অন্তবিহীন পথ
-পারমিতা চ্যাটার্জী
প্রতিবারের মতো এবারেও অতনু এক তোড়া গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে এসে এণার হাতে দিয়ে, ওর কপালে একটা চুম্বন দিয়ে বলল,” হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে ডিয়ার।”
এণা জানে অতনু তার কর্তব্য সেরে দিল, এবার কত রাতে ভ্যালেন্টাইন্স ডের পার্টি সেরে ফিরবে তার কোন ঠিকানা নেই।
এণা সব জেনেও ইচ্ছা করে বলল, যাবে নাকি আজ রাতে ডিনার খেতে পার্কস্ট্রিটের রেস্তোরাঁয়? অনেকদিন যাইনি।
– তাচ্ছিল্য সুরে অতনু বলল, তোমার আবার এসব শখ কবে থেকে জাগলো?
– মানুষ কি বদলায় না?
– জানিনা, তবে আজ আমার সময় হবেনা। যদি একান্তই যেতে চাও তো কাল দেখবো।
মনে মনে এণা ভাবলো আমার বসন্তের বাগানে অনেকদিন টাটকা ফুল ফোটেনি, আজ যদি সেই আগের মতো এক টুকরো বসন্তের স্মৃতি খুঁজতে রাঙামাটির পুরনো পথে যাই, সে কি আমায় ফিরিয়ে দেবে? দেয় দেবে, কি আর করা যাবে, আজ পায়ের শিকলটা খুলে বেরিয়ে পড়ি ফেলে আসা দিনগুলিতে নতুন গন্ধ নিতে।
মাত্র দুু’ বছর তার বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যে অতনুর সুর কেটে গেছে। অবশ্য কোনদিনই সে তার মনের মতন হয়ে উঠতে পারেনি, এই কথা অতনু উঠতে বসতে অনেকবার শুনিয়েছে যে তাকে মানুষ করতে পারেনি। সে তথাকথিত লাস্যময়ী হয়ে উঠতে পারেনি এই আক্ষেপ সে প্রায়শই করে থাকে।
টেবিলে বসে গুছিয়ে একটি চিঠি লিখলো,
“তোমার মনের মতন হয়ে উঠতে পারলামনা, আমায় ক্ষমা করো। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার বাবা মায়ের কাছে, তোমায় মুক্তি দিয়ে গেলাম, এবার মনের মতন বউ ঘরে নিয়ে এসো। ভয় নেই কোন খোরপোষ দাবি করবো না। যেদিন ডিভোর্স পেপার পাঠাবে সই করে দেবো।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো তোমার ভবিষ্যত জীবনের জন্য।”
চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রেখে সুটকেস গুছিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ট্যাক্সির খোঁজে।
প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরে অতনু বেল বাজিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ দরজা খুলছেনা, বন্ধ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে সে দরদর করে ঘামছে; স্মিতার সাথে কথা বলতে গিয়ে তার খেয়ালও নেই যে এতোটা রাত হয়ে গেছে। স্মিতাও হয়েছে তেমনি মদ পেলে আকণ্ঠ পান না করলে তার আশ মেটেনা তাও আবার পরের পয়সায়, সত্যি আজ মেজাজটা একদম বিগড়ে গেছে, এণা কখনও কিছু চায়না, ভেবেছিল তাড়াতাড়ি ফিরে এসে তাকে সারপ্রাইজ দেবে কিন্তু স্মিতার পরেরপর ফোন করে করে তাকে সেই পাবে নিয়ে গিয়ে তবে ছাড়লো। মদ্যপ মহিলাকে তো একা রাস্তায় ছেড়ে দেওয়াও যায়না, কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে তখন সব দায় তার এসে পড়বে। তাকে তাই নিউআলিপুরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসতে হল।
এণা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকলো।
দরজার বেল শুনে এণার মা অর্পিতা দেবী তো মেয়েকে দেখে অবাক! কি রে তুই!
– এণা ম্লান হেসে বললো, কেন আসতে নেই?
– না না তা কেন? বোস বোস, একা একা চলে এলি না বলে, তাই বলছি সব ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ মা চলে এলাম, পারলাম না আর থাকতে।
– সে কি রে! কি বলছিস তুই? চলে এলাম মানে?
– চলে এলাম মানে চলে এলাম- ভয় নেই বেশিদিন তোমার বাড়িতে থাকব না, কিছু একটা ব্যাবস্থা করে তাড়াতাড়ি চলে যাবো।
– আমি কি তাই বললাম? আমি বলতে চাইছি, সংসারে থাকতে হলে মেয়েদের একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়, তুই বা ও যা চাইতো তা করতিস না কেন?
