মা দোয়েল
– শিলাবৃষ্টি
অনেক দিন আগের একটা ঘটনা — যা মনকে নাড়া দিয়েছিল খুব। একটা ছোট্ট মা দোয়েল পাখির মনছোঁয়া কাহিনী।আমাদের একতলা বাড়ির ছাদে সবসময় কারণে অকারণে যেতেই হত। সবচেয়ে বড় কথা বিস্তীর্ণ আকাশের নীচে খোলাছাদ আমার এক নিরালা আস্তানা ছিল। সামনের বাড়ির পাঁচিলের ওধারে রক্তকরবীর গাছ কবে যেন অনেক বড় হয়ে গিয়ে আমাদের ছাদের সামনেই ডালপালা মেলে নিজের আনন্দে হাওয়ার তালে দোল খায়। আর সেই গাছের আনাচে কানাচে নেচে বেড়ায় দোয়েল, বুলবুলি, চড়াই পাখিরা। একদিন নজরে পড়ল গাছের ভেতরের দিকে গোপন ডালে – এক বুলবুলি মুখে করে শুকনো ঘাস বা খড় জাতীয় কিছু নিয়ে এসে বাসা বাঁধছে আর মাঝে মাঝে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। এরপর আমার কৌতুহলী চোখ ওই দিকেই চলে যেত। দু’ এক দিন পরে দেখলাম নীড় সম্পূর্ণ, আর দোয়েল পাখির দেহের অর্দ্ধাংশ সেই বাসায়। বেশ কয়েকবারই নজরে এল এই দৃশ্য। বুঝলাম ওখানে ওর ডিম আছে। কদিন পরে নজরে এল মুখে করে কিছু নিয়ে এসে ওই মা পাখিটা ছানাগুলোকে বোধহয় খাওয়াচ্ছে, তবে ছানাগুলোকে সেভাবে দেখতে পেতামনা। মন উসখুস করতো দেখার জন্য।
মাসটা বোধহয় বৈশাখ ছিল! বিকেল থেকে প্রবল ঝড়, আর তারপরে নামলো বৃষ্টি! চারিদিক তোলপাড়! লোডশেডিং, অন্ধকার! হঠাৎ মনে পড়ে গেল করবী গাছে দোয়েল ছানাগুলোর কথা! মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আহারে ছানাগুলো তো উড়তেও পারেনা। এই প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে ওরা মরেই গেল বোধহয়! তখনো বৃষ্টি কমেনি প্রবল কৌতুহল বশতঃ একটা ছাতা আর টর্চ নিয়ে ছাদে গেলাম, চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার! হাওয়া! গাছটা প্রবল দুলছে। লক্ষ্য স্হির করে টর্চের আলো ফেললাম, যা দেখলাম
তা চমকের থেকেও আরো কিছু ছিল! মনে হয় বিস্ময়! আমি চমকে গেলাম, এও সম্ভব! দেখলাম,
মা দোয়েল পাখিটা তার ছোট্ট শরীর আর আরো ছোট্ট দুটো ডানা দিয়ে তার বাসার মুখটা বন্ধ রেখেছে। এই প্রবল ঝড়ের আঁচ বা বৃষ্টির জলের ঢল – সে তার সদ্যোজাত সন্তানদের লাগতে দেয়নি। অবাক হলাম। ভাবতে পারিনি ওই এক আঙুল একটা পাখির এত ক্ষমতা? নিজের ছানাগুলোকে বাঁচাতে এত বড় কালবৈশাখী নিজের ছোট্ট শরীরের দিয়ে বাধা দিয়েছে! চোখটা সেদিন শুকনো রাখতে পারিনি।
আমি নিজে একজন মা । লক্ষ হাজার মায়ের মধ্যেও সেই মা দোয়েল আমার চোখে শ্রেষ্ঠ মা। সেদিনের
সেই স্বর্গীয় দৃশ্য আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা।