ভাগ-নেয়
– লোকনাথ ভট্টাচার্য্য
রামবাবুকে মনে পড়ে। পুরো নাম রামচন্দ্র ভট্টাচার্য। মেট্রো গোল্ড মেয়ার কোম্পানিতে টাইপিস্টের চাকরি করতেন। সহকর্মীরা তাকে রামবাবু বলে সম্মোধন করলেও কোম্পানির বিদেশি সাহেবরা তার নামের থেকে পদবীকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। সাহেবরা রামবাবুকে ব্যাটারি চার্জ বলে ডাকতেন। সেটা ভট্টাচার্য্য উচ্চারণের অপারগতার জন্য, না রামবাবুর রসিকতার ব্যাটারি সবর্দা চার্জ থাকতো বলে তা বলতে পারব না।
এ হেন রামবাবু আমাকে একদিন বললেন, চল আমার মামাবাড়ী রসূলডাঙায়, মামার পুকুরে মাছ ধরতে যাবো।
আমার ছিপ ফেলে মাছ ধরার নেশা। তাই সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। মাছ ধরার সামগ্রী যেমন খৈলভাজা, পচা ঘি, একাঙ্গী, পিঁপড়ের ডিম,পাঁউরুটি আর হুইল ছিপ নিয়ে আমি এবং রামবাবু এক রবিবার রামবাবুর মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ট্রেনে যেতে যেতে রামবাবু মামার কৃপণতার নানান গল্প আমাকে শোনাতে লাগলেন। মামা হিরণ ঠাকুর চৌরঙ্গীতে যে বেসরকারি অফিসে কাজ করতেন তার উল্টো দিকে এক উড়িয়া ফুটপাতে চুল দাড়ি কামাতো। অনেক সহকর্মী সেখানে চুল দাড়ি কাটলেও মামা কখনোই ওই নাপিতের কাছে যেতেন না, মামার ধারণা ছিল শহরের নাপিত গ্রামের নাপিতের থেকে বেশি পয়সা নেবে। একদিন কৌতূহলবশত এক সহকর্মীর কাছে চুল দাড়ি কামানোর মজুরি কত তা জানতে চাইলেন। সহকর্মীটি মামার কৃপণতার কথা ভালভাবেই জানতেন, তাই তিনি অনেকটা কমিয়ে মজুরির কথা মামাকে বললেন। মামার মনে বেশ আনন্দ হল, তাই একদিন ওই পথের নাপিতের কাছে চুল দাড়ি কাটার পর সহকর্মীর কথা মতো মজুরি নাপিতকে দিতে গেলেন। কিন্তু নাপিত কিছুতেই ওই টাকা নেবে না। সে আরও মজুরি দাবি করল। উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সহকর্মীটি সব প্রত্যক্ষ করছিলেন আর দাঁত বের করে হাসছিলেন। মামা এসব দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন এবং নাপিতের মজুরি দিতে বাধ্য হলেন। তথাপি মামা এত সহজে হার মানতে রাজি নন, তিনি তৎক্ষণাৎ জামা খুলে দু’হাত তুলে নাপিতকে বললেন, দে বগল কামিয়ে দে, নখ কেটে দে, নাক-কানের বড় বড় চুল কেটে দে; নাপিতও হাসতে লাগলো।
স্টেশনে নেমে আমরা হেঁটে মামার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। যাওয়ার পথে একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তিকে কাঁসার ঘড়া ঘাড়ে হনহন করে আমাদের বিপরীত দিক থেকে আসতে দেখলাম এবং আমাদের দিকে একটু তির্যক চোখে তাকিয়ে সোজা চলে গেলেন। রাম বাবু আমায় কনুইএর ঠেলা দিয়ে বললেন,ওই হলো আমার মামা হিরণ ঠাকুর, স্টেশন থেকে খাবার জল আনতে যাচ্ছে।
আমি তো অবাক ,মামা-ভাগ্নে দেখা হল অথচ কোন কুশল বিনিময় হল না। যাই হোক মামার বাড়ি পৌঁছে আমাকে বৈঠকখানায় বসিয়ে রামবাবু পাশের ঘরে গেলেন।
মামী রামবাবুকে দেখেই অবাক হয়ে বললেন, আয় আয় রামু, কতদিন বাদে মামার বাড়ির কথা মনে পড়লো? বোস, বল তোদের খবর কি?
রামবাবু কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, না বসবো না, এখনই ফিরে যাব।
কেন কি হয়েছে ফিরে যাবি কেন? আমায় বল কি হয়েছে?
