা।
বিশুর কোন সাড়াশব্দ নেই, সে চুপ করে মায়ের কোলে চির নিদ্রায় নিদ্রিত। এ ঘুম যে তার আর কখনোই ভাঙবে না। এই প্রথম মাকে সামনে পেল,অথচ চোখ মেলে মাকে শুধু একটি বার দেখবে সে শক্তিটুকু কেড়ে নিয়েছে ঈশ্বর।
কমলা শুধু পিছন থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে, আর মনে মনে এটা ভেবে খুশি হচ্ছে যে অন্তত মরার পর মাকে কাছে পেয়েছে বিশু। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি দিতে পেরেছে।
সরলা চিৎকার করে কমলাকে বলে, “কমলা, বিশুকে শুধু একবার মা বলে ডাকতে বল।
উত্তর না দিয়ে থাকতে পারল না কমলা, সে বলে ফেললো, “সরলা, সন্তান জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, মা হতে গেলে দায়িত্ব পালন করতে হয়।”
মা, ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কমলার দিকে তাকিয়ে বলে , “কমলা, আমি বেশ্যা, বেশ্যাই থেকে গেলাম, ছেলেকে জন্ম দিয়েও মা হতে পারলাম না।”
প্রকৃতির স্বাভাবিক সামাজিক নিয়মে সন্তানের হাতে মায়ের শেষকৃত্য হওয়ার কথা, এক্ষেত্রে বিধাতার লীলাখেলার পরিণামে মায়ের হাতে সন্তানের শেষকৃত্য সম্পন্ন।