– মা তুমি বুঝতে পারছনা কেন?
মৃদুলা ঢুকলো ঘরে হাতে সরবতের গ্লাস নিয়ে, মৃদুলা এণার বউদি- শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বললো – মা ও অনেকটা পথ ক্লান্ত হয়ে এসেছে, আগে একটু বসতে দিন, জল খেতে দিন। তারপর না হয় জেরা করবেন।
– আমি জেরা করছি বলে তোমার মনে হয়?
– করছেনই তো; একটা মেয়ে কতোটা অপারগ হলে ঘর ছেড়ে চলে আসে – আপনি তো বুঝবেন মা – আর সব কিছু কেন ওকে মানিয়ে নিতে হবে? আর একজন কেন ওকে একটুও মানাবেনা? ও তো জলে পড়়ে নেই, ও শিক্ষিতা, যথেষ্ট গুণের, সেই গুণ যদি কেউ সমানে পায়ে দলে যায়, কেন ও অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেবে, আমায় বলতে পারেন?
এণা অবাক হয়ে বউদির মুখের দিকে চেয়েছিল।বউদির সাথে তার পরিচয় বেশি নেই, ওর বিয়ের কয়েকমাস পরে বউদি এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে, এবারও বাপের বাড়ি খুব একটা আসা হয়নি, তাই বউদি মানুষটাকে তার ভালো করে জানাই হয়নি। আজ উঠে গিয়ে বউদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তবু তোমার একটু সহানুভূতি পেলাম।
মৃদুলা বলল- “আমি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলি, সে যেই হোক, আর তুমি তো আমার অতি কাছের মানুষ, তোমার কষ্টটা বুঝবোনা? খুব ভালো করেছো চলে এসে। যে অপমান করে আর যে সহ্য করে দু’জনেই সমান অপরাধী। তুমি যে মনের জোর করে বেরিয়ে আসতে পেরেছ, এতে তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।
অতনু দরজা খুলে ঘরে ঢুকে কোথাও খুঁজে পেলো না এণাকে। হঠাৎ খুব চিন্তা হলো, কি হলো কোথায় গেল? ও চিৎকার করে ডাকলো, “এণা তুমি কোথায়? তুমি কি ওয়াশরুমে?
না শূন্য ঘর থেকে কোনো মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলোনা। হতাশ হয়ে ও বসে পড়লো খাটে, হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা চিঠিটার দিকে চোখ গেলো, তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলে পড়তে বসলো।
চিঠি পড়ে মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো, এতদূর! কি করে এতো সাহস হলো? আমায় পরীক্ষা করছে, ভাবছে আমি ওকে পায়ে ধরে সেধে আনতে যাবো! থাক ও ওখানে যতদিন পারে, আমি মোটেও ওকে আনতে যাবোনা। দেখি, কতদিন ও না এসে থাকতে পারে!
কিন্তু দিন চলে যায়, মাস গড়িয়ে যায়, বছরও শেষ হতে চললো কিন্তু এণা আর ফিরে এলোনা।
প্রথম দু’বছর অতনু কাটালো ব্যস্ত জীবন নিয়ে, অফিস, তারপর ক্লাব পার্টি এসবে মেতে থাকলো। একসময় সে ক্লান্ত হয়ে পরে, দিনের শেষে নিজের খালি বাড়িতে ঢুকে যখন দেখে কেউ তার জন্য অপেক্ষায় নেই, তখন এণার শান্ত মিষ্টি মুখটা সামনে ভেসে ওঠে।
এতো অভিমান যে ওই শান্ত মেয়েটার বুকে লুকিয়ে ছিলো, তা সে অনুভব করার চেষ্টা করেনি।
স্মিতার মধ্যে সে ভালোবাসা খুঁজে পায় না। শুধুই উচ্ছাস আর হাল্কা মনের চাহিদা, তা দিয়ে সত্যি কোন জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলা যায় না।
মনে মনে ভাবে এণা যদি একবার ফিরে আসে তবে আর তাকে চলে যেতে দেবে না কিছুতেই; কিন্তু এণা আর ফিরে এলোনা।
এণা এখনও তার বিবাহিতা স্ত্রী, সে এভাবে দিনের পর দিন তাকে ছেড়ে থাকতে পারেনা। কিন্তু নিজের দাবি নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেও পারেনা।