আমি তোমার মেয়ের জন্য সরকারি চাকুরে একটা সৎ ভালো ছেলে এনেছি, রাস্তায় মামার সঙ্গে দেখা হলো কিন্তু মামা একটা কথা বললো না বরং এমন ভাবে তাকালো যেন আমরা তোমাদের সম্পত্তি লুট করতে এসেছি। এমনি এমনি কি আর কেউ আসতে চায়, তাই মাছ ধরার লোভ দেখিয়ে ওকে ধরে নিয়ে এসেছি। তোমরা যদি বলো যে মাছ ধরা হবে না, তবে এখনই ফিরে যাচ্ছি।
কন্যাদায় থেকে মুক্তির সম্ভাবনায় মামীর কোমল হৃদয়ের আকুতি ঝরে পড়লো, না বাবা যাসনি, আমি এখনই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
টিফিন খেয়ে একটা বড় দিঘির পাড়ে আমাদের মাছ ধরার সুবন্দোবস্ত হলো। আমাকে মাছ ধরতে বলে রামবাবু একটু ঘুরে আসি বলে উধাও হয়ে গেলেন। তার উধাও হওয়ার কারণ পরে জেনেছিলাম। বড় পুকুরটায় ভালো সংখ্যক মাছ আছে তার প্রমাণ পেলাম। দু’ কেজি,আড়াই কেজি ওজনের রুই কাতলা ছিপে ধরা পরলো, কিন্তু একটা রেখে বাকি সব আবার জলে ছেড়ে দেওয়া হলো।
বেলা দু’টো নাগাদ মধ্যাহ্নভোজের ডাক পড়লো এবং ভালোমতো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হলো। এর মাঝেই রামবাবাবুর মামাতো বোনের সঙ্গে সামান্য দেখাদেখি হয়েছে। বিকেলের ট্রেনে আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। কিন্তু রামবাবুর তার মামিমাকে বলা মিথ্যা কন্যা দেখার কথা আমাকে বড়ই পীড়া দিচ্ছিল। রামবাবু আমাকে বললেন ও তুই চিন্তা করিস না, আমি বলে দেবো ছেলের মেয়ে পছন্দ হয়নি। হিরণ ঠাকুর আমার বংশ পরিচয় জেনে নিয়েছিলেন এবং আমার পিতা ও তিনি যে একই অফিস পাড়ায় কাজের সুবাদে পরস্পর পরিচিত সে কথাও আমাকে জানিয়ে রাখলেন।
এর সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন আমার বাবার সঙ্গে হিরন ঠাকুরের দেখা। একথা সেকথার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার মেজ ছেলে আমার ভাগ্নে রামুর সঙ্গে এসে আমার মেয়েকে দেখে গেল, তারপর আর কোন খবর দিল না, তার কি আমার মেয়েকে পছন্দ হয়নি?
আমার বাবা আকাশ থেকে পড়লেন, বলেন কি, আমার মেজ ছেলের তো বছর পাঁচেক আগে বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তার দু-দুটো ছেলে আছে । হিরন ঠাকুর মনে মনে ভাগ্নেকে অভিসম্পাত দিতে লাগলেন।
কাহিনী কিন্তু এখানেই শেষ হলো না। মাস খানেক বাদে, রামবাবু একদিন রাতে শেষ লোকাল ট্রেনে রসূলডাঙ্গা স্টেশনে নামলেন। কিছুটা সময় কোনমতে স্টেশনে কাটিয়ে রাত তিনটে নাগাদ মামার বাড়িতে এসে প্রথমেই সব ঘরের দরজার বাইরে থেকে শিকল তুলে দিলেন। যাতে ঘরের বাইরে কেউ আসতে না পারে। আগেরবার এসেই আমাকে মাছ ধরতে বলে তিনি চলে গেছিলেন জেলেদের সঙ্গে সবরকম বন্দোবস্ত করতে। জেলেরা ঠিক সময় এসে হাজির হয়েছিল। তাড়াতাড়ি জাল টেনে প্রায় আশি কিলো বড় বড় রুই কাতলা ধরা হলো দু’ তিনটে পুকুর থেকে। জেলেদের পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিয়ে রামবাবু দ্রুত রওনা দিলেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে, যাতে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই ট্রেনে চড়ে পগারপাড় দেওয়া যায়।
ইতিমধ্যে সকালের আলো ফুটেছে। মামার বাড়ির লোকজন ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে গিয়ে দেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে পড়শীরা এসে দরজা খুলে দিলে। হিরন ঠাকুর নিশ্চিত হলেন, নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটেছে। তিনি এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে পুকুরপাড়ে এসে দেখলেন পাড়ে গেঁড়ি-গুগলি পড়ে আছে। তার বুঝতে দেরী হলো না, পুকুরগুলো থেকে মাছ চুরি হয়েছে।
তিনি কালবিলম্ব না করে স্টেশনের দিকে ছুটলেন। রামবাবুর বোনের আজ বিবাহ এবং সেই বিবাহের ভুঁড়ি-ভোজের মাছ যে তার পুকুর থেকেই যাচ্ছে এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ হলেন। দূর থেকে ট্রেন আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে তাই পড়িমড়ি করে স্টেশনে এসে দেখলেন ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিয়ে দিয়েছে এবং ট্রেন আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে। তিনিও ট্রেনের পাশাপাশি প্ল্যাটফর্ম বরাবর ছুটতে লাগলেন। সাতান্ন বছরের প্রৌঢ়ের পক্ষে ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল মেলানো সম্ভব হলো না, ছুটতে ছুটতে দেখলেন একটা কামরায় ভাগ্নে রামু কয়েকটা মাছ বোঝাই বস্তা নিয়ে বসে আছে। মামাকে দেখে রামবাবু একটা মাছ নিয়ে কামরার দরজার কাছে এসে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, মামা আজ তোমার ভাগ্নির বিয়ে, এসো কিন্তু।
মামার অকথ্য গালিগালাজ ট্রেনের যান্ত্রিক আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল।