আয়নামহল (পর্ব-৫)

আয়নামহল (পর্ব-৫)
-সঞ্জয় গায়েন

 

 

২১
মাসির বাড়ি মুক্তির আলো
কয়েকমাস ছিলাম ভালো

একবার করে সকলেরই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করা উচিৎ। মরতে মরতে বেঁচে ফেরার কি যে আনন্দ তা অন্যদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বোঝানোও সম্ভব নয়। আমি ফিরেছিলাম বলেই আমি বুঝি। বেঁচে থাকার আনন্দ যে কতখানি তা একমাত্র অনুভব করা যায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে মরতে মরতে বেঁচে ফিরে আসার পর। আমি সেই আনন্দ পেয়েছিলাম। জীবনে এত আনন্দ আর কখনো পাই নি। কয়েকমাস কেমন এক ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। শুধু মনে হত, আমি সত্যি সত্যি বেঁচে আছি এখনো। নিজের গায়ে নিজেই হাত বুলোতে বুলোতে ভাবতাম, এই তো আমার হাত, পা, গলা বুক সব আগের মতোই আছে। বুলোতে বুলোতে কি যে হতো আমার ছুটে যেতাম আয়নার কাছে। নিজেকে দেখতাম প্রাণ ভরে। কী ভালোই না লাগতো। সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেলতাম আমি। কেন আমি নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম? ছি ছি! কী ভুলটাই না করেছিলাম। প্রায়দিনই আমি এমন ভাবতাম। আর ঠিক তখনই আমার মাসি এসে আমাকে পিছন থেকে জাপটে ধরতো। কি রে কি এত দেখছিস নিজেকে? বলতে বলতে এক হেঁচকায় আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলত, নিজের প্রেমে পড়েছিস তো এবার। ঠিক করেছিস। এতদিনে এই প্রথম ভালোবাসতে শিখলি। এই সংসারে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে নেই। বুঝলি। এই আমাকে দেখ। আমি তো বিয়ে থা করি নি। করবোও না কোনদিন। কেন বলতো? কারণ আমি নিজেকে ভালোবাসি। আর যাকে ভালোবাসি তাকে নিয়েই তো জীবন কাটানো উচিৎ। তাই নয় কি?
মাসির কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শোনাতো। নিজেকে ভালোবাসি। নিজেকে নিয়েই থাকবো। এ কেমন কথা। এভাবে একা একা থাকা যায়? তাও সমস্ত জীবন! কিন্তু মাসিকে দেখে মনে হয়েছিল থাকা যায়।
মাসির বাড়ি থাকতে থাকতে কিছুদিনের মধ্যেই আমার শারীরিক দুর্বলতা যেটুকু ছিল তা কেটে গিয়েছিল। তবু ঘরের মধ্যেই থাকতাম। বাইরে তেমন একটা বের হতাম না। মাসিও অফিস চলে যেত। তখন আমি একা। একা একাই থাকতাম। বই পড়তাম। গান শুনতাম। ঘুমোতাম।
মাসিটাও যেন কেমন ছিল। আলমারী ভর্ত্তি কত শাড়ী, ব্লাউজ, শালোয়ার কামিজ। কিন্তু সেসব কোনদিন পড়তো না। মাসির একটাই ড্রেস। জিনস আর টি শার্ট। নেলপালিশ, লিপস্টিক, পারফিউম, জুয়েলারীও ছিল। সেসবেও হাত দিত না। মাথা ভর্ত্তি চুলও রাখতো না। ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে কেটে আসতো। একদিন জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, আমার মেয়ে হতে ভাল্লাগে না। বলেই কেমন এক রহস্যের হাসি হেসে বলেছিল, তুই তো মেয়ে। যা আজ থেকে এগুলো সব তোর।
