Site icon আলাপী মন

গল্প- দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়…রইলো না

 দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়…রইলো না

– পিয়ালী চ্যাটার্জী

 

গল্প- (১)
বর্ষা কে সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই সৌম্য খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে ঘরে চলে গেল। বর্ষা খাবার সাজিয়ে সৌম্য কে ডাকলো
“সৌম্য কি হলো ঘরে চলে গেলে কেন? খাবার দিয়েছি খেতে এসো।”
“না আমার খিদে নেই। তুমি খেয়ে নাও।”
“খিদে নেই মানে? একটু আগেই তো খেতে চাইলে বললে যে খুব খিদে পেয়েছে?”
“তখন খিদে ছিল কিন্তু এখন নেই।”
“মানে? কি হলো তোমার আবার?”
“এই যাও তো নিজে খেয়ে নাও।”
বর্ষা সৌম্যর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত দিতে গিয়েও দিলো না।
“কি হয়েছে বলো না সৌম্য।”
“বাইরে কোথায় গিয়েছিলে? বাবন কে খাবার দিতে তাই তো?”
“হ্যাঁ আজ রবিবার ওর স্কুল ছুটি তাই ওর পছন্দের রান্না করেছিলাম।”
“বাহ আজ রবিবার ওর ছুটি সেটা মনে আছে তবে যে আমার ও অফিস ছুটি সেটা মনে নেই।” রাগে বিছানার এক পাশে রাখা একটি বালিশ তুলে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিলো সৌম্য।
“এমন করে বলছো কেন? ও তো ছোট। আজ যদি আমাদের একটা সন্তান থাকতো তাহলে তো ওর বয়সেরই হত।”
“আমাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির কোনো দরকার নেই। তুমি আমাকে কথা দাও বর্ষা তুমি আর বাবন এর সাথে কথা বলবে না।” বর্ষার হাতটা ধরে সৌম্য নিজের মাথায় রাখলো।
অনেকক্ষন চুপ থাকার পর চোখের জল লুকিয়ে বর্ষা সৌম্যর মাথায় হাত দিয়েই বললো “ঠিক আছে তুমি যা চাও তাই হবে। এবার খেয়ে নাও।”
“হেহে এই তো আমার লক্ষী বর্ষা। আমি জানতাম তুমি আমার কথা ফেলবে না। কই দাও খেতে দাও খুব খিদে পেয়েছে।”
দুজনের খাওয়া হয়ে গেলে সৌম্য উঠে ঘরে চলে যায়। সপ্তাহে এই একটা দিন ছুটি পায় সৌম্য তাই রবিবার সে দুপুরবেলায় ঘুমিয়ে নেয়। পরেরদিন আবার সকালে উঠে অফিস দৌড়াতে হয়। সৌম্য অর্থাৎ সৌম্যজিৎ মিত্র স্টেট ব্যাংকের সিনিয়র ব্রাঞ্চ মেনেজার এর পোস্ট এ কর্মরত। বর্ষার ভালো নাম মেঘবর্ণা দে। বর্ষা বলে তাকে একমাত্র সৌম্য ডাকে এটা তারই দেওয়া নাম। সৌম্যর ভাবনা চিন্তাগুলো আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা। সৌম্য বর্ষা কে আর কারুর সাথে ভাগ করতে চায়না। বর্ষা যদি অন্য কারুর সঙ্গে কথা বলে তবেই সে মহাকাল রূপ ধারণ করে চড়াও হয় বর্ষার উপর।
বর্ষা একবার ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখে নিলো সৌম্য কে। একদম ছোট শিশুর মতো দুটো হাত বুকের সামনে জড়ো করে ঘুমাচ্ছে। নিজের মনেই হাসলো বর্ষা। ঘরে ঢুকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুল বেঁধে আয়নায় লেগে থাকা একটি লাল টিপ কপালে লাগালো তারপর সৌম্যর পায়ের সামনে রাখা একটি চাদর খুলে সৌম্যর গায়ে চাপা দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। ফ্ল্যাটের বারান্দা দিয়ে নীচে দেখা যাচ্ছে বাচ্চারা ফুটবল খেলছে। বাবন ও আছে সেই খুদে খেলোয়াড়দের দলে। বর্ষার চোখ ভারী হয়ে এলো বিকেলের শান্ত বাতাসে উল্টে গেল অতীতের পাতা।
পাঁচ বছর আগে বর্ষা আর সৌম্যর বিয়ে হয় মন্দিরে। বর্ষা বাড়ির অমতেই বিয়ে করেছিল সৌম্য কে। সৌম্যর আগে পিছে কেউ নেই। সৌম্য যখন স্কুলে পড়তো তখনই একদিন রাতে সৌম্যর দাদু অর্থাৎ তার মায়ের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং সেই খবরটা পেয়ে সেই রাতেই সৌম্যর বাবা মা বেরিয়ে পড়েছিল সেখানে পৌঁছানোর জন্যে তবে একটি মাল বোঝাই লরি বেকায়দা এসে ধাক্কা মারে তাদের গাড়িটিকে এবং তাদের সেই স্থানেই মৃত্যু হয়। সৌম্য তখন একা তাই তার সমস্ত দায়িত্ব তার মামা অরূপ নিয়ে নেয়। সৌম্য এই ঘটনার পর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে যায়। বর্ষার সাথে সৌম্যর আলাপ হয় কলেজে সেই থেকে বন্ধুত্ব এবং ধীরে ধীরে সেটা প্রেমে পরিণত হয়। বর্ষার বাবা আগে থেকেই তার জন্যে অন্য পাত্র ঠিক করে ফেলেছিলেন তাই বর্ষা কোনোদিন সাহস করে সৌম্যর কথা বাড়িতে বলে উঠতে পারেনি। বিয়ের দুদিন আগে বর্ষা সৌম্যর সাথে পালিয়ে বিয়ে করে এবং সৌম্য কিছু মাস পরে একটি আলাদা ফ্ল্যাট কিনে বর্ষা কে নিয়ে চলে যায়। এই ঠিকানাটা সৌম্য কাউকে দেয়নি এমন কি নিজের মামা কেও নয়। কারণ এটাই যে সৌম্য তার বউ বর্ষা কে সকলের থেকে আলাদা রাখতে চায়। বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত যতবার বর্ষা একটি সন্তান কে এই পৃথিবীতে আনার কথা বলেছে ততবার এরিয়ে গেছে সৌম্য।
“কি দরকার সন্তান এর? আমি তো আছি। তুমি আমাকে নিয়ে সুখী নও বর্ষা?”
বর্ষা প্রত্যেকবার এই এক কথা শুনে সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়েছে।
এসব কথা ভাবছে হঠাৎ একটি হাত এসে পড়লো বর্ষার এক কাঁধে, “কি হলো বর্ষা তুমি বারান্দায় কেন বসে আছো? তোমাকে না বলেছি সামনের বাড়ির ছেলেটার স্বভাব চরিত্র ভালো নয় এভাবে বারান্দায় বসবে না। চলো ভিতরে চলো।”
“সৌম্য তুমি দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছো। সব সময় সন্দেহ করা স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে তোমার।”
“বর্ষা তুমি বুঝতে পারো না সবাই কে বিশ্বাস করা যায়না। আমি সবাই কে হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে হারাতে চাইনা বর্ষা। ভিতরে চলো প্লিজ।”

বর্ষা কোনো কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেল। সৌম্য বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো।
“চলো না সৌম্য কোথাও ঘুরতে যাই আজ তো রবিবার।” সৌম্যর কাছে আবদারের সুরে বলে বর্ষা।
“না কোনো দরকার নেই বাইরে যাওয়ার। আজ রবিবার আজ অনেক লোকজন থাকে বাইরে। টিভি তে অনেক ভালো ভালো প্রোগ্রাম হয় সেটা দেখো।”
“সৌম্য বিয়ের পর যেদিন থেকে এই ফ্ল্যাটে এসেছি কোথাও নিয়ে যাওনা আমায় এমন কি ফ্ল্যাটের ছাদে পর্যন্ত উঠতে দাওনা। শুধু বাবন এর সাথে কথা বলতাম সেটাও বন্ধ করে দিলে।” কাঁদতে কাঁদতে বললো বর্ষা।
বর্ষার চোখে জল দেখেই ধরপরিয়ে উঠেলো সৌম্য, “বর্ষা আমার উপর রাগ করো না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।”
বর্ষা সৌম্যর পাশে সোফায় বসে বললো, “সৌম্য তোমার এই আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়টাই দেখবে একদিন আমাকে হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জীবনে মানুষ কে বিশ্বাস করতে জানতে হয় নাহলে একদিন এমন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে যে আর ফিরে আসতে পারবে না।”
“না বর্ষা না। আমি তোমাকে হারাতে চাইনা। এমন কথা বলো না।” সৌম্য বর্ষা কে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো।
(২)
“কিরে পরশু থেকে তো পূজোর ছুটি তা চল না চার জনে মিলে কোথাও ঘুরে আসি।” সৌম্য কে তার সহকর্মী বিভাস সান্যাল প্রস্তাব দিলেন লাঞ্চ টাইমে।
“চারজন? কোন চারজন?” বিরক্তি সুরে বললো সৌম্য।
“আরে তুই, বৌদি আর আমি আর সুপর্ণা।” বলে কিছুটা থামলো বিভাস। “আসলে জানিস তো কাজের চাপে কোথাও নিয়ে যেতে পারিনা ওকে আর ওর তেমন বন্ধু ও নেই। বৌদি থাকলে ও একটা বন্ধু পাবে।”
“না আমাদের পূজো তে অন্য প্ল্যান হয়ে গেছে। আমরা তোদের সাথে কোথাও যেতে পারবো না। আগের থেকেই প্ল্যান মত টিকিট কেটে ফেলেছি নাহলে তোকে বলতাম।” নির্বিঘ্নে মিথ্যে কথাগুলি বলে চললো সৌম্য।
“ঠিক আছে কি আর করা যাবে তাহলে। যা ঘুরে আয়। হ্যাপি জার্নি।”
“হুম থ্যাঙ্কস।”
“তা কবে বেরোচ্ছিস?”
“কোথায়?”
“এই যে ঘুরতে যাবি বললি।”
“ও হ্যাঁ এই তো পরশুই।”
“পরশুই বেরোচ্ছিস? কোথায় যাচ্ছিস?”
“উফফ সব ব্যাপারে তোর এত কৌতূহল কিসের রে? যা না নিজের কাজে।” বেশ গম্ভীর গলায় বললো সৌম্য। বিভাস একটু অবাক হলো ঠিকই তবে আর কথা না বাড়িয়ে কাজে ফিরে গেল। ছুটি হওয়ার পর সবাই একে ওপর কে পূজোর শুভেচ্ছা জানিয়ে নিজেদের বাড়ি ফিরে গেল।
কলিং বেল এর আওয়াজে বর্ষা ছুটে গিয়ে দরজা খুললো। দরজা খুলে দেখলো সামনে পাশের ফ্ল্যাটের মালা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“ও মালা দি তুমি। কি হয়েছে গো?”
“না কিছু না আমি একটু বাইরে যাচ্ছি বাবন এর জন্যে পূজোর জামা কিনতে। তুমি একটু ওকে দেখবে ভাই? আসলে বাড়ি ফাঁকা ওকে একা রেখে যেতেও মন চাইছে না।”
“হ্যাঁ এ আবার বলতে আমি ওকে…” কথা টা বলতে গিয়ে আটকে গেল ঠিক গলার সামনে এসে। সৌম্যর ফেরার সময় হয়ে এসেছে সে ফিরে যদি দেখে বাবন এখানে তাহলে কুরুক্ষেত্র বাধাবে। তাছাড়া সৌম্যর মাথা ছুঁয়েও যে সে প্রতিজ্ঞা করেছে তাই বা ভাঙে কি ভাবে। কিন্তু সে তো বলেছে বাবন এর সঙ্গে কথা বলবে না এমন তো হতেই পারে যে বাবন তার চোখের সামনেও থাকলো এবং বর্ষা তার প্রতিজ্ঞা ও রাখলো। হ্যাঁ তাই ভালো হবে।
“আচ্ছা দিদি তুমি বাবন কে এখানে দিয়ে যাও।”
মালা বাবন কে বর্ষার কাছে দিয়ে নিশ্চিন্তে পূজোর কেনাকাটা করতে চলে গেল। বাবন কে একটা খাতা পেন এনে দিলে বাবন সেই খাতায় বিভিন্ন চিত্র বানাতে লাগলো। এর মাঝে অজস্র প্রশ্নের তীর বাবন ছুঁড়েছে বর্ষার দিকে তবে বর্ষা বাবন এর কোনো প্রশ্নের ই উত্তর দেয়নি। খুব বেশি হলে শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বা না টুকু বুঝিয়েছে। মালা যাওয়ার বেশ কিছুক্ষন পরে আবার কলিং বেল এর আওয়াজে বর্ষা দরজার সামনে ছুটে গিয়ে দরজার ফুটোয় চোখ রাখলো এই আশায় যে মালা ফিরে এসেছে তবে তা হলো না। বাইরে সৌম্য দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় আরো দু বার বেল বাজলো। বর্ষা ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিলো।
“উফফ এতক্ষন লাগে দরজা খুলতে! কি জ্যাম রাস্তায় সবাই পূজোর কেনাকাটা করতে ব্যস্ত তাই এত ভিড়। এরা যে কি আনন্দ পায় ভগবান…. একি ও এখানে কেন?” জুতো জোড়া খুলে ঘরের দিকে যেতে গিয়ে চোখ পড়লো সোফায় বসে থাকা বাবন এর দিকে।
“কি হলো উত্তর দাও ও এখানে কেন?”
“মালা দি ওর জন্য পূজোর কেনাকাটা করতে গেছে তাই এখানে দিয়ে গেছে ওকে। ও ছোট তাই আর ভিড়ের মধ্যে নিয়ে যায়নি ওকে।”
“বাহ ওর মা দিয়ে গেল আর তুমি ওকে রেখে দিলে। একবার ও মনে পড়লো না যে আমার মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলে…” মাঝখানেই সৌম্যর কথা থামিয়ে দিলো বর্ষা।
“না বিশ্বাস করো আমি কোনো কথা বলিনি ওর সাথে। ওকেই জিজ্ঞেস করো বিশ্বাস না হয়।”
ঠিক সেই সময় কলিং বেলের আওয়াজে দুজন তাদের বাক বিতণ্ডা থামালো। বর্ষা দরজা খুলতেই যাবে হঠাৎ সৌম্য তাকে আটকালো।
“দাঁড়াও তুমি ভিতরে যাও আমি খুলছি।”
“না মানে তুমি তো সবে ফিরলে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও না।”
“আহ এত কথা ভালো লাগছে না ভিতরে যেতে বললাম তো।”
বর্ষা কথা না বাড়িয়ে ঘরে ঢুকে ঘরের দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো যাতে বাইরের সব কথা সে শুনতে পায় ভিতর দিয়ে।
“ও সৌম্য। অফিস থেকে ফিরে এসেছো। তা বর্ষা কোথায়?”
