আয়নামহল (পর্ব-৪)

আয়নামহল (পর্ব-৪)
-সঞ্জয় গায়েন

 

 

১৬
কষ্ট পেলে পেটের ছেলে
ছুটবেই মা স্বকাজ ফেলে

ও তো বেশ ছিল। দেখে মনে হয়েছিল আনন্দেই ছিল। মায়ের মন জুড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছেলের কি যে হল, হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে ফিরে দরাম করে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজেছিল। সারারাত শত ডাকাডাকিতেও দরজা খোলে নি। খুব ভয় পেয়েগিয়েছিলাম। মনটা খুব কু ডেকেছিল। সেই রাতে ওর বাবাও বাড়ি ছিল না। ওর দাদা ততদিনে চাকরী নিয়ে বাইরে থাকে। সারা বাড়িতে আমি একা। একবার মনে হয়েছিল, ওর বাবাকে ফোন করি। কিন্তু করলেই তো বলতো, ভালোই হয়েছে। এবার ওষুধ টষুধ খেয়ে মরতে বলো। ল্যাটা চুকে যাক।
বাপের আর কি! পেটে তো ধরে নি! ধরলে বুঝতো মা হওয়ার জ্বালা কি! সেই জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে এক একবার আমারও মনে হত, ও মরুক! মরে গিয়ে বরং আমাকে একটু শান্তি দিক। পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার দিতাম। ছি ছি আমি না মা! মা হয়ে কখনো কেউ ছেলের মৃত্যু কামনা করে! নাকি করতে আছে! তবু মনে হত ও কি আমায় সারাজীবন একটুও শান্তি দেবে না!
ওর মন নাকি মেয়েদের মতো! সত্যি যদি মেয়ের মন হত তাহলে মায়ের কষ্ট ঠিক বুঝতো। বোঝে নি। বুঝবে কি করে! ও তো মেয়ে নয়। মেয়ে হওয়া কি অত সোজা!
মেয়ে হলে অনেককিছু ত্যাগ করতে হয়। মুখ বুজে মেনে নিতে হয়। সহ্য করতে হয়। মেয়েরা সবসময় আমার আমার করে না। কিন্তু ও করতো। মেয়ে নয় বলেই করতো!
ও যদি মেয়ে হতো তাহলে মা হয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারতাম। ওকে আমি পেটে ধরেছি। কোলে পিঠে করে বড় করেছি। লজ্জার মাথা খেয়ে ওর বুকে মেয়েদের মতো গজিয়ে ওঠা স্তন দেখেছি। ও মেয়েদের মতো ছেলে দেখলেই আকৃষ্ট হত তাও বুঝতাম। তারপরেও বলছি ও মেয়েদের মতো হতে পারে। কিন্তু মেয়ে নয়। ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হলেই কেউ মেয়ে হয়ে যায় না। মেয়ে হতে হলে নরম হতে হয়। নিজের ইচ্ছেকে লুকিয়ে রাখতে হয়। তার চেয়ে বড়কথা মেয়েরা কক্ষনো শরীর শরীর করে অত উতলা হয় না! ও অমন করে উতলা হত কেন! ও ভাবতো শরীর দিয়েই ছেলেদের মন জেতা যায়। বোকা কোথাকার।
আমি সব বুঝেও কিছু করতে পারি নি। ও আমার মেয়ে হলে মা হয়ে আটকাতে পারতাম। অন্তত আটকাবার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু মা হয়ে ছেলেকে আটকানো যায় না। ছেলেরা বড় হলেই মায়ের আঁচল ছেড়ে দেয়। ও-ও ছেড়েছিল। আমিও হাঁপ ছেড়েছিলাম। কিন্তু তা আর হল কই। কলেজের বন্ধুর কাছে এমন চোট খেয়েছিল যে একবচ্ছর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে নি। আর আমি এমন হতভাগ্য মা না পেরেছি ছেলের প্রেমকে মেনে নিতে, না পেরেছি প্রেমে ব্যর্থ সেই ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে। না না, ছেলের প্রেম করা নিয়ে আমার কোন আপত্তি ছিল না। বরং ভালো তো ছেলে নিজে নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেবে। কিন্তু আমার ছেলের প্রেম তো তেমন প্রেম নয়। এ সমাজে ছেলেই ছেলে বন্ধুত্ব হয়, প্রেম নয়। সেই বন্ধুত্বকেই প্রেম ভেবে ছেলেটা আমার দিনের পর দিন কেঁদেছে। ঘুমের ঘোরে সেই বন্ধুর নাম ধরে ডেকেছে। আমি মা হয়ে ছেলের সেই কান্না শুনেছি। কিচ্ছুটি করতে পারি নি। কি করতাম? ওর সেই বন্ধুর বাড়ি গিয়ে হাতদু’টো ধরে যদি বলতাম, বাবা একটিবার চলো, আমার ছেলেটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে! ওর সেই বন্ধু কি শুনতো! শুনতো না। উল্টে হয়তো হেসে বলতো, ওকে ডাক্তার দেখান। ডাক্তারই দেখিয়েছিলাম। মনের ডাক্তার। সেই ডাক্তারকে ও ওর প্রেমের কথা বলেছিল। ডাক্তারই এটা সেটা প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিল। কিন্তু কি হল? ডাক্তারও কি মানলো ওর প্রেমের কথা! মানে নি। সব জেনে বলেছিলেন, আপনার ছেলের জেন্ডার ডিসঅর্ডার আছে। এর বেশি কিচ্ছু বলেন নি। ডাক্তার তো পারতেন স্পষ্টভাষায় বলতে, যে এ আপনার ছেলে নয়, মেয়ে। মনের ডাক্তাররা তো কথায় কথায় বলেন, শরীর নয়, মনই শেষ কথা। আমার ছেলেটা ছোট থেকেই মনে মনে নিজেকে মেয়েই ভাবে, মেয়েই বলে। কই ডাক্তার তো এর বেলা মনের কথাকে শেষ কথা বলে আমার ছেলেটাকে মেয়ে বলে সার্টিফিকেট দিতে পারেন নি। তা না বলেছিলেন, জেন্ডার ডিসঅর্ডার আছে। ডিসঅর্ডার! ওইটুকু বললেই হল। এমনিতেই মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনেই তো লোক আমার ছেলেকে পাগল বলেই দেগে গিয়েছিল। তারউপর ডিসঅর্ডার শুনলে তো আর রক্ষে থাকতো না। কে বুঝতো ওসব ডিসঅর্ডারের মানে। ওই ডিসঅর্ডারটা যে নরম্যাল ব্যাপার সেটাও কেউ বোঝে না।
আমিও বা কতটুকু বুঝেছি! বুঝিনি। তবু মা যখন হয়েছি, তখন ছেলে কষ্ট পেলে ছুটে না গিয়ে কি থাকতে পারি। ছুটে যেতাম। কোলে তুলে নিতাম। চাইতাম ছেলের কষ্টের ভাগ নিতে। কিন্তু পারি নি। কিছুই করতে পারি নি ওর জন্য।

