নীল শরীর
– দেবস্মিতা ঘোষ
“ধুর আজ আর না বেরোলেই ভালো হতো। গাইডটার আজই জ্বর হতে হয় বল।” হালকা বিরক্তি মুখে ফুটিয়ে বলল তুতুন।
“আরে ওইরকম করে বলিস না রে, জ্বর তো হতেই পারে।” মিতালী ওকে থামাতে যায়।
তুতুন আর মিতালী দু’জন বন্ধু । চেন্নাই কলেজের তৃতীয় বর্ষের সাহিত্যের মোট আট জন বন্ধু বান্ধবী মিলে কেরালা ঘুরতে এসেছে তারা। দশ দিনের পরিকল্পনা। সাত দিন অতিবাহিত। আজ সকালে ওরা মুন্নার এসেছে। সারা সকাল ঘুরেছে। বিকেলের বেড়াবার প্ল্যানটা গাইডের অসুস্থতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। বাকিরা হোটেলেই কফি সহযোগে আড্ডায় মেতে উঠলেও তুতুন আর মিতালী বেড়াতে এসে একদিনও নষ্ট করতে রাজি নয়। স্থানীয় লোকের থেকে খবর পেয়ে তারা মাত্র দু’ কিলোমিটার দূরে থাকা “বাতিস্তা” গ্রামের উদ্দেশ্য। প্রধান আকর্ষণ একটি পোড়ো হোটেল। গ্ৰুপের বাকি বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করে আটকানোর, কিন্তু ওদের আটকানো যায়না। ডিনারের অনেক আগে ফিরে আসবে কথা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা।
বাতিস্তা পৌঁছাতে ওদের মিনিট কুড়ি লাগে। গিয়ে দেখে শুধুই একটি সাধারণ গ্রাম। গ্রাম লাগোয়া একটি আধ ভাঙা বাড়ি জঙ্গলে জড়িয়ে পড়ে আছে, লোকে বলে না দিলে জানাই যেত না যে ওটা হোটেল।
স্থাণীয় চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালো মিতালী। তারপর দু’জন এগিয়ে গেল সেই হোটেলের দিকে। কাছে গিয়ে ভালো করে দেখল, যদিও জঙ্গলের জন্য বেশি কাছে যাওয়া যায় না।
“গাইডটার কি আজই জ্বর হতে হয় নাকি বলতো। এখানে এসে কি লাভটা হলো। কিছুই তো নেই।” বলল তুতুন।
“গাইড তো ওই 18 বছরের ছেলে, মানুষ তো রে জ্বর হতেই পারে। তবে এখানে আসার পরিকল্পনাটাও বেকার ছিল। ভেতরেই যেতে পারবো না যা জঙ্গল। আরে ওইদিকে একটা লোক বসে আছে না, জঙ্গলের মধ্যে চেয়ার নিয়ে বসে আছে কেন রে? ভূত নাকি” মিতালী হাত তুলে একটা জায়গা দেখাল।
“জঙ্গলের মধ্যে চেয়ার নিয়ে ভুত বসে থাকবে, বলিহারি তোর বুদ্ধি, চল গিয়ে দেখি”
ওরা লোকটার কাছে যায়। লোকটি মনে হয় ঝিমুচ্ছিলো, ওদের পায়ের আওয়াজে মুখ তোলে।
সাধারণ গ্রামীন পোশাক পরা বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ। ওরা এইখানে ঘুরতে এসেছে শুনে ভেতরে যাবার কথা বলে।
“পিছনের একটা রাস্তা আছে ওখান দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়। আমি ভেতরেই থাকি, দেখবে চল।”
তুতুন, মিতালী একটু ইতস্তত করে শেষ অবধি চলে যায়। পিছনের দিকে জঙ্গল কেটে রাস্তা করা। হোটেলের ভিতরে ঢুকে তারা বুঝতে পারে এই হোটেলটা অগ্নিদগ্ধ। কোনো এক সময় আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। কোনার দিকে একটা ঘর পরিষ্কার করে জিনিসপত্র রাখা। মাদুর, স্টোভ, কিছু জামাকাপড়, খাদ্যসামগ্রী আরো কত কিছু যা দেখে বোঝা যায় বুড়ো সত্যিই এখানে থাকে। ওদের মাদুরে বসায়। ভালোই অন্ধকার এখানে, ইলেক্ট্রিসিটি থাকা সম্ভব নয় তা দেখেই বোঝা যায়। তুতুনকে টর্চ বন্ধ করতে বলে মোমবাতি জ্বালায় সেই বৃদ্ধটি।
“আপনি এই ভাঙা, পোড়া হোটেলে থাকেন কেন?” মিতালী জিজ্ঞাসা করে।
“আমার ঠাকুরদা এই হোটেলের দারোয়ান ছিলেন, সেইজন্য এখানেই থাকতেন। আর কোনো বাড়ি ছিল না। এই হোটেলের শেষ দিন অবধি তাই আমিও এখনে থাকব।”
“এই হোটেলটা কি ভৌতিক, আর এটার এরকম দশা হলো কিভাবে” তুতুন বলল।
“শুনতে চাও যখন বলছি তবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার তোমাদের ওপর। এই হোটেল ভৌতিক কিনা সেটাও পুরোটা শোনার পর বুঝতে পারবে।” একটু থেমে আবার শুরু করল ।
“আমার ঠাকুরদা তখন এই হোটেলের দারোয়ান। বাবা ও কর্মচারী। হোটেলের তখন জমজমাট অবস্থা। সেইরকম এক শীতকালে বেড়াতে এলো বীথি কুন্তল নামে এক দম্পতি। ঠিক চারদিন ছিল। ঠিক সেইসময় এই হোটেলে এসে উঠেছিল একটি স্কুলের দশ বারো জন ছেলে আর দু’জন শিক্ষক। সবই ঠিকঠাক ছিল। সমস্যা হল ফিরে যাওয়ার সময়। দুই দলেরই ট্রেন ছিল “কুন্তী” স্টেশন থেকে। কিন্তু ওই স্টেশনটা যে ভালো নয়, রাতের বেলা সেখানে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে সে কথা তাদের বোঝাতে পারেনি হোটেল কর্তৃপক্ষ। নীল শরীরের আক্রমণ থেকে ওদের বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিল হোটেলের লোকেরা।”
“নীল শরীর মানে?” তুতুন বলে।
“এই গ্রামের সবচেয়ে নিকটবর্তী স্টেশন “কুন্তী”তে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এক বিশাল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল বিপ্লবীরা। মৃত সমস্ত লোক ফিরে এসেছিল যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে। ওদের এখনো দেখা যায় ওই স্টেশনে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে। আর কোনো মানুষ যদি ভুল করেও ওখানে যায় ট্রেন ধরতে তবে তাদেরও ওই নীল মানুষের ট্রেনে উঠতে হয়। তারাও হয়ে যায় নীল মানুষ। কেউ নীল শরীর নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামের মানুষ সবই জানে। তাই কোনো নীল শরীর দেখলেই ওরা পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে দিত। এখন আর নীল মানুষরা ফেরে না গ্রামে। তবে ওরা এখনো আছে।
যাই হোক, বীথিদের নিরস্ত করা গেলনা। ওরা সেই ওই স্টেশনেই চলে গেল। তবে শেষ বারের মতো ওদের বলে দেওয়া হয়েছিল স্টেশন মাস্টারের অনুমতি ছাড়া কোনো ট্রেনে না উঠতে। স্টেশনমাস্টার স্থানীয় লোক, তার কোনো ক্ষতি হয়নি কখনো। বিথীদের কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেদের দলটাও বেরোলো। ওদেরও একই কথা বলে দেওয়া হয়েছিল। বিথীদের ও ছেলেদের দলকে নিয়ে নিজে স্টেশনমাস্টার দাঁড়িয়েছিলেন প্লাটফর্মে। ধীরে ধীরে ওরা দেখে আরও মানুষের আগমন হচ্ছে। তাদের গায়ের চামড়া নীলচে। চোখ গুলি লাল। তারা সারা স্টেশন ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংখ্যায় অগুনতি। হঠাৎ একটি ট্রেন এলো কলেজের ছেলেরা কোনো বাঁধা না মেনেই উঠে গেল, ওরা এই পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারছিল না। ওরা উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু নীল মানুষ ও উঠে পড়ল। আর কলেজের ছেলেদের ট্রেনে ওঠা দেখে জয়ের হাসি হাসতে লাগল তারা। হাসির দমকে কেঁপে উঠলো স্টেশন । বীথি কুন্তলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। স্টেশন মাষ্টারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে ওদের ফিরে যেতে আদেশ দিল। ওদেরও আর ট্রেনে ওঠার সাহস ছিল না। ওরা সেই রাত্রে হোটেলে ফিরে এসেছিল। কিছু না খেয়েই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। বীথি ঘুমালে বাইরে আসে কুন্তল। রাত বারোটা নাগাদ কমন খাবার জায়গা মানে ডিনার রুমে থেকে হইহল্লা শুনে কুন্তল উঁকি মেরে দেখতে যায়। সে দেখে সেই ছেলেদের দল ওখানে বসে খাচ্ছে। ওকে দেখে তারা চমকে উঠে। হোটেলের বাকি কর্মচারীরাও ছিল ওখানে। কৈফিয়ত এর সুরে ওরা বলে পরের স্টেশনে নেমে গেছিল ওরা। সেখান থেকে এই হোটেলে চলে এসেছে। কুন্তল আবার রুমে ফিরে যায়। ও বীথিকে জাগিয়ে তোলে, সবটা বলে। বীথি বলে ওরা তো সাধারণ দেখতেই, তাহলে ওরা সত্যি বলছে। কুন্তল বলে, না সমস্যাটা হলো হোটেলের কর্মচারীদের গায়ের রং নীল লাগছে, ওরা সবাইকে নীল মানুষ করে দিয়েছে। আমি অভিনয় করছিলাম যেন আমি ওদের চিনি না। আমাদের যেভাবে হোক পালাতে হবে। বীথির মুখের রং সাদা হয়ে গেল ভয়ে। কিভাবে পালাবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা। শেষে ওরা বাথরুমের জানলা ভেঙে পালিয়ে যায়। গ্রামের মানুষদের ডেকে আনে, আগুনে পুড়িয়ে দেয় পুরো হোটেল। আমি বাদে কেউ রক্ষা পায়নি। আমার বয়স ছিল পনের বছর।সেই থেকে আমি একাই রয়েছি।”
” আপনাকে ওরা নীল মানুষ বানায়নি কেন?” মিতালী জিজ্ঞেস করল।
“বীথি কুন্তল ছিল একমাত্র মানুষ যারা নীল শরীরের হাত থেকে বেঁচে গেছে। তবে আমি জানতাম ওরা আবার আসবে, হয়ত অন্য রূপে তবে ওদের আসতেই হবে। সেই জন্য তো এতবছর অপেক্ষা করে আছি। প্রতিশোধ চাই আমার” বিড়বিড় করতে থাকে বুড়ো।
“আপনাকে ওরা নীল মানুষ বানায়নি!” আবার জিজ্ঞেস করে মিতালী।
“কে বলেছে বানায়নি.. ” মোমবাতির আলোটা নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে সে, তার চামড়া ধীরে ধীরে নীল হচ্ছে। চোখের রং বদলাতে শুরু করেছে, পাগলের মতো বিড়বিড় করছে সে, “আসতে তো তোদের হতই, এক রূপে না হয় অন্য রূপে.. আমার এত বছরের অপেক্ষা… নীল শরীরের নেশা বড় বিষাক্ত..তার হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারেনা….
পরদিন সকালে বাকি বন্ধুরা গিয়ে দেখে মিতালী আর তুতুন এর মৃতদেহ। কোনার ঘরে ফাঁকা ধুলো ভর্তি মেঝেতে, কি জানি কি কারণে দুজনের গায়ের রং পুরো নীল হয়ে গেছিল।