“বর্ষা? কে বর্ষা? ওর নাম মেঘবর্ণা। ওকে বর্ষা বলে ডাকার অধিকার শুধুমাত্র আমার আছে আর কারুর নয়।”
“তুমি এইভাবে কেন বলছো? আমি তো….”

“থাক কিছু বলার দরকার নেই। আমার বর্ষা খুব বোকা ও বোঝেনা তবে আমি বুঝি আপনি আপনার ছেলে কে ওর কাছে পাঠিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করতে চান। এই যে আমাদের মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি নেই সেটা আপনাদের সহ্য হয়না। নিজের ছেলে কে অন্যের দায়িত্বে রেখে কি উদ্বেগহীনের মতন কেনাকাটা করতে চলে গেছেন। যান নিয়ে যান আপনার ছেলে কে।”
সৌম্য এগিয়ে গিয়ে বাবন এর হাত ধরে বাবন কে এনে তার মায়ের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো, “আর কখনো আমার বর্ষার সাথে কথা বলতে আসবেন না যেচে পড়ে।”
মালা বাবন কে নিয়ে চলে গেলে সৌম্য দরজা বন্ধ করে বর্ষার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
“একি বর্ষা তুমি কাঁদছো কেন?”
“সৌম্য আমি আর পারছি না। এই অসহ্য যন্ত্রনা আমাকে দিন রাত একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে।”
“কি যন্ত্রনা বর্ষা? তোমার শরীর খারাপ? চলো ডাক্তার এর কাছে চলো।” বর্ষার একটা হাত টেনে সদর দরজার দিকে টানলো সৌম্য।
বর্ষা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললো, “সৌম্য ডাক্তার এর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন আমার নয় তোমার। তুমি নিজেও জানোনা যে তুমি মানসিক ভাবে অসুস্থ।”
সৌম্য একেবারে চুপ হয়ে গেল। বর্ষার হাত ছেড়ে দিয়ে সোফার উপরে গিয়ে বসলো। বর্ষা ও সেদিকে এগিয়ে গিয়ে সৌম্যর হাত ধরে বললো, “সৌম্য আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমি জানি তুমিও আমাকে খুব ভালোবাসো তবে তোমার এই ভালোবাসাটা দিন দিন একটা আবেশে পরিণত হচ্ছে। এমন তো নয় যে পৃথিবীর সব স্বামীই তার বউ কে বাড়ির মধ্যে আটকে রাখে, কোথাও বেড়াতে দেয় না বা কারুর সাথে কথা বলতে দেয় না। তাহলে কি সবাই তাদের
ভালোবাসা কে হারিয়ে ফেলছে? তোমার কেনোই বা আমাকে হারানোর ভয় থাকবে আমার উপর কি তোমার বিশ্বাস নেই?”

“তোমার উপর বিশ্বাস আছে বর্ষা। আমি ভাগ্যবান যে তুমি আমাকে ভালবেসেছো তবে তুমি জানোনা বর্ষা এই পৃথিবীর মানুষগুলো ভালো না। ওরা অন্যের খুশি সহ্য করতে পারেনা। তোমার উপর শুধুমাত্র আমার একার অধিকার আছে আর কারুর না। আমি ভেবে নিয়েছি আমি তোমাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। এখানে আর থাকবো না। আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করবো যেখানে শুধুমাত্র তুমি আর আমি থাকবো।”
“মানে কোথায় যাবো আমরা সৌম্য?” কিছুটা কৌতূহল এবং কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো বর্ষা।
সৌম্য নিজের দুই হাত দিয়ে বর্ষার গাল দুটি ধরে বললো, “আমি কালই চাকরিটা ছেড়ে দেবো। আমি বেশ বুঝতে পারছি সবাই আমাদের দুজনের এই সম্পর্কটা ভেঙে দিতে চাইছে। আমি তা হতে দেবো না বর্ষা আমি তোমাকে নিয়ে অনেক অনেক দূরে চলে যাবো। অনেক দূরে। আমি তোমাকে হারাতে দেবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না তো বর্ষা?”