১৭
পরীক্ষা দিতে পথে পথে
যৌনকর্ম জুটলো সাথে

কিচ্ছুটি ভাল্লাগতো না। তবু জোর করে ঘর থেকে বের হতাম। না বের হয়ে হয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কলেজ আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই একবার ভেবেছিলাম আবার নতুন করে পড়াটা শুরু করি। পরক্ষণেই মনে হত দূর কি হবে পড়ে! কার জন্য পড়ব? এটা একটা জীবন? কোন বন্ধু নেই, আড্ডা নেই, গল্প করার লোক নেই। একা একাই যখন থাকতে হবে জীবনের বাকীদিন, তখন বই পড়ে আর কলেজের পরীক্ষা দিয়ে কোন লাভ নেই। সে পরীক্ষা তো সবাই দেয়। দিতে হয়। বরং জীবনের কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে দেখা যাক। এমনকিছু পরীক্ষা যা না দিলেও চলতো। জীবনে চলার পথ তাতে থামে না। কিন্তু চলার পথ বদলে যেতে পারে। বদলটা ভালো না খারাপ সে বিচার না করে যারা বদল ভালোবাসে তারা এমন পরীক্ষা দেওয়ার ঝুঁকি নেয়। আমিও নিয়েছিলাম।
রোজ সক্কালবেলা বের হয়ে পড়তাম। বাড়ি থেকে কাছেই ছিল রেলস্টেশন। যেদিন যেদিক যেতে ইচ্ছে করত, ট্রেনে উঠে পড়তাম। যেখানে ইচ্ছে হতো নেমেও পড়তাম। তারপর সারাদিন টো টো করতাম। বাড়ি ফিরতাম গভীর রাতে।
ওইসময় মেয়েদের মতো সাজতাম না। নরম্যাল জিনস্‌ আর টি-শার্ট কিংবা গেঞ্জি পড়ে বের হতাম। যদিও কিছুদিন হরমোন নেওয়ার ফসল আমার বুকে ফুলের মতো ফুটেছিল। কিছুটা শুকনো হলেও একেবারে ঝরে যায় নি। তবু সেই শুকনো ফুলের মধু খাওয়ার জন্য নিশ্চয় মৌমাছিরা হামলে পড়বে না।
তাই স্তনজোড়াকে গুরুত্ব না দিয়েই বেরিয়ে পড়তাম। ভিতরে ইনার জাতীয় কিচ্ছু পড়তাম না। তার একটা উদ্দেশ্যও ছিল। আসলে আমি আমার প্রথম যে পরীক্ষাটা নিতে চাইছিলাম তা হল আমার শরীর। আমাদের এই পুরুষী শরীরে নারীর সাজ দেখলে লোকে হিজড়া মনে করে। কিন্তু শরীরসজ্জা না করলে কি বলে শুনতে চাইছিলাম।
শুনলাম হাফলেডিস, ছক্কা, হোমো এরকম কত নাম। টোনটিটকিরি, হাসি ঠাট্টা, মুখ বাঁকানো, ঘাড় বেঁকিয়ে মুচকি হাসাও চোখে পড়ছিল। অচেনা জায়গা। অচেনা পথ। একটাও চেনা মুখ নেই কোথাও। তারাও আমার শরীরটা দেখে উপহাসই করেছে। কিন্তু কেন? কেন কারো শারীরিক চেহারা দেখে হাসতে হয়? এই হাসি তো আনন্দ পাওয়ার হাসি নয়। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ করার হাসি। তবে শুধু হাসিতেই থেমে থাকতো না। ট্রেনের কামরায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বা ভিড় স্টেশনে হাঁটতে হাঁটতে যদি কারও গায়ে ছোঁয়া লেগে যেত, তাহলে এমন করে উঠতো, দেখে মনে হত আমি যেন একটা বিচুতির গাছ। ছোঁয়া লাগলেই চুলকানি হবে।