আমি তারপর থেকে মাসির সেইসব শাড়ী একটা একটা বের করে নিজেকে সাজাতাম। আর নিজে নিজেই দেখতাম। এমনি করতে করতে নিজেকে একটু একটু ফিরে পাচ্ছিলাম। তারই মধ্যে হঠাৎ একদিন। গভীর রাত। আচমকা আমার ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। মাসির বাড়ি এসে মাঝে মাঝেই এমন হত। সেদিনও তেমন ঘুম ভেঙে যেতে, কী জানি কেন ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। যাওয়ার পথে কেমন যেন গোঙানির আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। আওয়াজটা মাসির ঘর থেকে আসছিল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করতেই বুঝেছিলাম কিসের আওয়াজ। যৌনসুখ পাওয়ার শিৎকার। কিন্তু মাসির ঘরে তো কোন পুরুষ নেই! সেদিন মাসির এক বান্ধবী এসেছিল। তাকেও মাসি বলেই ডেকেছিলাম। দুই মাসিই সেদিন ঘরে ছিল। তাহলে ওই সুখ কিভাবে পাচ্ছিল। কৌতুহল দমন করতে না পেরে পা টিপে টিপে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আসতে আসতে পর্দার আড়াল সরাতেই চোখে পড়েছিল, ঘরময় মৃদু আলো। সেই আলোয় দেখেছিলাম মাসিরা সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় দেহসুখ নিচ্ছিল। মাসির কোমরে ঝুলছিল আস্ত পুরুষাঙ্গের মতো একটি দন্ড। আর সেই দন্ড দিয়েই মাসি তার বান্ধবীকে দেহসুখে ভরিয়ে দিচ্ছিল। নিজেও নিচ্ছিল। দেখতে দেখতে কেমন যেন বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে। খেয়ালই ছিল না, মাসিরা কখন বেরিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল। খেয়াল হয়েছিল, যখন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে মাসি বলে উঠেছিল, এভাবে দেখতে নেই সোনা। যাও নিজের ঘর যাও।
সেই রাতে বুঝেছিলাম, মাসিও আমার মতো উলটো। শরীরে নারী মনে মনে পুরুষ। আর তাই চাকরীর অছিলায় বাইরে চলে এসেছিল। সবার সংসর্গ ত্যাগ করে। সেটা জানার পর আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম। বুঝেছিলাম, এইজন্যই মাসি আমার মন বোঝে।
কিন্তু সেই আনন্দ আমার কপালে সইল না। আমার অমন মাসি যে আমাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়ে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছিল; বলেছিল, শুধু নিজেকে ভালোবাসবি; সেই মাসি কিনা গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরল! কেন? কেন! কেন! মাসিও তো নিজেকেই ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসার এমন পরিণতি ভাবতেই পারি নি।
মাসি যেন আমার জীবনে কর্পূরের মতো এসেছিল। প্রথমে সুগন্ধে ভরিয়ে দিল। তারপর আগুনের পরশমনির ছোঁয়া দিতে নিজেকে পুড়িয়ে উবে গেল। কিন্তু কর্পূর নিজে পুড়লেও অন্যকে যেমন তার আঁচও লাগতে দেয় না, মাসিও তেমনি ছিল। পুড়ে মরার জন্য কাউকে দায়ী করে যায় নি। সুইসাইড নোটে লিখেছিল, হঠাৎ করেই বাঁচার ইচ্ছে চলে গেল। কেন তা বলতে পারব না। এরপর জোর করে বাঁচতে চাইলে সে বাঁচা হত যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা। যা আমি কক্ষনো চাই নি। তার চেয়ে এই বরং ভালো। যে ক’দিন বেঁচেছি নিজের মতো করে বেঁচেছি। মৃত্যুটাও তেমন হলে বৃত্ত পূর্ণ হবে। তাই স্বেচ্ছামৃত্যুই শ্রেয়। জীবনের দৈর্ঘ্যটা হয়তো ছোট হল। কিন্তু যেটুকু জীবন পেয়েছিলাম আনন্দেই কাটিয়ে গেলাম।
মাসির মৃত্যুর পর মাসির সেই বান্ধবীর খোঁজ পেয়েছিলাম। মাসির অফিসেই কাজ করতো। একবার ভেবেছিলাম, সবাইকে সেই রাতের কথা বলে দিই। কিন্তু বলিনি। কারণ বললেই মাসির যৌন পরিচয় সবাই জেনে যেত। তখন মাসির প্রতি দেখানো সহানুভুতির সব রস মরে গিয়ে যা পড়ে থাকত তার নাম ঘৃণা। আর আমি তা কিছুতেই চাই নি। তাই মুখ বুজে সব সয়েছিলাম। শুধু একবার সেই বান্ধবীকে দেখতে চেয়েছিলাম। আমাকে দেখে ওনার চোখ দু’টো ভিজে উঠতো কিনা দেখার জন্য। সে আশাও পূরণ হয় নি।

২২
মাসির মৃত্যু আমার দোষ
সবার গলাতে আফশোষ

মাসি আমাকে দোষী করে নি। তবু খবর পেয়ে ছুটে এসে সবাই যেন আমাকেই দোষীর চোখে দেখছিল। গলায় আফশোষ আর চোখে সন্দেহের তির দিয়ে আমাকেই বিদ্ধ করেছিল। মাসিকে দগ্ধ করতে যেটুকু আগুন দেখেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি আগুন আমাদের আত্মীয় স্বজনদের চোখে জ্বলে উঠেছিল।
এমনই পোড়া কপাল আমার সেই আগুনে ফুঁ দিয়েছিল পুলিশও। নেভাতে নয়, আরও দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিতে। মাসির মৃত্যুর জন্য নাকি আমিই দায়ী ছিলাম। আমি রূপান্তরকামী নারী হয়ে স্বাধীনচেতা মাসির সঙ্গে একা একা থাকতাম। আর আমাদের মতো মানুষ নাকি সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শিখি নি। সমাজের বেড়াজাল মানতে শিখিনি। এককথায় আমাদের দু’জনের মধ্যে কোন আগল ছিল না। তাই আমার জন্যই মাসির মৃত্যু হয়েছিল তা বুঝে নিতে পুলিশের নাকি দু’মিনিট সময় লেগেছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখারও প্রয়োজন পড়ে নি।
পুলিশ এসেছিল। এসেই যখন শুনেছিল আমি মাসির সঙ্গে একা থাকতাম, তখনই বাঁকা হাসি হেসেছিল। কোন ফরম্যালিটির ধার না ধেরেই আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার বাড়ির লোক ন্যূনতম প্রতিবাদটুকুও করে নি। করবে কেন? তারাও তো পুলিশের মতে সায় দিয়েছিল এবং আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তারা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল।
আমিও আমার স্বপক্ষে কিছু বলি নি। কি হত বলে! বিশ্বাস যখন ধারণা থেকে জন্ম নেয়, তখন ধারালো যুক্তিও তা খন্ডন করতে পারে না। মনে মনে ভেবেছিলাম, এ বরং ভালোই হল। মাসি চলে যাওয়ার পর সেই তো নাহলে আবার বাড়ি গিয়ে থাকতে হত। আবার নিজের বাবার হাতে…। তার চেয়ে বাকী জীবন জেলে কাটিয়ে দেব। তাই চুপচাপ সবার সামনে দিয়ে পুলিশের জিপে গিয়ে বসেছিলাম।
তবে, পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু লকআপে ঢোকায় নি। কি করে ঢোকাবে? লকআপে তো দু’টো সেল। পুরুষের আর নারীর। আমাদের জন্য কোন সেলই নেই। তার জন্য অবশ্য পুলিশের কোন অসুবিধে হয় নি। লকআপে ঢোকাতে না পারলেও সারারাত দু’ তিনজন মিলে নিজেদের পুরুষ হিসাবে জাহির করতে যে রডের কথা বলে, তা ঢুকিয়েছিল। আমার পায়ুছিদ্রে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছিলাম। ছটফট করেছিলাম সারারাত। শেষে ভোররাতে আর সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করেছিলাম। কেঁদে কেটে বলেছিলাম, আমি তো কোন অন্যায় করি নি। তবু আমাকে মারছেন কেন? আপনারা কেন ভাবছেন মাসির সঙ্গে আমার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আমার কাছে আমার মাসি ছিল জীবন্ত দেবীর মতো। দেবীর চরণ ছোঁয়া যায়। অন্য কিছু স্পর্শ করার কথা মনে আনাও পাপ। কিন্তু আমার সেই কাকুতি-মিনতিতে কেউ কর্ণপাত করে নি। শেষে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, আমার উপর এমন টরচার করছেন তো, কাল যখন আমাকে কোর্টে তুলবেন আমি মিডিয়া ডেকে সব বলবো। একজন রূপান্তরকামী নারীকে ধরে এনে লকআপে না রেখে সারারাত তার ধর্ষণ করেছেন।
ব্যাস। আর যাই কোথা। লকআপ থেকে কয়েকজন গুন্ডা মতো দেখতে লোককে বের করে এনে আবার আমার উপর শারীরিক অত্যাচার করিয়েছিল। আমি ব্যথায় উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। পায়ু থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছিল। গড়িয়ে যাচ্ছিল মেঝেতে। আর সেই রক্ত দেখতে দেখতে পুলিশের এক অফিসার বলেছিল, এ দেশে কেবল নারীর শ্লীলতাহানি হয়, ধর্ষণ হয়। তোরা যতই নারী সেজে নিজেদের নারীী- নারী বলে চিৎকার করিস, আসলে লোকে তোদের হিজড়েই ভাবে। এমন হিজড়ে সেজেই থাক। কিচ্ছু বলব না। লোক জানে তোদের যৌনাঙ্গ বলে কিছু নেই। তাই ওসব শ্লীলতাহানি, ধর্ষনের কথা মুখেও আনিস না। বুঝেছিস। এরপরও যদি মিডিয়ার হুমকি দিস, তাহলে সবার সামনে ন্যাংটো করে দেখিয়ে দেব তোর আস্ত পুরুষাঙ্গটা। হিজড়ে না হয়েও হিজড়ে সেজে টাকা তুলিস ব’লে কেস দিয়ে যাবজ্জীবনের জন্য ঢুকিয়ে দেব।
ওসব শুনে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। লোকমুখে শোনা প্রবাদ বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে একশো আট ভয়ংকরভাবে সত্যি মনে হয়েছিল সেদিন।
তারপর ভোরের আলো ফুটতেই পুলিশের কি মনে হয়েছিল কি জানি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল থানা থেকে।

