ঠাকুরঘর
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়
ঠাকুরঘর তো নয়, যেন দশকর্মভাণ্ডার। তেত্রিশ কোটি দেবী দেবতার আবাসস্থল। মাসমাইনে পুরুতঠাকুর দু’বেলা নিয়ম করে আসেন, পুজো সারেন, শাঁখ ঘন্টা ফুল তুলসী গঙ্গাজল নৈবেদ্য, আয়োজন ভালোই।
বুলিবুলি, মেয়ের ঘরের নাতনী। মাত্র আট বছর বয়স। ভারী দুষ্টু।
ও দাদু, দাদু, রোজরোজ কার পুজো হয় গো?
দাদু স্বামীজীর লেখা, কর্মযোগ পড়ছিলেন।
গম্ভীরমুখে বললেন, ওই সব ঠাকুর দেবতাদের পুজো হয়।
কোন ঠাকুর? ঠাকুরঘরে তো একগাদা ঠাকুর
দাদু এবার বিরক্ত।
সকলেরই পুজো হয়।
বুলিবুলি ভারী দুষ্টু। বলে, সকলের পুজো হয়, তাহলে একটা প্রসাদের থালা কেন? কোন ঠাকুর খাবে, বুঝবে কেমন করে, সবাই ভাববে, আমার নয়, এটা ওর। কেউই খাবেনা। ঠাকুর না খেলে, প্রসাদ হবে কি করে?
আর একটু হলে দাদুর হাত থেকে কর্মযোগ ছিটকে গিয়েছিল আর কি। কোনরকমে সামলে নিলেন।
তারপরেই হাঁক দিলেন,
কই গো, কোথায় গেলে, একবার এখানে এসো দেখি।
বুলিবুলি বুঝলো দিদাকে ডাকা হচ্ছে। এবার কিছু একটা হবে। যেটা তার পক্ষে মোটেই সুখের হবে না। তাই আর কালক্ষেপ না করে, এক ছুটে পগারপার।
হেলে-দুলে দিদার প্রবেশ। হাঁটুর প্রবলেম।
কি হলো কি, চ্যাঁচাচ্ছো কেন?
দাদুর কপালে ভাঁজ।
ঠাকুরঘর পরিস্কার করো, আজই।
মানে? পরিস্কারই তো আছে।
না না, কুলদেবতা ছাড়া সব মূর্তি হঠাও।
দিদার মাথায় হাত। বলে কি লোকটা, পাগল হয়ে গেল নাকি?
দাদু বলে চলেছেন,
এইটুকু মেয়ের যা বুদ্ধি, এই মরণ কালে আমাদের সেই বুদ্ধি নেই। বুলিবুলি, কোথায় গেলি মা…
ঠাকুরঘরে এখন একা কুলদেবতা। মাসমাইনের পুরুতঠাকুর রোজ কুলদেবতাকে ভোগ নিবেদন করেন। আর ভোগের ভাগাভাগি নেই। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই। দেব দেবীদের ভুল বোঝাবুঝি নেই। নির্ভেজাল শান্তি।
দাদু স্বামীজির লেখা কর্মযোগ পড়ছেন। দিদা, প্রসাদের থালা হাতে নিয়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন। তুলসী লাগা আধভাঙ্গা বাতাসা দাদুর হাতে দিয়ে, ধীরপায়ে চলে যেতে যেতে বললেন,
ঠাকুরঘর তো পরিস্কার হয়েছে, মন পরিস্কার হয়েছে কি, বুলিবুলির মতো? নিষ্পাপ সরল?
প্রসাদ টুকু মুখে ফেলে দাদু সাদা মাথায় হাত মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বললেন,
বড্ড দেরি হয়ে গেছে। বড্ড দেরি।
এ জনমে আর সম্ভব নয়।