“রাজবাড়ির রহস্য “
– রাখী চক্রবর্তী
“আয় ঘুম যায় ঘুম দত্ত পাড়া দিয়ে”
ঠিক রাত দশটার সময় এই গানটার হাল্কা সুর ভেসে আসে রাজবাড়ির অন্দর মহল থেকে। আমি এক সপ্তাহ হল মাসির বাড়ি বেড়াতে এসেছি। রোজই ঠিক রাত দশটা বাজলে আমি ছাদে চলে আসি। আর এই গানের কলি আমার চোখে নিদ্রা নিয়ে আসে। আসলে আমি খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ি। আবার রাত দু’টোর ঘরে কাঁটা না গেলে আমার ঘুম আসে না। এখানে দেখি সব উল্টোই হচ্ছে। যাইহোক, আমাকে সবাই চেনে ফটোগ্রাফার হিসাবে। আমার মাসির ননদের বিয়ে। তাই আমার এখানে আসা। কৃষ্ণনগরে আমি এই প্রথম এলাম। কিন্তু আমার কেমন যেন লাগে রাত হলেই। কিছু বুঝতে পারছি না। ছাদ আমার বরাবরই প্রিয়। তা বলে ছাদেই খাব ছাদেই ঘুমাবো এমনটা নয় কিন্তু।
আজ সকাল দশটার সময় আমার ঘুম ভাঙল। সবাই তখন জলখাবার খাচ্ছে। মাসি ও বাড়ির সবাই বলাবলি করছে কি অদ্ভুত ছেলেরে বাবা! রাতবিরেতেও ফটো তুলতে ব্যস্ত? আর বেলা দশটা বেজে গেল এখনও নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
সুপ্রভাতের শুভেচ্ছা জানিয়ে আমি সবাইকে বললাম রাতের বেলায় আমি কোনও ফটো তুলিনি। রাত দশটার মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মেসোমশাই বললেন, তাহলে কাল রাত এগারোটায় আমার সাথে রাজবাড়ির অন্দর মহলে কে গেছিল? তুমি না অন্য কেউ?
– আমি তো যাইনি।
– ফটো তুলেছো অনেক। ক্যামেরাটা দেখো একবার।
আমি ক্যামেরা চেক করে দেখি রিল ফুল আছে। কাল সকালে রিল ভরলাম। একটাও ফটো তুলিনি। পরশু সুমিতাদির আইবুড়ো ভাত, তাই রিল ভরে রাখলাম। কিন্তু মেসোমশাই কি যা তা বলছে!
মাসি আমাকে লুচি তরকারি দিয়ে বলল-
ওই রাজবাড়ির ত্রিসীমানাতে পা রাখবি না। ভাগ্যিস তোর মেসো কাল রাতে বাথরুম যাবার সময় তোকে সদর দরজা দিয়ে বের হতে দেখেছিল। তা না হলে আমরা তো কিছু জানতেই পারতাম না। তুই রোজ যাস তাই না? কাল ধরা পড়ে গেলি। ভুতুড়ে বাড়ি বুঝলি। কখনও যাবি না ওই দিকে।
আমি চুপচাপ মাসির কথাগুলো শুনে গেলাম।
খাবারগুলো আর খেতে ইচ্ছে করল না। ক্যামেরা নিয়ে ফটো তুলতে লাগলাম রাজবাড়ির। দিনের আলোতে রাজবাড়িটা কি সুন্দর লাগে। রাতে একদম ঝিমিয়ে যায়।
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে যাস না বাবা, ওই রাজবাড়িতে ভুত আছে। আমরা এখানে থাকব না, চল বাড়ি ফিরে যাই। তোর যদি কোনও বিপদ হয়।
মাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম কিছু হবে না। খামোখা ভয় পাচ্ছ তুমি।
আজ দুপুর বেলার আকাশটা দেখার মতো।
টুকরো টুকরো কালো মেঘ এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে সাদা ও হাল্কা নীল রঙ আকাশটাকে মোহময়ী করে তুলেছে। এই সময় আমাকে ঘরে রাখে কার সাধ্যি আছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে রাজবাড়ির দিকে রওনা হলাম।
বিশাল বড় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রাজবাড়ির ত্রিসীমানা।
পাহারাদার তো কেউ নেই। দরজা খুলে ভেতরে গেলাম। গা ছমছম করছে। অন্দর মহলে ঢুকে গেলাম। রাজকন্যা শিমুলের ঘর। শিমুলের ছবি টাঙানো আছে। কি যে রূপ তার, তা বর্ণনা করা সম্ভব না।
একটু ধাক্কা দিতেই ক্যাচক্যাচ আওয়াজ করে রাজকুমারী শিমুলের ঘরটা খুলে গেল। না, কোন বাদুড় বা পায়রা উড়ে গেল না। কোন গুমোট গন্ধও নেই। তার মানে এই ঘরে নিয়মিত প্রবেশ করে কেউ।
ঘর ভর্তি শিমুলের ছবি। বিছানায় ভর্তি রজনীগন্ধার স্টিক। তাজা, কি সুন্দর গন্ধ। মনটা ভরে গেল।
হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে আমি আলমারির পেছনে লুকিয়ে পড়লাম।
মাথায় পাগড়ি দেওয়া এক দেওয়ান এসে শিমুলের ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, শিমুল তোমার মুক্তি নেই। যতই রাতে গান করো। তোমার আত্মা শান্তি পাবে না। আমি তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবো না। আমার ছেলে পুড়ে মরেছে। কিন্তু তোমাকে পুড়িয়ে তোমার আত্মাকে আমি শান্তি দেব না।
আমি তাহলে ঠিকই গান শুনি। কিন্তু শিমুলের মৃত্যু হল কিভাবে? এই রহস্য জানতেই হবে আমাকে।
আমি শিমুলের ঘর থেকে বেরিয়ে প্রধান ফটকে এলাম। মাথায় পাগড়ি দেওয়া দেওয়ান বাগান পরিচর্যা করছেন। আমাকে দেখে আমার আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম রাজবাড়ির ফটো তুলতে এসেছি। আমি এখানে বেড়াতে এসেছি। আমার কথা শুনে উনি আপত্তি করলেন না। ধীরে ধীরে কথার ছলে আমি ওনার ছেলের প্রসঙ্গে এলাম, তাতে শিমুলের নাম চলে এল। পলাশ শিমুলকে খুব ভালবাসত। কিন্তু শিমুলের অহঙ্কার কখনই পলাশ মেনে নিতে পারেনি।
একদিন বিয়ের প্রস্তাব দিল পলাশ শিমুলকে। শিমুল তো রেগে আগুন। ঝাড়লন্ঠন ছুড়ে মারল পলাশকে।আমার ছেলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল আমার চোখের সামনে। তবে আমিও বদলা নিয়েছি শিমুলের দেহকে টুকরো টুকরো করে কেটে ওরই আলমারিতে রেখে দিয়েছি। রোজ ওর ঘরে আমি যাই। রজনীগন্ধার স্টিক ওর বিছানায় রেখে আসি, পলাশের জন্য। কেউ শিমুলের আত্মাকে শান্তি দিতে পারবে না। এই রাজবাড়ির ত্রিসীমানায় কেউ আসতে পারবে না। রোজ রাতে শিমুলের আত্মা আসে। সবাই ভয় পায় এই রাজবাড়িতে ঢুকতে।
– তাহলে উত্তরসুরি কেউ নেই এই রাজবাড়ির?
– আছে সব আছে। বছরে একবার তেনারা আসেন।বিদেশে সবাই আছেন। শিমুলের দাদা, বৌদি, মা। আমি দেখাশোনা করি এই রাজবাড়ি। শিমুলের মৃত্যু রহস্য আজও অজানা সবার। তেনারা শিমুলের মৃতদেহ আজও খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
– কোন সময় আসেন ওনারা এখানে।
– দুগ্গা পুজোর সময়। ঐ বছরে একবার।
মনে মনে বললাম আর মাত্র দু’ মাস।
– সাহেব এ রহস্য প্রকাশ্যে আনবেন না। আনলে বিপদ, মনে রাখবেন সাহেব।
– না না আমি দু’দিন পর চলে যাব। এখানে আর আসছি না।
বিদায় জানিয়ে আমি রাজবাড়ি পরিত্যাগ করব। এমন সময় আমার কানে কানে কে যেন বলছে, ‘মুক্ত করো আমায়। শান্তি দাও আমার আত্মাকে।’ আমি এক পা এক পা করে শিমুলের ঘরে দিকে গেলাম। ঘরের দরজা নিজে নিজেই খুলে গেল। আলমারির কপাট খুলে গেল। একটা কাপড়ের পুটলি ঝুপ করে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। আমি পুটলিটা খুলতেই হাড়গোড় শুদ্ধ একটা দেহ দেখলাম। শিমুলেরই হবে। ক্যামেরাতে অনেক ছবি তুললাম, পুরো দেহটা সেট করে। গলার নেকলেস, চুড়ি,কানের দুল, বাউটি।তারপর হাতের কাছে দেশলাই বাক্স দেখলাম। জ্বালিয়ে দিলাম। আগুনের লেলিহীন শিখায় শিমুলের হাড়গোড় পুড়ছে। শিমুলের অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে রাজবাড়ির দেওয়াল। এর মধ্যে মাথায় পাগড়ি দেওয়া দেওয়ান সবটা টের পেয়ে গেল। দাঁ দিয়ে আমার ঘাড়ে কোপ মারতে যাবে এমন সময় আমার মেসো, মাসি ,মা সবাই চিৎকার শুরু করে দিল। আমি জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান ফিরে দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ঘড়িতে রাত আটটা বাজে। সেই রাতে কোনো গান আমি শুনতে পাইনি। বিয়ে ভালো মতো মিটলো। আমি কোলকাতায় এলাম। শিমুলের হাড়গোড়ের ফটোগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছি। দু’ মাস পর কৃষ্ণনগর এলাম।রাজবাড়ি রঙ হচ্ছে। শিমুলের দাদা, মা, পঞ্চমীর দিন এল। ওনাদের হাতে শিমুলের ফটো দিয়ে দেওয়ানের কুকর্মের কথা সব বললাম। দেওয়ানের কোনো আফশোষ নেই। পলাশ ও শিমুল নাকি একই ছাদের তলায় আছে এখন। দেওয়ানকে দেখে কষ্ট তো হচ্ছেই।
কোলকাতা ফিরে এলাম। শিমুলের মুখটা আমার চোখের সামনে ফুটে ওঠে সব সময়। কথা বলি শিমুলের সঙ্গে। আমার ঘরে কেউ আচমকা ঢুকে পড়লে আলমারিটা একটু কেঁপে ওঠে, এমনিতে ভালো আছি। আমি ,শিমুল আর আমার ক্যামেরা। এই নিয়ে বেশ চলছে আমার দিন, রাত, আবার দিন…