“বাংলার নিঃশব্দ আর্তনাদ”
– তন্ময় সিংহ রায়
সাত হাজার অতিক্রান্ত এ গ্রহের ভাষা বৈচিত্রে ব্যবহৃত ভাষা প্রায় হাজার সাড়ে ছয় মতন ও তার মধ্যে বাংলা বোধকরি একদম প্রথম সারিতে এক অকৃত্রিম রাজকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ!
পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে বেষ্টন করেছে বায়ুচাপ বলয়ের মতন বললেও নিতান্তই অযৌক্তিক কিছু বলা হবেনা। প্রকৃত বাংলা ভাষাপ্রেমী সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু শ্রেণীর মানুষ বোধকরি এক চরম দুশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন, বলাবাহুল্য এর একাধিক যুক্তিসংগত কারণও আছে বৈকি!
সর্বোপরি রাষ্ট্রের শাসক সম্প্রদায় থেকে ফিল্মি ও খেলার দুনিয়ার সেলিব্রিটিরা সবাই আজ ইংরিজিমুখি। অপুষ্টি ও চরম অবহেলায় জীর্ণ ও শীর্ণকায় বাংলা-টা ক্রমশই হয়ে উঠছে শুধুই কথ্য ভাষা।
বছর চার-পাঁচ এ ধরিত্রীর অক্সিজেন গ্রহণকারী নবপ্রজন্মের এক বৃহদাংশের আজ শিক্ষা শুরু ইংরিজি মিডিয়াম থেকে। শিক্ষায় জন্ম যে ছেলেটার বাংলা মিডিয়ামে, তার কদর সমাজে অপেক্ষাকৃত অনেকাংশে কম, এমনটাই একবিংশের জীবন্ত চিত্র! খুচরো হোক বা আস্ত, ইংরিজি বলে যতটা আত্ম-গর্বিত ও সোসাইটি এক কেলাস উঁচুতে উঠে গেলো বলে আমরা মনে করি, এমন অনুভবটা বাংলায় প্রায় মৃত্যুবরণ করেছে! আমদের বাহ্যিক আচরণ হয়তো বলে দেয় যে আমরা ভুলতে বসেছি, আমরা শুদ্ধ বাঙালী ও আমাদের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির মূখ্য অপর প্রান্ত আজও বাংলা মায়ের নাড়িতে সংযুক্ত।
এক পরিচিত দৃশ্য হলেও, আন্তরিক সাক্ষাতে মানসিক প্রতিক্রিয়া কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো সেদিন! খুব সম্ভবত বৃহস্পতি অথবা শুক্রবার ও বেলা তখন বারোটা-টারোটা বাজবে, হঠাৎ দেখি আমার বেশ কিছুটা সামনের দিক থেকে একটা বাধাহীন গতিশীল মালভূমি দুরন্ত গতিতে এদিকেই হনহনিয়ে এগিয়ে আসছে! কাছে আসতেই দেখি চরম উত্তেজিত ও উৎফুল্ল আননের সুমন্তদা, এক নাতিদীর্ঘ কথপোকথন আবিষ্কারে সক্ষমের ফলাফল এমন যে তার একমাত্র ছেলে এবারে নামী ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি-তে দুশো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে।
অনুভব করলাম পুত্রের এরূপ সাফল্যে পিতার বুক গর্বে মালভূমি হওয়াটাই স্বাভাবিক, অগত্যা প্রশংসা বিনিময়ে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম!
সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ইংরিজির দাদাগিরিতে অনেক ভাষার-ই জীবন বিপন্নপ্রায় এমনকি জাতিসংঘের কাজকর্মের ভাষাও ইংরিজি! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অথবা একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রেমের বিপুল আকস্মিক উন্মাদনা কিংবা পহেলা বৈশাখ বাংলায় দুটো-একটা স্ট্যাটাস….’আমি গর্বিত, আমি বাঙালি’ ইত্যাদি…. ব্যস! অতঃপর সারাবছর রক্ষণাবেক্ষণবিহীন বাংলা-টা মুখ থুবড়ে পড়েই থাকে রাস্তার এক কোণায়! দুদিন পরেই বাংলায় কোন মাস ও বিশেষত কত তারিখ সব অতল গভীরে তলিয়ে যায় মনের!
চুড়ান্ত যত্নহীন ও অবিবেচক হয়ে নিজেরাই নিজেদের ভাষার ইজ্জতকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বাজারের সস্তা পণ্য বানিয়ে নির্দ্বিধায় আফশোষবিহীনভাবে বেচে দিচ্ছি! এভাবে চলতে থাকলে…..
আমরা সবাই এখন বুদ্ধিজীবী, হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ভিতরটা দেখাবার কোনো মানেই হয়না। এখন প্রশ্ন হল, এ বিষয়ে কপালে প্রকৃত দুশ্চিন্তার কালো মেঘের অন্ততপক্ষে সিংহভাগ বাঙালীর আবির্ভাব হবে কবে? ডুবন্ত বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে ক’জন বিশেষত বাঙালীই বা আত্মাহুতি দেবে তাতে? ও কতদিনই বা তার আয়ু??