প্রথম ক’দিন অস্বস্তি হয়েছিল। তারপর অভ্যাস হয়ে গেল। ব্যঙ্গ ঠাট্টা না শুনতে পাওয়ার অভ্যাস। বাঁকা হাসি না দেখতে পাওয়ার অভ্যাস। টোন-টিকিরিকে এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার অভ্যাস। আমার ছোঁয়া লেগে বিরক্তি প্রকাশকে সামাল দিতে ফোঁস করার অভ্যাস। এরকম কতোরকম অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পরীক্ষা যে দিচ্ছিলাম তা ভাবলে তাজ্জব হতে হয়। তবে সব অভ্যাস কী সুন্দর রপ্তও হয়ে যাচ্ছিল। সব্বার হাসি ঠাট্টা দেখতে দেখতে কেমন যেন বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, আমরা তো হাসিরই পাত্র। আমাদের দেখে হাসাই উচিৎ। এবং সেই বিশ্বাসের শিকড় এত গভীরে চলে গিয়েছে, যে আমরাও অন্য আমাদের মতো মানুষকে দেখে হেসে উঠি।
যাক গে। ট্রেন সফরের কথায় ফিরি। সবাই যে আমাকে দেখে হাসাহাসি করতো তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ অন্যভাবেও দেখতো। চেয়ে থাকতো স্থির হয়ে। ঠিক যেমন জলে ছিপ ফেলে মাছুড়েরা চেয়ে থাকে। কখন টুক করে জলের তলায় মাছ ছোট্ট টোপে ঠোকর মারবে অমনি ছিপ ধরে টান। ফস্কে গেলে বেঁচে গেল। কিন্তু কাঁটায় যদি একবার বেঁধে ভালো মাছুরে ঠিক খেলিয়ে খেলিয়ে মাছটাকে উপরে তুলবেই। আমিও যেন ভিড় ট্রেনে মাছের মতো থাকতাম। মানুষের জলে ডুবে। আর সেই ভিড়ের ভিতর কেউ কেউ দৃষ্টির টোপ দিয়ে অপেক্ষা করতো। আর দৃষ্টি এমন জিনিস যাকে দেখছে সে ঠিক টের পাবেই। আমিও পেতাম। পাওয়া মাত্রই চোখে চোখ পড়তো। তখনই দৃষ্টি নামতো মুখ থেকে বুকে। আমিও টোপ না খেয়ে ছিটকে পালাতাম।
কিন্তু একদিন কিছুতেই পালাতে পারলাম না। যতদূর মনে পড়ছে, সেদিন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। তার আগে একপশলা ঝড়বৃষ্টি হয়েওছিল। ট্রেনটা মোটামুটি ফাঁকা। সিটে বসে আছি। ওপাশে একজনের চোখ যথারীতি চোখে। চোখ থেকে মুখে। মুখ থেকে বুকে। তবে সে দৃষ্টিতে শুধু চাওয়া ছিল না। কেড়ে খাওয়ার লোভ ছিল। হিংস্র কুকুরের মতো। গা টা ঘিনঘিনিয়ে উঠলো। সৌভাগ্যক্রমে তখনই ট্রেনটা একটা স্টেশনে থেমেছিল। মুহুর্তের মধ্যে ঠিক করেছিলাম, এই কামরা থেকে নেমে সামনে বা পিছনের কামরায় চলে যাব। কিন্তু আমি প্ল্যাটফরমে নামামাত্রই লক্ষ্য পড়ল, সেই লোভাতুর দৃষ্টিও পিছু পিছু আসছে। দৃষ্টি এড়াতে দ্রুত পা চালিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম স্টেশনের টয়লেটে। আর সেই টয়লেটেই সেদিন ওই কেড়ে খাওয়া দৃষ্টিটা আমায় ছিঁড়ে খুঁড়ে খুবলে খুবলে খেয়েছিল। পরনের গেঞ্জিটা ফেঁড়ে দিয়েছিল। কোমরে বেল্টও হ্যাঁচকা মেরে ছিঁড়ে টেনে নামিয়েছিল জিনস্‌ প্যান্টটা। তারপর নিজের পুংদন্ডটা দিয়ে ফালাফালা করে দিয়েছিল আমার পায়ুছিদ্র। রক্তে ভিজতে ভিজতে আমি কঁকিয়ে কেঁদে উঠে মাগো ব’লে বসে পড়েছিলাম। আর তখন আমাকে অবাক করে লোকটা আমার ছেঁড়া গেঞ্জির কোঁচড়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল একশোটা টাকা। দিয়েই পালাতে চাইছিল। আমারও কি হল কে জানে। লোকটাকে জাপটে ধরেছিলাম। ধরেই চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, হেল্প হেল্প।
কাছেই রেলপুলিশ ছিল। অন্যদিন থাকে না। সেদিন কেন ছিল কে জানে! আমার ডাক শুনেই ছুটে এসেছিল। ধর্ষিত আমি ! ধর্ষককেও পালাতে দিই নি। সাহায্যের প্রার্থনা জানিয়েছিলাম। শুনে হো হো হো করে হেসে উঠেছিল। পুলিশটি। হাসতে হাসতেই বলেছিল, তুই কি পুরোপুরি লেডিস নাকি, যে তোর ধর্ষণ হবে? আমাদের দেশে শুধু নারীরা ধর্ষিতা হয়। বাকীরা বড়জোর ধর্ষক হতে পারে!
তার মানে রক্তাক্ত আমি কোন আইনি সাহায্য পাব না? কাতর হয়ে জানতে চেয়েছিলাম। উত্তরে আবার হেঁ হেঁ করে দেঁতো কন্ঠে বলেছিল, আইন তো শুধু নারীদেরই ধর্ষিতা হিসাবে গণ্য করে। আর কাউকে নয়। তবে তোর রক্তস্রোত আমি বন্ধ করে দিতে পারি। বলেই লোকটাই দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুই এখনো এখানে কেন? যা ভাগ!
দেখে তো মনে হচ্ছে লাইনে নতুন। এই স্টেশনে আগে কোনদিন দেখিনি। তাই ধর্ষন টর্ষন বলে নাটক করা হচ্ছিল। নে ওঠ এবার। আমি কিছু না বুঝেই উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। আর ওঠামাত্রই আমাকে পিছন দিক থেকে টয়লেটের দেওয়ালে ঠেসে ধরে নিজের প্যান্টের চেন খুলেছিল পুলিশটি। শেষে ঘর্মাক্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, তোকে ক’রে খুব ভাল্লেগেছে। যা আজ থেকে এই স্টেশন তোর একার। এতদিন যে দু’ তিনজন থাকতো তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।
ওসব শুনে কানমাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল আমি যেন কোন রেলস্টেশনে নয়, সমুদ্রের তীরে ছিলাম। আর চোরাবালিতে আটকে পড়েছিলাম। উঠে পালাবার যতই চেষ্টা করছিলাম, ততই আরও বেশি করে ডুবে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই একটা ট্রেন এসে আমাকে বাঁচিয়েছিল। কোনরকমে নিজেই নিজের শরীরটাকে টেনে তুলে ট্রেনের ভিতর নিয়ে গিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। তারপর ট্রেনটাই দয়া করে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল আমার স্টেশনে।

১৮
আবার ছেলে সাজলো নারী
বাপ-বেটার হল ছাড়াছাড়ি

ছেলেটা একটা বছরেরও বেশি সময় নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল। মা হিসেবে তা মেনে নিতে মন সায় দিত না। মেয়ে হলে ঠিক ছিল। মেয়েদের তো গাছের মতো জীবনযাপন। ঘরের মেঝেতে শিকড় চেলে দিয়ে দিন কাটানো। কিন্তু ছেলে হয়ে জন্মে ঘরে বাইরে করবে না তা কি হয়? তাছাড়া ও ঘরবন্দী হওয়ায় পাড়ায়-আত্মীয় স্বজনের মধ্যে জোর গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনিতেই আড়ালে আবডালে ফিসফিসানি ছিলই। মাঝে শালোয়ার কামিজ পরে কলেজ যাচ্ছিল দেখে হাসির হাট বসে গিয়েছিল। সেই নারী সাজ ছেড়ে দেওয়ায় স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলাম। কিন্তু তার বিনিময়ে ও অসুস্থ রোগীর মতো সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকবে তাও কি মেনে নেওয়া যায় নাকি! ওভাবে শুয়ে থাকলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। ভুলে যাবে হাঁটাচলা। আর ও তো মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলই। কম বার তো ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয় নি।
কি আর করব, সবই আমার পেটের দোষ! নিশ্চয় আগের জন্মে বড় কোন পাপ করেছিলাম। তার শাস্তি হিসেবে ভগবান এমন ছেলে দিয়েছিল। কিন্তু এ এমন শাস্তি যার হাত থেকে রেহাই পেতে সেই ভগবানকেই ডাকতে হত। রোজ ডাকতামও। সেই ডাকের জন্যেই কিনা জানি না, ও বছর ঘুরতেই হঠাৎ একদিন বিছানা থেকে নিজে নিজেই ঝেড়ে উঠেছিল। নইলে ধিক্কারে শেষদিকে ডাক্তার দেখানোও ছেড়ে দিয়েছিলাম।

যাইহোক ও উঠে দাঁড়ানোই, বাইরে পা বাড়ানোই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। জানতাম ও বাড়ির বাইরে পা রাখলেই আবার পাড়ার গলিতে, রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে ওকে নিয়ে হাসি-মশকরা করবে সবাই। পিছনে লাগবে ওর। কিন্তু ওকে সেসব মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। যত পিছু ফিরবে ততই আরও বেশি হা-হা-হি-হি হবে। সবথেকে আশ্চর্য্য লাগতো, সেই ছোট্ট থেকে একটা ছেলেকে নিয়ে রোজ হাসি ঠাট্টা করতে ওদের এত ভালো লাগতো কেন? ওদের কি একঘেয়েমি বলে কিছু ছিল না? সব জিনিস তো দেখতে দেখতে একসময় চোখ সওয়া হয়ে যায়। তখন তা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। ওরা যদি আমার ছেলেটাকে সেরকম স্বাভাবিক বলে মনে করতো, তাহলে বোধহয় ছেলেটা বেঁচে যেত! আসলে ওর মতো আমাদের পাড়ায়, শুধু পাড়ায় বলি কেন এ তল্লাটে আর কেউ ছিল না। ও একা বলেই ওরা আরও পেয়ে বসতো।
এতকিছুর পরেও ও আবার বাইরে বের হওয়া শুরু করেছিল। যদিও বের হত সাতসকালে, ফিরতো রাতদুপুরে। সারাটাদিন কোথায় যে টো টো করতো, একা একাই ঘুরতো নাকি সঙ্গে কেউ থাকতো, কিচ্ছুটি জানতে পারতাম না। ও-ও বলত না। জিজ্ঞেস করলেও চুপ করে থাকতো। আমিও তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনকে বোধ দিয়েছিলাম এই বলে যে যাক, ভেসে যাক, ডুবে যাক, তবু যাক যেদিক খুশি, যেখানে খুশি। ভাসতে ভাসতে বা ডুবতে ডুবতে যদি ভাগ্যে থাকে ঠিক চর খুঁজে পাবে।
কিন্তু আমার কপালটাই খারাপ। চর পাওয়া তো দূরের কথা, একদিন রাতে ফিরে এল জীন্মমৃত হয়ে। গায়ের জামাটা ছেঁড়া। মুখে-গলায়- ঘাড়ে নখের আঁচড়ের দাগ। প্যান্টেও রক্ত লেগেছিল। ভয় পেয়ে আমি ছুটে যেতেই ও খেঁকিয়ে উঠেছিল পাগল কুকুরের মতো। আমিও কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপচাপ ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। ও সঙ্গে সঙ্গে খিল তুলেছিল ওর ঘরে। পাশের ঘর থেকে লক্ষ্য করেছিলাম সারারাত ওর ঘরে আলো জ্বলেছিল।
পরদিনও খিল খোলে নি। অনেক ডাকাডাকিতে কোনরকমে শুধু জানলা দিয়ে ভাতের থালাটা নিয়েছিল। ছেলে এমন আচরণ করলে এক মায়ের বুকে কি হয়, তা যদি ছেলেরা বুঝতো, তাহলে ধন্য হয়ে যেত সব নারীর মা হওয়া। আমার ছেলে আমাকে এতটুকু ধন্য করতে পারে নি। তবে নিজেকে ধন্য করতে এবার আর শালোয়ার কামিজ নয়, কখন আমার ঘর থেকে শাড়ি-ব্লাউজ নিয়ে গিয়ে পরে বেরিয়েছিল ঘর থেকে। কিন্তু বেরোবি বেরো, একেবারে বাপের সামনে দিয়ে বের হতে হল। আর ওর বাপও তেমন। ওকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখামাত্রই চুলের মুঠি ধরে সেদিন কী মারটাই না মেরেছিল। মারতে মারতে পরনের শাড়ি খুলে…। আমি ওর বাবাকে অনেক করে আটকাবার চেষ্টা করেছিলাম। পারি নি। পুরুষ মানুষ রাগলে অসুরের মতো শক্তি পায়। তখন তাকে আটকাতে পারব এমন সাধ্য আমার মতো সাধারণ মায়ের ছিল না। আমি শুধু কেঁদে উঠেছিলাম, লজ্জায় মুখ ঢেকে বলেছিলাম, এ তুমি কি করলে! ও যাই হোক, ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বাপ হয়ে অত বড় সন্তানের পরনের পোশাক জোর করে খুলে দিলে! আর মা হয়ে আমাকে তা দেখতে হল! ছিঃ ছিঃ!
আমার ছেলেটা কিন্তু ওত মার খেয়েও একটুও কাঁদে নি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। ভাবলেশহীন এক চাউনি। সেই দৃষ্টিতে কী ছিল জানি না। রাগ! ক্ষোভ! ঘৃণা! কিছুই তো প্রকাশ করে নি। সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন আমার ছেলেকে চিনতে পারছি না। সেই চিনতে না পারার কারণে হোক, কিংবা মেঝেতে লুটিয়ে পরে থাকা শাড়ি দেখে হোক, হঠাৎ ছুটে গিয়ে শাড়িটা তুলে ছেলের শরীরে জড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর তখনই ছেলে আমার হাউহাউ কেঁদে উঠেছিল। ওর বাবা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল, আজকের পর যেন ওকে আর এ বাড়িতে না দেখি।

১৯
খেলাম রাতে ঘুমের বড়ি
হাসপাতালে তড়িঘড়ি

নিজের বাবা যখন দুঃশাসন হয়ে তার মেয়ের বস্ত্রহরণ করে, তখন কোন মেয়ে আর বাঁচতে চায়বে? তার উপর আমার মতো অভাগা মেয়ে হলে তো কথায় নেই। এই লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ অনেক ভালো। হঠাৎ লোডশেডিং হলে চারদিকটা যেমন সঙ্গে সঙ্গে নিঃঝুম অন্ধকার হয়ে যায়, সেদিন আমার জীবনেও তেমন অন্ধকার নেমে এসেছিল। চোখের সামনে এত্ত ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, কিচ্ছুটি দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিছু সময় অপেক্ষা করলে হয়তো অন্ধকার সয়ে যেতো। অস্পষ্টভাবে হলেও দেখা যেত চলার পথ। তখন হাতড়ে হাতড়ে এগোলেও একসময় অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পেতে পারতাম। কিন্তু তখন অপেক্ষা করার মতো ইচ্ছে, ধৈর্য্য কিছুই ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল বাবার দেওয়া এই লজ্জা ঢাকতে কি করি কি করি! মাঝে একটা বছর নিজেকে ঘরবন্দী করার সময় মায়ের জোরাজুরিতে ডাক্তারের কাছে যেতাম। সেই ডাক্তার কি ওষুধ দিত কে জানে। তবে খেলে ভালো ঘুম হত। সেই ওষুধের একটা পাতা তখনও ঘরে ছিল। তা থেকেই গোটা ছয়েক বের করে খেয়ে নিয়েছিলাম। উঃ! সে কী ঘুম! জুড়িয়ে যাচ্ছিল সারা শরীর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’চোখের পাতা লজ্জাবতীর মতো মুদে গিয়েছিল। কিছুতেই আর তাকে জাগাতে পারছিলাম না। গালের ভিতর জিভও কেমন আঁঠালো হয়ে সেঁটে গেল। দু’ঠোঁট ফাঁক করে আর বের হচ্ছিল না। সেই মুহুর্তে স্থির বিশ্বাস জন্মে গেল মনের ভিতর, আমি সত্যি সত্যি মরতে চলেছি। তবে মৃত্যুর সময় অন্যদের মনে কি আসে জানি না। হয়তো বাঁচার আকাঙ্খা তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার মনে এসেছিল একটি কবিতার দু’টো লাইন। আমার সেই প্রেমিক প্রায়ই শোনাতো লাইন দু’টো।

যেদিন সত্যিকারের ভালোবাসবে
জিভ জড়িয়ে যাবে। কথা বলতে পারবে না।
ভালো তো সত্যি সত্যিই বেসেছিলাম। বলতামও যখন তখন। কই সেদিন জিভ তো জড়িয়ে যায় নি। এখন মরতে বসে জিভ জড়িয়ে যাওয়া দেখে মনে হল, তার মানে সত্যিকারের ভালোবাসার আর এক নাম মরণ!
মরুক। মরে যাক আমার শরীর। সেই শরীরটাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম। তাই শরীরের মৃত্যুর সময়ই জিভ জড়িয়ে যায়। কথা হারিয়ে যায়। আমারও হারিয়ে গিয়েছিল। সব। তারপর কি হয়েছিল আর মনে নেই।

২০
ওরই এক মাসি এসে
নিয়ে গেল ভালোবেসে

ওর বাবা যা করেছিল তার পর কোন দুর্ঘটনা না ঘটলেই বরং অবাক হতাম। সেরকম আশঙ্কাও করেছিলাম। ওর বাবা তো মারধোর করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি তো মা। আমি কোথায় যাব? ওর জন্মের সময় নাড়ী ছিঁড়ে আলাদা করে দিলেও আলাদা কি হওয়া যায়? যায় না। মা-ছেলের টান এমন টান একেবারে শিকড়ে টান পড়ে যে। সেই টানের জোরেই তো বুঝি ছেলের কষ্ট। সেই বুঝে সেদিন সারাদিন ওকে কাছছাড়া করি নি। কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম। ও-ও ছোট্টবেলার মতো শান্ত হয়ে খেয়েছিল। যদিও মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছিল। কিন্তু সেই ফোঁপানি যে টুপ টুপ করে ঝরে পড়া শিশিরবিন্দুর মতো কান্না ছিল না, ছিল দূর সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার, একটুও টের পাই নি। পেয়েছিলাম রাতে। ও ভেসে যেতে গিয়েও যখন আছড়ে পড়েছিল পাড়ে। মন তো কূ গাইছিলই, একেবারে কাছ থেকে নজরেও রেখেছিলাম। তাই বড় বিপদ ঘটতে ঘটতেও ঘটে নি। দু’দিন হাসপাতালে থাকার পর ওর জ্ঞান ফিরেছিল। ওই দু’দিন ওর বেডের পাশ থেকে নড়ি নি। কিন্তু ওর জ্ঞান আসার পর ওর চোখের সামনে যেতে ভয় করছিল। শুধু মনে হচ্ছিল আমাকে দেখলে ও যদি আবার…। সেই ভয় থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিল আমার ছোট বোন। ও একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী নিয়ে বাইরে থাকতো। আমার থেকে অনেক ছোট। বলতে গেলে আমার বড় ছেলের বয়সী। তাই আমরা দু’বোন হলেও বোনেদের মধ্যে যেমন সখ্যতা থাকে আমাদের মধ্যে তেমন ছিল না। বরং ওর আমার সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা আর স্নেহের সম্পর্ক। ও আমাকে মায়ের মতো দেখতো। যাইহোক আমরা অনেক পীড়াপীড়ি করেও ওর বিয়ে দিতে পারি নি। শেষে একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাইরে চাকরী করে। একা একা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। আমাদের ওকে নিয়েও দুশ্চিন্তা কম ছিল না। তবে ও ছোট থেকেই বেশ ডাকাবুকো ছিল। যাক গে। কী মন গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ওকেই ফোন করেছিলাম। ও শুনেই ছুটে এসছিল। ছিলও দু’টো দিন। আর দু’টো দিনে ওকে আমার ছেলের সবকথা বলেছিলাম। ও কি বুঝেছিল কে জানে। ছেলের জ্ঞান ফেরামাত্রই ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, চল আমার সঙ্গে। আমার কাছে গিয়ে থাকবি।
ছেলেও যেন মাসির কথাটা লুফে নিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে সোজা স্টেশনে গিয়েছিল। মাসির সঙ্গে মাসির বাড়ি যাবে বলে। আমরাও আপত্তি করি নি। থাকুক দু’টিতে। অন্তত কিছুদিন।

 

চলবে… 

Loading

Leave A Comment