ভাঙা মন্দির
– অমল দাস
টালির চালা ঘর থেকে বেরিয়ে গ্রামের ভাঙা পুকুরের পার ধরে সুমনা এগিয়ে চলছে সিদ্ধার্থের খোঁজে। আজ এই নিয়ে চারদিন সিদ্ধার্থ সুমনার সাথে দেখা করেনি তাদের প্রিয় স্থান গ্রামেই পরিত্যক্ত ভাঙা মন্দিরের অশ্বত্থ তলে। দেবতার অবয়ব হীন এই ভাঙা মন্দিরের শপথ করেই সিদ্ধার্থ বলেছিল, দেবতা নেই তো কি হয়েছে, এই মন্দিরকেই সাক্ষী রেখে বলছি তুই আমার হৃদয়ের অর্ধেক অংশ, মন্দির ভাঙা হলেও তোর মন আমি ভাঙবো না!
কথা রাখেনি সে! সুমনার খুব মন খারাপ, সিদ্ধার্থ কেন তার সাথে দেখা করেনি চারদিন। কি হয়েছে? সুমনা নিজে কি কোন ভুল করেছে! না কি ওর শরীর খারাপ! কেনই বা ও খবর দিল না! নাকি ও জেনে গেছে তাই পালিয়ে বেরাচ্ছে, আমি তো ওকে কিছু বলিনি। আমি তো আর আমি একা নই! ওর আদুরে স্পর্শে! ওকে বুঝতেও দিইনি। তাহলে…
এক আকাশ চিন্তা মাথায়! বুক দুরুদুরু অবস্থায় কাঁপাকাঁপা পা দুটো এসে থামল গ্রামের শুরুর দিকে সিদ্ধার্থদের মস্ত বাড়ির গেটে।
বন্ধ গেটের ডানদিকের ছোট খিড়কিটায় একবার স্বভয়ে ঠেলাতে হালকা আওয়াজ হলো, তাতে যেন ভয়ে সুমনা আরও শিঁটিয়ে গেলো। চোখ মুখে এক উদ্ভ্রান্ত শীর্ণকায় রূপ জেগে উঠেছে। গেটের আওয়াজে কেয়ারটেকার ভানু ছোট দরজা থেকে ঈষৎ গলা বার করে তাকে সম্পূর্ণ লক্ষ্য না করেই বলে -এখন যাও! এখানে ভিক্ষা-টিক্ষা হবেনা।
– -ভানু কাকু আমি সুমনা, সিদ্ধার্থকে একবার ডেকে দেবে? নিরাসক্ত স্বরে সুমনা।
প্রথমে খেয়াল না করলেও, এখন ভুল ভাঙতেই জিভে দাঁত বসিয়ে অনুশোচনার স্বর বেরিয়ে এলো- ও… ইস… সুমনা… আমি খেয়ালই করিনি, তা চোখ মুখের এমন হাল কিকরে হলো! চেনবারই উপায় নাই যে!
একথায় সুমনা গুরুত্ব দিল না! তাই উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। সে আবার বলল- সিদ্ধার্থকে একবার ডেকে দাও না… কাকু!
ওমা তুমি জানো না সিধু বাবু তো বাড়িতে নেই, সে দুবাই যাবে চাকরি করতে! সকালেই সবাই কলকাতায় বেরিয়ে গেছে সিধু বাবুকে হাওয়াই জাহাজে তুলে দিতে।
নিমেষে সুমনার হৃদয়ে উথাল পাথাল ঝড়! অত্যাশ্চর্য হয়ে কথা হারিয়ে কেবল নির্বোধের মত জিজ্ঞাসা করল- মানে?
-সে কি ছোট বাবু তোমাকে কিছুই বলেনি? তার চাকরি লেগেছে! এই যে গেলো আবার দুবছর পর আসা। কিছুই বলেনি! তুমি ওর ভালো বন্ধু! আমি তো জানি…
শেষের কথাগুলো ক্ষীণ হয়ে সুমনার কানে এলো, সুমনা আগেই আত্মহারা হয়ে প্রায় জ্ঞান হারানোর পর্বে।তার চোখের সামনে এখন ঘোর অন্ধকার, সেই অন্ধকারে অজস্র বিন্দুবিন্দু আলোর ঝিলিক, দিগ্বিদিক শূন্য। সুমনা দু পা পিছিয়ে এলো, যদিও তা স্ব-ইচ্ছায় নয়। রাস্তার পাশেই একটি আম গাছের তলে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে রইল, কতক্ষণ এভাবে ছিল জানা গেলো না। কেয়ারটেকার ভানুও গলার পরিবর্তে শরীর বার করে আর দেখার চেষ্টা করল না সুমনা আছে না চলে গেছে।