বর্ষা কোনো উত্তর দিলো না। সৌম্য একবার দুবার তিনবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো তাও বর্ষা কোনো উত্তর দিলো না। সৌম্য সোফা ছেড়ে উঠে বর্ষার কাঁধে দু হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে ভয়ানক রকম চিৎকার করে উঠলো।
“বর্ষা! উত্তর দিচ্ছ না কেন? কানে কথা যাচ্ছে না? তুমিও ওই মানুষগুলোর মতো হয়ে যাচ্ছ তাই না? তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে তাই না? কিন্তু তা আমি হতে দেবো না বর্ষা। তুমি শুধু আমার আর শুধু আমারই থাকবে সেটা তুমি যদি ভালো ভাবে মেনে নাও তবে তোমার পক্ষেই ভালো।”
“সৌম্য তুমি পাগল হয়ে গেছো। যেই মানুষটাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম তুমি সেই মানুষটা নেই আর। আমার পক্ষে তোমার সাথে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আমি কালই নিজের বাড়ি চলে যাবো। আমি আর তোমার সাথে থাকবো না।”
বর্ষা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। সৌম্য যে তাকে নিয়ে ইর্ষান্বিত তা সে জানতো তবে আজ যেই রূপটা দেখলো সৌম্যর তা আগে কখনো দেখেনি সে। আজ যেন সৌম্যর চোখে এক জ্বলন্ত আগুনের গোলা দেখলো বর্ষা যেটা তার সমস্ত ভালোবাসা কে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে ফেললো। না! এই মানুষটিকে আর মন থেকে ভালোবাসতে পারবে না বর্ষা।
(৩)
আজ বাড়ি ফেরার সময় সৌম্য তার কর্মক্ষেত্রে পদত্যাগ পত্র দিয়ে এসেছে। এবারে আর কোনো চিন্তা নেই সৌম্যর, কিছু মাস ধরেই সে এই পরিকল্পনা করেছিলো বর্ষা কে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার। কাউকে কিছু না জানিয়ে দু সপ্তাহ আগে সে একটা বাড়ি দেখে সেটা কেনার কথাও বলে এসেছিলো। জায়গাটা দেখেই সৌম্যর পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। বাড়িটার আসে পাশে তেমন জনবসতি নেই। সবুজ গাছে ভরা বাড়িটার চারিপাশ, এমন দৃশ্য যদিও কলকাতা শহরে দেখা যায়না। অনেক ভেবে চিন্তে সৌম্য ঠিক করে ফেলে যে সে ওই বাড়িটাই কিনবে আর সেই মত অগ্রিম কিছু টাকা ও দিয়ে এসেছিল। কাল রাতে বর্ষার ওই কথাগুলো শুনেই সৌম্যর মনে হয়েছিল যে আর বেশি দেরি করলে সে একেবারেই হারিয়ে ফেলবে বর্ষা কে আর তাই কাল রাতেই সেই বাড়ির মালিক কে ফোনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে আর এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা ওই বাড়িটায় চলে যেতে চায়। ফ্ল্যাট টা সৌম্য কোনোদিন বিক্রি করবে না কারণ বর্ষা যে জায়গায় একবার থেকেছে সেখানে অন্য কেউ থাকবে তা সে কল্পনাও করতে পারে না। অটো থেকে নেমে বেশ খুশি মনে হাসতে হাসতে পায়ে হেটে ফ্ল্যাটের দিকে যেতে যেতে দেখতে পেল ফ্ল্যাটের নিচে বেশ লোকজনের ভিড়। ব্যাপারটা দূর থেকে ঠিক বুঝতে না পেরে সেই মানুষজনের ভিড় ঠেলে ফ্ল্যাটের সামনের দিকে গিয়ে দেখলো ফ্ল্যাটের সব লোকজনই বাইরে দাঁড়িয়ে। ফ্ল্যাটের সামনে পুলিশের গাড়ি এবং দমকল বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত। সৌম্য সেই ভিড়ের মধ্যে বর্ষা কে খুঁজে বের করতে না পেরে একজন পুলিশ কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“আচ্ছা কি হয়েছে? সবাই নীচে কেন?”