স্মিতা তাকে প্রায় বলে, “চলো ডিয়ার, এবার বিয়েটা করে ফেলি” অতনু নিশ্চুপ হয়ে থাকে, স্মিতাকে সে এ বাড়ির মালকিন হিসেবে ভাবতেই পারেনা। কিছু না হতেই যা কর্তৃত্ব ফলায়, মালকিন হলে তো তাকে হাতের দাস বানিয়ে ছাড়বে । এণার জন্য যে এতো আকুলতা বুকের ভেতর লুকিয়ে ছিল তা সে আগে কেন বুঝতে পারেনি! কেন তাকে বারবার অপমান আর তাচ্ছিল্য দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখতো।
অতনু নিজেকে একদম বদলে ফেললো, বুঝলো এসব হৈ-হুল্লোড় একটা বয়স অবধি ঠিক আছে, তারপর মানুষ চায় দিন শেষে একটা শান্ত ভালোবাসার নীড়, যে নীড়ে স্বপ্ন গাঁথা আছে, কল্পনা আছে, ভালোবাসা আছে আর টুকটাক মান অভিমান, এবং তা মিষ্টি ভালোবাসায় সেই অভিমানকে ভাঙিয়ে আবার কাছে টেনে নেওয়ার এক বাসনা।
স্মিতার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল অফিস শেষে একা ঘরে তন্ময় হয়ে শুনতো রবীন্দ্রসংগীত; একদিন এই গানের জন্য এণাকে কতো না ছোটো করেছে সবার সামনে— আজ সেই গানই তার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ালো। গলা মিলিয়ে নিজেও গাইতো, “এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে..” এই গানটা এণা খুব গাইতো, এক একদিন সে নিজেও খুব তন্ময় হয়ে শুনতো, কিন্তু যেই এণা তাকে দেখে গান থামিয়ে দিতো তখন তার অভিমান বিদ্বেষের রূপ নিতো।
আজ রবীন্দ্রসংগীতের কিছু নতুন সিডি কিনতে গিয়ে দেখে, এণাক্ষ্মী ভট্টাচার্যের সিডি। অবাক হয়ে তুলে নিল হাতে সিডিটা। দোকানদার বললো ইনি এখন বেশ নাম করে গেছেন, শান্তিনিকেতনের মানুষ, এখন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত, ওঁর ডেট পাওয়া যায়না।
এবার বসন্ত উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্র সদনে প্রোগ্রাম করতে আসছেন, টিকিট চাই আপনার?
– হ্যাঁ আছে আপনার কাছে?
– সব শেষ হয়ে গেছে আর দু’টোই আছে পড়ে।
– দিন তাহলে একটা।
অতনু টিকিট নিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগলো, “তুমি তো জিতে গেলে এণা, নিজেকে প্রমাণ করেছো, আমার অপমান বিদ্রুপের উপযুক্ত জবাব দিয়ে দিয়েছ, কিন্তু জানো এই পরাজয়তে আমার কোনো গ্লানি বোধ হচ্ছেনা বরং এক নির্মল আনন্দে ভেতরটা ভরে উঠছে! অভিনন্দন এণা, অনেক অনেক অভিনন্দন।”
প্রোগ্রামের দিন অনেক আগেই অতনু চলে গেলো, যাতে প্রথমে বসার সুযোগ পায়। স্মিতা তাকে ফোন করে বসন্ত উৎসব সেলিব্রেট করার জন্য ফোন করেছিল, কিন্তু সে বলে দিয়েছে আজ তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়, হয়তো আর কোনদিনই যাবেনা, এসব ক্ষণিকের আনন্দে তার আর রুচি নেই। স্মিতা অবাক হয়ে বলেছিল, “তুমি দেখছি বউয়ের শোকে বিবাগী হয়ে যাচ্ছ!”
অতনু নির্লিপ্ত জবাব দিয়েছিল, “কি হচ্ছি জানিনা, তবে আমাকে আমার মতন থাকতে দিলে আমি খুশি হবো”।
স্মিতা বলেছিল, “আমার সাথে কি সম্পর্ক রাখতে চাওনা আর?”
– “তুমি তো বিবাহিতা?”
– “হ্যাঁ বিবাহিতা জেনেই তো এগিয়েছিলে!”
– “ভুল করেছিলাম, ভীষণ ভুল, আমি দুঃখিত স্মিতা, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য, পারলে ক্ষমা করে দিও।”
– “বউকে যদি এতো ভালোই বাসতে তবে আমার দিকে এগোলো কেন?”
– “তুমি বলো তো তুমি কি আমায় সত্যি ভালোবাসতে না আমার সঙ্গটাই শুধু উপভোগ করতে?”
– “আমি অতো জানিনা -“
– “আমি জানি, আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসিনি। শুধু সঙ্গটাই উপভোগ করে এসেছি, নতুন সঙ্গী এলে তোমার আমাকে ভুলে যেতে দু’দিনও সময় লাগবে না।”
স্মিতা আর কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো আর অতনু নিশ্চিন্ত হলো।
আজ এণার প্রোগ্রাম, সকাল থেকেই অতনু খুব উত্তেজিত, বিকেলে পড়ে যাবার জন্য এণার পছন্দ করে আনা একটা পাজামা পাঞ্জাবীীর সেট বার করলো। দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে খুব যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে এণা এটা কিনে এনে হরিণ চোখ দু’টো তুলে অতনুর মুখের দিকে চেয়েছিল, অতনু অবহেলায় সেটা বিছানায় রেখে, বম্বে থেকে আনা একটা বহুমূল্য সিফন শাড়ি ওর দিকে ফেলে দিয়ে বলেছিল, “এটা তোমার গিফট।”
এণার মনটা পড়ার চেষ্টা করেনি কখনও। অতনু তো এণাকে কখনও বারতি টাকা দেয়নি, ও ওর গানের টিউশনির টাকা থেকে সাধ্য মতোন কিনে এনেছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় স্মিতার দেওয়া ভালো ব্র্যান্ডের দামী সার্ট পরে স্মিতার সাথে মদের গ্লাস নিয়ে চিয়ার্স বলে সন্ধ্যা কাটিয়েছিল আর স্মিতাও সেদিন পরেছিল তারই এনে দেওয়া এণার চেয়েও অনেক দামী শাড়ি।
এণাকে দেখিয়ে স্মিতা বলেছিল, “এটা অতনু আমায় এনে দিয়েছে।”
এণা চোখের জলকে গোপন করে ঢোঁক গিলে সব অপমান হজম করেছিল।
এবার তার পালা, তবে এই পরাজয়কে সে জয়ের মালা হিসেবেই নিয়েছে। তার বাবা মা ভুল করেনি, ঠিকই করেছিলেন এণার মতন মেয়েকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে দিয়ে, বিশেষ করে মা।
সেদিন সে এণাকে বুঝতে পারেনি, খুব সাদামাটা একটা শান্ত সাংসারিক মেয়ে হিসেবেই ভেবে এসেছে। এণার শান্ত স্নিগ্ধ রূপের মধ্য উন্মাদনা না থাকলেও সৌন্দর্য ছিল অসীম, সে সৌন্দর্যের মর্যাদা সে সেদিন দেয়নি।
প্রথম জীবনে তার মা’ও একই ভাবে বাবার কাছে অসম্মানিত হয়েছিলেন, তার বাবাও তার ভুল বুঝতে পেরে মাকে সম্মানের মালা পরিয়ে সংসারে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাবা তাকে বলেও ছিলেন, “বাবু যে ভুল আমি করেছি তা তুই করিস না। চকচক করলেই হীরে হয় না, তোর মায়ের প্রতি আমিও অবিচার করেছিলাম চরম, তাকে ফিরিয়ে এনেছি ঠিকই, কিন্তু তার মায়ের মনে যে কঠিন অভিমানের প্রাচীর তৈরি হয়ে গেছে তা আমি অনেক চেষ্টা করেও ভাঙতে পারিনি।”
সেও হয়তো পারবে না এণার মনের অভিমান আর
অবহেলার প্রাচীরটা ভেঙে ফেলতে! জানেনা সে পারবে কি না! তবু চেষ্টার ত্রুটি করবে না।
দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেলো অতনু নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে চললো অনুষ্ঠানে, এণার দেওয়া সেই সাজে, যে সাজ সে একদিন চরম অবহেলায় ফেলে রেখেছিল আজ সেই সাজেই নিজেকে সাজালো। এণার হয়তো মনে নেই কিন্তু আজ অষাঢ় মাসের সেই দিন, যে দিনে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। মাত্র দু’বছরে সেই বন্ধন কাটিয়ে এণা চলে গিয়েছে।মাঝখানে চলে গিয়েছে আরও পাঁচটা বছর।
অনুষ্ঠান আরম্ভ হল সমবেত সঙ্গীত দিয়ে তারপর সভাপতির ভাষণ। অতনু অস্থির হয়ে উঠছিলো কখন তার এণা আসবে।
এণার নাম ঘোষণার সাথে সাথেই অতনু সোজা হয়ে বসলো, সে সামনের দিকে সিটেই বসেছিল, অনেক আগে এসে গিয়েছিল তাই সামনের দিকে সিট পেয়ে গিয়েছিল।
এণা ঢুকলো সাদার ওপর হাল্কা পিঙ্ক রঙের গোলাপি ও সোনালি রঙ দিয়ে কাজ করা শাড়ি, তার গায়ের রঙের সাথে মিশে গিয়েছে। অদ্ভুত স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছিল তাকে দেখতে।
একের পর এক গান গেয়ে যেতে লাগলো এণা। প্রত্যেকটা গান অতনুর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করছিল। এখন সেও যে রবীন্দ্রসংগীত শিখছে, আজ অনেকদিন হয়ে গেলো কলকাতার একজন নামকরা রবীন্দ্রসংগীত গায়কের কাছে শিক্ষা নিচ্ছে মন প্রাণ ঢেলে।
সবই বিরহের গান গাইছ এণা, তার মানে এণার মধ্যেও প্রবল বিরহ যন্ত্রণা।
শেষ গানটি গাইল, “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে…”
মনে হল সমস্ত হৃদয় নিংড়ে যেন গানটি পরিবেশন করছে। অতনু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে ওর বড়ো বড়ো কালো চোখ দু’টো জলে ভরে আসছে। গান শেষ হবার পর হাততালিতে হল ফেটে পড়ছে, এণা বেরিয়ে যাচ্ছে বিজয়িনীর ভঙ্গিতে।
এণা বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তায়, ওর সঙ্গের ছেলেটি বলছে, “দিদি ট্যাক্সি ডেকে দি?”
এণা উত্তর দেবার আগেই অতনু এগিয়ে এলো হাতে নানান রঙ দিয়ে সাজানো গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে, এণা নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে।
-অতনু ওর হাতে গোলাপ গুচ্ছটি তুলে দিয়ে বললো, “তুমি জিতে গেছো এণা আর আমি হেরে গেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর এণা, এ হার যেন আমাকে নতুন করে দিল, তোমার দেওয়া আঘাতেই আমার জয়ের মালা, আমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি।”
– এণা ফুল হাতে নিয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো অতনুর চোখে এক অদ্ভুত আকুতি। অতনু বলল, “অসাধারণ গান শুনলাম আজ, হয়তো আগেও শুনতে পারতাম কিন্তু তখন শোনার বা বোঝার মতন মন বা অনুভূতি কোনটাই আমার ছিলো না।
এণা মাটিতে চোখটা নামিয়ে নিয়ে বললো, “আজ হয়েছে?”
“হ্যাঁ, এণা এখন আমিও যে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করে তার রস গ্রহণ করতে পেরেছি।”
– “তুমি রবীন্দ্রসংগীত!”
এণার অবাক প্রশ্নের উত্তরে অতনু বললো, “হ্যাঁ, আমি, আমি এখন তোমার গানই গাই আর তোমার মনের মতন করে তোমার ফেলে আসা ঘরটা সাজিয়ে রাখি।” একবার ফিরবে কি সেই ফেলে আসা পরিত্যক্ত ঘরটায়? শুধু দেখে যাও সে ঘরের পরিবর্তনটা।
চল এণা একবার চল, শুধু ঘরটা দেখতে, আমার এতদিনের অপেক্ষা ছিলো শুধু এই যে, আমি আমার বদলে যাওয়া নতুন আমিটাকে তোমার সামনে তুলে ধরবো বলে আমার এই অপেক্ষার পূর্ণতাটুুুকু অন্তত দাও!”
হঠাৎ কোথা থেকে দমকা ঝড় উঠলো, বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। অতনু এবার হাত ধরে টেনে বললো “চলো গাড়িতে উঠি, ভিজে যাবে যে,”
এণার বলতে ইচ্ছে করছিল, “জীবনে প্রথম যেন বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তোমাকে আর আমাকে ..”
কিন্তু মনের কথাটা মনেই থেকে গেলো বলতে পারলো না, শুধু যন্ত্রচালিতর মতন অতনুর হাতটা ধরে বলল, চলো।
বহুদিন পর অতনুর সাথে গাড়িতে ছুটে চলেছে এণা।
অতনু গান চালিয়ে দিয়েছে,” মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ, আসিতে তোমার কাছে..”
বাইরে তখন প্রবল ঝড় আর তার সাথে তুমুল বৃষ্টি,
আর গাড়ির ভেতরে চলছে গান, আজ গানের সাথে দু’জনেই গলা মিলিয়ে গাইছে, “মনে হল, যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ… “