২৩
ছেলের জন্য মুখ কালো
হারিয়ে গেলে হয় ভালো

ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কী লজ্জা! কী লজ্জা! শেষে কিনা নিজের মাসির সঙ্গে… ভাবতেই পারিনি সেদিন। বোনটাকেও বলিহারি। স্বাধীনভাবে জীবন কাটাবো। কক্ষনো বিয়ে করব না। কত বড় বড় বুলি। ছেলেটা আমার বিষ খেয়ে মরতে বসেছিল। দেখতে এসে ভালোমানুষী দেখিয়ে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই শুনে অনেকেই তখন বলেছিল, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ভালো লক্ষণ নয়। সেদিন কারও কথা বিশ্বাস করি নি। কিন্তু সেটাই সত্যি হল। মায়ের পেটের বোন শেষে এইসব করার জন্য নিজের বোনপোকে নিয়ে গিয়েছিল…। একথা শোনাও পাপ। আর আমার ছেলেটা। ছোট থেকেই নিজেকে নাকি মেয়ে ভাবতো। তাই যদি হত তাহলে মাসিও তো মেয়ে। তাহলে তার সঙ্গে কি করে অমন করতে পেরেছিল…?
বোনটার নিশ্চয় গর্ভে বাচ্চাকাচ্চা এসে গিয়েছিল। তাই আগুনে পুড়ে মরে লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু কথায় ব’লে সাগর কখনো শুকোয় না আর পাপ কখনো লুকোয় না। মরার পরে পুলিশ ঠিক ধরতে পেরেছিল। আর ধরতে পেরেই আমার ছেলেটাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েছিল। ভালোই হয়েছিল। অমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। ওর জন্য জেলই উপযুক্ত জায়গা ছিল।
কিন্তু পরদিন বডি আনতে যেতে বলেছিল, আমার ছেলেকে নাকি ওরা ছেড়ে দিয়েছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও বোনের প্রেগনেন্সির কথা লেখে নি। না লিখলেও সন্দেহের দাগ একবার লাগলে তা সহজে ওঠে না। আর এ তো চরিত্রে দাগ লাগা। সারাজীবন দগদগে হয়ে থাকবে।
ছেলেটা নিজে থেকে হারিয়ে গিয়ে একদিক থেকে ভালোই করেছিল। লোকলজ্জার মাথা খেয়ে আবার যদি বাড়ী ফিরে আসতো ওর বাবা ওকে তাড়িয়েই দিত। আমি মা হয়েও আটকাতে পারতাম না। তার চেয়ে ছেলে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়ে বাপ-মা’কে ছেলেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো পাপ কাজ করা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
তবে ছেলে তার কর্তব্য করেছিল। কিন্তু আমরা আমাদের কর্তব্য করি নি। একটুও খোঁজার চেষ্টা করি নি ছেলেটাকে। ওর বাপ না হয় পুরুষ মানুষ। মায়া-দয়া ছিল না। কিন্তু মা হয়ে সেদিন আমিও তো পাষাণ হয়ে ছিলাম। আমিও তো পারতাম এদিক ওদিক খোঁজ করতে। থানায় গিয়ে নিদেন একটা ডায়েরীও তো করা যেত। ওর প্রতি আমাদের রাগ-ঘৃণা এত জমেছিল যে সেদিন কিচ্ছুটি করি নি।
লুকিয়ে লুকিয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে ওর জন্য কেঁদেছিলাম। তাও প্রায় মাস ছয়েক পরে।

২৪
জীবন পথে আবার বাঁক
লগনে যাওয়ার এল ডাক

থানা থেকে বের করে দেওয়ার পর সোজা স্টেশনে এসেছিলাম। কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এসেই স্টেশনের বেঞ্চে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল ছিল না। যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি একটি চলন্ত ট্রেনে শুয়ে আছি। সারা গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। জিভ শুকিয়ে আঁঠা আঁঠা হয়ে আছে। কোনরকমে অস্ফুট স্বরে বলতে পেরেছিলাম, জল। জল। তারপরেই আবার চেতনা হারিয়ে ছিলাম। তবে পুরো চেতনা হারায় নি মনে হয়। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়ে গিয়েছিলাম। আর সেই ঘোরের মধ্যেই শুনতে পাচ্ছিলাম, কারা যেন বলাবলি করছিল, তুই ঠিক চিনেছিস তো? এ আমাদের মতো? সেই শুনে অন্য একজন বলেছিল, ওরে আমরা হলুম সাপুড়ের জাত। সাপ চিনতে পারব না তা কি হয়! বিশ্বাস না হয়, ওর জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞেস করিস ওকে।
পরদিন। ট্রেন থেকে নেমে জেনেছিলাম, ওরা চারজন আমাকে স্টেশনে শুয়ে গোঁ গোঁ করতে শুনে ছুটে গিয়েছিল। আমাকে দেখেই ওরা বুঝেছিল, আমিও ওদের মতো। রূপান্তরকামী নারী। তাই সাত পাঁচ না ভেবে ওরা আমাকে সঙ্গে নিয়েই ট্রেনে উঠেছিল। ঠিক করেছিল না ভুল করেছিল জানি না। তবে আবার আমি মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। দু’দুবার বেঁচে ফেরা। ভগবান কি আমার কপালে মৃত্যু লেখে নি? শুধু কষ্ট পাওয়া লিখেছিল? যদি তাই হয়, সে লিখন মানবো না। এবার নিজেই লিখব নিজের ভাগ্য।
ওরা চারজন লগনে নাচতে যাচ্ছিল। সেই মোতাবেক নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমেওছিল। শুধু দাঁড়িয়েছিল, আমাকে নিয়ে কি করবে সেটা ঠিক করার জন্য। আমাকে পাশে বেঞ্চে বসিয়ে ওরা সেই নিয়েই আলোচনা করছিল। আমি ভেবে নিলাম, এই সুযোগ। হাত ছাড়া করার মানেই হয় না। উঠে এসে বলেছিলাম, আমাকে তোমাদের সঙ্গে নিলে খুব অসুবিধে হবে? আমি তেমন নাচতে জানি না। তবে তোমরা শিখিয়ে নিলে আমি পারব। তোমরা দেখো, আমি ঠিক পারবো। আমার কথা শুনে ওরা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। হাসতে হাসতেই বলেছিল, না পারার কি আছে? এ তো খুব সোজা। সবাই পারে। তবে অমন মেয়েলি পুরুষ সাজে হবে না। পুরোপুরি মেয়ে সাজতে হবে। পারবে তো?
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই, ওদের মধ্যে একজন বলে উঠেছিল, খুব পারবে। সেই শুনে অন্য একজন বলল, তুই কি করে বুঝলি? তার উত্তর দিল অন্য আর একজন, ওর বুক দু’টো দেখে। হি হি হি। বলেই সবাই মিলে একে অপরকে ঠেলা দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। আমিও সেই হাসিতে যোগ দিয়েছিলাম।

২৫
লন্ড্রা নাচে মাসেক ছয়
তারপরেতে ফেরা হয়

হাফলেডিস, ছক্কা, হোমো এসব শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম। বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে যাদের সহযাত্রী হিসাবে পেয়েছিলাম তাদের সৌজন্যে শুনলাম, আমাদের আর এক নাম লন্ড্রা। ছেলেলি শরীরে মেয়ে সাজ সেজে লগন মানে বিবাহ অনুষ্ঠানে মেয়ের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি আর বরযাত্রীদের আগে আগে নেচে যাওয়া, তারপর বিয়েবাড়ি পৌঁছে সেখানেও প্রায় সারা রাত নাচা। নানা চটুল গানে। ক’দিনেই কিছুটা নাচতে শিখে গিয়েছিলাম। আসলে এই ধরনের নাচ নাচতে হলে প্রথম যেটা দরকার তা হল লজ্জা ত্যাগ করা এবং লজ্জা বলতে সমাজ তো কেবল শারীরিক লজ্জা বোঝে। আর আমাদের শরীরে নাকি কোন লজ্জার অঙ্গ নেই। আমাদের শরীর কেবল লোক হাসাবার জন্য। সমাজের এই বিধান শুনে শুনে আমরাও লজ্জার উর্ধে উঠে গিয়েছিলাম। আর একটা ব্যাপার খুব কাজ করে মনে মনে। মানুষ তার চেনা পরিবেশে বেশি করে লজ্জা পায়। প্রতিপদে ভাবে, এই বুঝি কেউ কিছু বলল। কিন্তু একেবারে অচেনা জায়গায় যেমন খুশি, যা খুশি করা যায়। আমিও তাই করেছিলাম। যারা আমায় নিয়ে গিয়েছিল, তাদের অনুকরণ করে করে নাচতাম। তাতেই সবাই খুশি হত। সেই খুশিতে কেউ কেউ নাচ চলাকালীন উঠে এসে জড়িয়ে ধরতো। হাত ধরে টান দিত। কিন্তু সেই টানাটানিটা যে নাচ দেখে খুশি হয়ে নয়, পুরোপুরি শরীর ছোঁয়ার অছিলায়, সেটা বুঝতে মাত্র দু’দিন সময় লেগেছিল আমার।
তবে এবার আর রাগ হয় নি। কারণ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম, পুরুষ মানুষ নারীর শরীর ছুঁতেই ভালোবাসে। সুযোগ পেলেই ছোঁয়। আমাকে যারা নিয়ে গিয়েছিল, তারা এ ব্যাপারে বেশ চৌখোশ ছিল। একটু লক্ষ্য রাখতেই দেখতে পেয়েছিলাম, ছুঁতে দেওয়ার ফাঁকে তারা হাত রাখতে দিচ্ছিল নিজেদের বুকে। আর তার বিনিময়ে বুকের খাঁজে গুঁজে দিচ্ছিল এক দু’শো টাকার নোট। ওদের দেখাদেখি আমিও আর বুক আগলে রাখলাম না। কথায় বলে নাচতে নেমে ঘোমটা দিতে নেই। সেই প্রবাদ মেনে আমিও যেন বুঝে গিয়েছিলাম লন্ড্রা হয়ে বুক আড়াল করতে নেই। বরং বুক উঁচু করে নাচতে পারলেই, ছুঁতে দিলেই টাকা পাওয়া যাবে।
তবে লন্ড্রা নাচ মানেই শুধুই শরীর ছোঁয়া নয়। ক’দিন যেতেই বুঝেছিলাম বিবাহাচারের এ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হাজার হাজার বছরের পরম্পরা। আমাদের বহু প্রাচীন সংস্কৃতি। আর তখনই ভালোবেসে ফেলেছিলাম লন্ড্রানাচকে। সেই ভালোবাসার আরও একটা কারণ অবশ্য আমাদের মতো মানুষদের রুটি রুজির ব্যবস্থা করছে এই নাচ। বছরের পর বছর ধরে। যুগের পর যুগ ধরে। সেটাও কি কম নাকি! আমাদের কে তো কেউই কোন কাজ দিতে চায় না। সেখানে লন্ড্রা সংস্কৃতি বেঁচে আছে ব’লে কতজন খেয়েপড়ে বেঁচে আছে।
যাইহোক, লন্ড্রা নাচের সিজন ফুরিয়ে গেল। তারপরেও কিছুদিন এখানে ওখানে নেচে বেড়িয়েছিলাম। তাতেও কিছু উপার্জন হয়েছিল। তাও শেষ হল একসময়। আমার কোন ফেরার তাড়া ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। আমি তো ফিরব না বলেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু অন্যরা ফিরছিল দেখে আমারও ফিরতে ইচ্ছে হয়েছিল। ফিরেও এসেছিলাম।

২৬
হঠাৎ আসে অচেনা ফোন
কেঁদে উঠল মায়ের মন

রোদ যত চড়া-ই হোক, মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাক, এক পশলা বৃষ্টি পড়লেই সব নরম। অমন প্রকৃতি যদি ওইটুকুতে নরম হয়ে যায়, আমি তো মা! ছেলের প্রতি মায়ের মন নরম না হয়ে থাকতে পারে? পারে না। তাছাড়া ছেলে কাছে থাকলে, চোখের সামনে থাকলে রাগ করে থাকা যায়। চোখের আড়াল হলেই সব রাগ গলে জল হয়ে যায়। তখন তাকে কাছে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে মায়ের মন। আমিও আকুল হয়েছিলাম। প্রত্যেকদিন ঠাকুরকে ডাকতাম। কেঁদে কেঁদে বলতাম, হে ঠাকুর, তুমি তো সব জানো, সব বোঝ। কত অবিশ্বাস্য অঘটন ঘটিয়েছো। তেমন কিছু করতে পারো না আর একবার? তুমি কি এই অসহায় মায়ের ডাকে সাড়া দেবে না? তার রাগের মুখে ছেলেকে হারিয়ে যেতে বলাটাই বড় করে দেখবে? সবার আড়ালে দিনের পর দিন কান্নাটার কোন দাম নেই তোমার কাছে?
আমার সেই প্রার্থনার কারণে, নাকি ছেলে নিজে থেকেই সব অভিমান ভুলে, জানি না কোনটা ঠিক, হঠাৎ এক বিকেলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। আমি রিসিভ করে হ্যালো.. হ্যালো.. বলেই যাচ্ছিলাম, ওপ্রান্ত থেকে কোন সাড়া নেই। কিন্তু কেটেও দেয় নি। শুনে যাচ্ছিল। কি হল কে বলছো? কথা বলছ না কেন? আমি এভাবে বলে যাচ্ছি, হঠাৎ ওপ্রান্ত থেকে যেন ফোঁপানির আওয়াজ পেলাম। আমার গলা শুনে কে কেঁদে উঠতে পারে? তাহলে কি আমার খোকাই… ও প্রান্তে তখনই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে ওই ফোনে কল করতেই উত্তর এল সুইচ অফ।
পরদিন। আবার ঠিক ওই একই সময়ে। ওই একই নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। আমি দু’চারবার হ্যালো হ্যালো বলার পর, জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছেন?
শুনেই আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। বুকটা মোচর দিয়ে উঠেছিল। অবিকল সেই গলা! যে গলা শোনার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। দিনের পর দিন। সেই গলা শুনে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব। কত কথা হুড়মুড় করে বলতে ইচ্ছে করছিল। কিচ্ছুটি বলতে পারি নি। আমার গলাটা কে যেন চেপে ধরেছিল। আমি শুধু ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম।
আমার কান্না ছাপিয়ে আবার ভেসে এল সেই একই জিজ্ঞাসা, কেমন আছেন?
আমার অভিমানী ছেলেটা যেন শুনতে চাইছিল, আমি তাকে ছেড়ে ভালো আছি কিনা। পাগল ছেলে আমার। কোন মা তার ছেলে কে হারিয়ে ভালো থাকতে পারে! আমি নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে বলেছিলাম, তুই কেমন আছিস বাবা?
ব্যাস। ওইটুকু। উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দিয়েছিল। তারপর অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম। আর যোগাযোগ করতে পারি নি। ও-ও আর যোগাযোগ করে নি। ওর বাবাকে বলেছিলাম, নাম্বার টা থানায় দিয়ে খোঁজখবর নিতে। শুনেই খেঁকিয়ে উঠেছিল। বলেছিল, হিজড়ে ছেলের খোঁজ করে আর লোক হাসিও না।
লোক হয়তো সত্যিই হাসতো। কিন্তু মা কি আর হাসতে পারে? তাই সবাইকে লুকিয়ে নিজেই থানায় গিয়েছিলাম। নাম্বারটা জমা দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম, কোন্‌ এলাকা থেকে ফোনটা এসেছিল, সেটুকু অন্তত বলে দিলে খোঁজখবর করতাম। হাজার হোক পেটের ছেলে তো! কেমন আছে একবার চোখের দেখা দেখে আসতাম।
পুলিশ মুখ টিপে হাসি চেপে, চেষ্টা করব ব’লে দায় সেরেছিল।

 

চলবে…. 

Loading

One thought on “আয়নামহল (পর্ব-৫)

  1. দারুন এগোচ্ছে…

Leave A Comment