“আপনি কে?”
“আমি সৌম্যজিৎ মিত্র, এই ফ্ল্যাটের সেকেন্ড ফ্লোরে থাকি। কি হয়েছে একটু বলবেন?” উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো সৌম্য।
“হুমম ফ্ল্যাটে আগুন লেগেছে। খুব সম্ভবত কোনো বাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার অন ছিল তাই…” বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো সেই পুলিস অফিসারটি।
“আচ্ছা কোন ফ্লোরে এটা হয়েছে?” আবার জিজ্ঞেস করে সৌম্য।
“অনুমান করা যাচ্ছে যে সেকেন্ড ফ্লোরেরই একটি ফ্ল্যাটে হয়েছে তবে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। কয়েকজন সেকেন্ড ফ্লোরের একটি ফ্ল্যাটের দরজা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেছেন। আপনি ওনাদের কে জিজ্ঞেস করুন ওনারা ঠিক বলতে পারবেন।” নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্ল্যাটের বাকি বাসিন্দাদের দেখিয়ে বললো পুলিস অফিসার টি।

সৌম্য এদিক ওদিক তাকিয়ে বাবন এর মা কে দেখতে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলেন।
“আচ্ছা ফ্ল্যাটে কি হয়েছে?”
মালা সৌম্যর প্রশ্ন শুনেও এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো। সৌম্য আবার প্রশ্ন করলো এবার আর একটু উঁচু স্বরে বললো,
“দিদি কালকের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমার মাথা ঠিক ছিল না। কি হয়েছে একটু বলবেন আর বর্ষা কোথায়?”
এতক্ষন মালা সত্যিই এড়ানোর চেষ্টা করছিল সৌম্য কে তবে সৌম্যর প্রশ্নের শেষের লাইনটি শুনে খুব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌম্যর দিকে। ফ্ল্যাটের সবাই এই আগুন দেখে বেরিয়ে এসেছিল। তাছাড়া আগুনের ধোঁয়া তো সর্বপ্রথম বাবন দেখেছিল এবং তাও সৌম্যর ফ্ল্যাটের দরজা দিয়েই বের হচ্ছিলো। বাবন খেলতে যাওয়ার পথে অমন ধোঁয়া দেখে জানিয়েছিল তার মা কে। মালা তখনই দেরি না করে ছুটে গিয়ে দেখেছিল সৌম্যদের ফ্ল্যাটে তালা ঝুলছে বাইরে থেকে। সে ভেবেছিল বোধহয় ফ্ল্যাটে কেউ নেই তাই তখনই সবাই কে জড়ো করে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসেছিল এবং দমকল বাহিনী কে খবর দিয়েছিল।
“বর্ষা কোথায় তা তো তুমি জানবে? তোমাদের বাড়িতে কেউ নেই সেখানে তো তালা ঝুলছে ফোন করে দেখো কোথাও বেরিয়েছে হয়তো। ও এর একটা কথা সম্ভবত তোমাদের বাড়িতেই কিছু হয়েছে কারণ বাবন খেলতে যাওয়ার পথে তোমাদের বাড়ির থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেছিল আর সেই শুনেই আমি সবাই কে জানাই ও দমকল কে খবর দি।” কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললো মালা।
সৌম্যর চোখের সামনে ভেসে ওঠে আগের রাতের ঘটনা,
“সৌম্য তুমি পাগল হয়ে গেছো। যেই মানুষটাকে আমি ভালোবেসে ছিলাম তুমি সেই মানুষটা নেই আর। আমার পক্ষে তোমার সাথে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আমি কালই নিজের বাড়ি চলে যাবো। আমি আর তোমার সাথে থাকবো না।”
ঠিক এই কথাগুলো বলে যখন বর্ষা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল তখন সৌম্য সোফায় বসে বর্ষার বাইরে বেড়ানোর অপেক্ষা করছিলো। দেখতে দেখতে যে কখন রাত থেকে ভোর এবং ভোর পেরিয়ে সকাল হয়ে গিয়েছিল তা সৌম্য বোঝেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখলো বর্ষা ঘরের দরজা খোলেনি তখন বর্ষার অভিমান ভাঙানোর জন্য সৌম্য স্নান সেরে নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে বর্ষা কে অনেকবার ডেকেছিল তবুও বর্ষা দরজা খোলেনি। শুধু বলেছিল, “আমার খিদে নেই সৌম্য তুমি খেয়ে নাও। আমি ঠিক করে নিয়েছি যে আমি বাবার কাছে চলে যাবো। এভাবে বাঁচা সম্ভব না আমার পক্ষে। তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো তবে আমাকে আটকাবে না।”
বর্ষার এমন কথায় খুবই রেগে গিয়েছিল। ছোটবেলার সেই কালো স্মৃতি, নিজের বাবা মা কে জ্বলন্ত চিতায় দেখার মুহূর্তটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তার। সে সব হারিয়ে বর্ষা কে পেয়েছিল আর বর্ষা কে কখনোই হারিয়ে যেতে দেবেনা সে তাই আর এক মিনিটও দেরি না করে সৌম্য অফিসের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। বর্ষা যাতে তার বাবার কাছে না চলে যায় তাই সৌম্য নিজের হাতেই তালা মেরে দিয়েছিল বাইরে থেকে এবং চাবিটাও নিজের সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিল অফিসে। কিন্তু বেড়ানোর সময় কি গ্যাস বন্ধ করেছিল সে? সৌম্যর হঠাৎ মনে পড়ে যায় যে গ্যাসে চা বসিয়েই সে বর্ষা কে ডাকতে গিয়েছিল এবং বর্ষার মুখ থেকে এমন চলে যাওয়ার কথা শোনার পর আর সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি তাই তৎক্ষণাৎ সে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। সৌম্যর মনে পড়ে গেল দুদিন আগে বর্ষার বলা একটি কথা,
“সৌম্য তোমার এই আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়টাই দেখবে একদিন আমাকে হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জীবনে মানুষ কে বিশ্বাস করতে জানতে হয় নাহলে একদিন এমন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে যে আর ফিরে আসতে পারবে না।”
সৌম্যর চোখে মুখে এক আতঙ্ক দেখা গেল সে একটি বিকট চিৎকার করে বর্ষার নাম নিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল রাস্তার উপরে।
“এখন কেমন লাগছে আপনার শরীর?” হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা সৌম্য কে প্রশ্ন করলো সেই হাসপাতালের একজন ডাক্তার।
“বর্ষা আবার ওই বারান্দায় বসে আছো না? কতবার বারণ করেছি ওখানে না বসতে কিন্তু তুমি শোনো না আমার কথা। বর্ষা কেন শোনো না আমার কথা? বলো না…”
ডাক্তারবাবু তার ডান হাতটা সৌম্যর ডান কাঁধে রেখে একটু জোরে ঝাঁকিয়ে দিলো তাকে। সৌম্য এতক্ষন মাটির দিকেই তাকিয়ে ছিল তবে এবার ডাক্তার এর মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর রাগে চিৎকার করে উঠলো, “তুমি? তুমি আমার বর্ষা কে আলাদা করতে পারবে না বুঝলে তুমি কখনোই তা পারবে না। আমি আমার বর্ষা কে কারুর হতে দেবো না। ও আমার। শুধুমাত্র আমার বর্ষা।” এক অস্বাভাবিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো হাসপাতালের সেই ওয়ার্ডটি।

Exit mobile version