গল্প- ন্যুডিটি অফ ওয়ার

ন্যুডিটি অফ ওয়ার
– বিশ্বদীপ মুখার্জী

 

দুপুর দু’টো। নিজের চেম্বার থেকে নিচে নেমে এলো ডক্টর সায়ন্তন গাঙ্গুলী। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের গাড়ির দিকে এগোলো ঠিকই, কিন্তু গাড়িতে বসলো না সে। কারোর অপেক্ষা করছে। সায়ন্তন খানিক পরেই দেখতে পেল মেঘনাকে। দ্রুত গতিতে মেঘনা এগিয়ে আসছে তার দিকে।
সায়ন্তনের কাছে এসে মেঘনা বলল – ‘সরি সায়ন্তন। দেরি হয়ে গেল। কাজ হয়ে গেছে?’
সায়ন্তন নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটা খাম বের করে মেঘনার হাতে দিলো। খাম খুলে ভিতর থেকে একটা কাগজ বের করে ভালো করে পড়ার পর সেটাকে পুনরায় খামে ঢুকিয়ে হাসি মুখে সায়ন্তনকে বলল – ‘থ্যাংক ইউ সায়ন্তন। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
সায়ন্তনের মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চিন্তিত কন্ঠে সে বলল – ‘একবার ভালো করে, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে হতো না, মেঘনা?’
‘অনেক চিন্তা করেছি রে। সত্যি বলতে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। খারাপ লাগছে পার্থর জন্য। ছেলেটা আমায় ভালোবাসে খুব। দুর্ভাগ্য যে আমি কোনও দিনই ওর হতে পারলাম না। কাজটা যদি সফল হয় তাহলে এত বছর পর মাথাটা হালকা হবে। এত দিন মাথায় আর মনে যেন হিমালয় পর্বত নিয়ে ঘুরছিলাম। এবার আসি রে। দেরি হয়ে গেল তোর।’
‘কোথায় যাবি বল, ছেড়ে দিচ্ছি তোকে।’ বলল সায়ন্তন।
‘না সায়ন্তন। আমার সাথে থাকিস না বেশি। বিপদে পড়বি।’
কথা শেষ করে এগিয়ে গেল মেঘনা। সায়ন্তন দেখতে থাকলো তাকে।


………..

ট্যাক্সিটা যখন মেঘনার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন প্রায় রাত একটা। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। অন্য কোনও মেয়ে হলে এত রাতে একা ট্যাক্সিতে যেতে হয়তো ভয় পেতো। কিন্তু মেঘনার মধ্যে ভয় নামক কোনও অনুভূতি কাজ করে না। নিজের ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগলো তার। মদ্যপান করার অভ্যাস খুব একটা নেই মেঘনার। কিন্তু সেই রাতে মেঘনা করেছিল মদ্যপান। প্রায় এক ঘন্টা টানা মদ্যপান করে গেল সে। মাঝে নিজের মোবাইলটা একবার দেখেছিল সে। সন্ধ্যা থেকে পার্থ প্রায় পঞ্চাশ বার ফোন করেছিল তাকে। ফোন তোলেনি সে। ইচ্ছাকৃত নিজের মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রেখেছিল। পার্থকে সে বিশ্বাস করতে পারে? বিগত আট বছরের সম্পর্ক তাদের। দু’জনে একই খবরের কাগজে কাজ করে। এই আট বছরে তাদের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা এসেছে ঠিকই, কিন্তু চিরকালই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে মেঘনা। সে পার্থকে কোনও দিনই বিয়ে করতে পারবে না। পার্থকে সে বহুবার বলেছে – ‘তুমি অনেক ভালো মেয়ে পাবে পার্থ। বিয়ে করে নিজের সংসার গুছিয়ে নাও। আমার অপেক্ষা করো না। আমার অপেক্ষা করে লাভ নেই।’
‘একটা কথা বলো মেঘনা। তুমি কি কোনও দিন বিয়েই করবে না?’ জিজ্ঞাসা করেছিল পার্থ।
‘না।’
‘তোমার যদি জেদ থাকে তাহলে আমারও জেদ আছে। তোমার বিয়ে না করার জেদ, আর আমার তোমাকেই বিয়ে করার জেদ।’

নিয়ম মত দিন এগিয়ে গেছে। দিনে দিনে মেঘনা পার্থর জন্য এক রহস্যময় চরিত্র হয়ে ফুটে উঠেছে। দু’একবার মেঘনাকে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল পার্থ। উত্তরে মেঘনা বলেছিল – ‘সময় অসুক। সব জানতে পারবে।’
তার পর থেকে পার্থ আর এ বিষয়ে কোনও কথা বলেনি মেঘনাকে। শুধু সে দিনের অপেক্ষা করে যাচ্ছে সে, যে দিন মেঘনা সম্পূর্ণ ভাবে তার হবে।

মেঘনার ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে। বেশ অনেকক্ষণ ধরেই বেজে চলেছে কলিং বেলটা। মাথা ভারী হয়ে আছে তার। কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না সে। কোনও রকমে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখলো, সকাল ছ’টা।
‘কে এলো এত ভোরে?’ মনে মনে বেশ বিরক্তই হলো সে।
দরজা খুলে দেখে সামনে পার্থ দাঁড়িয়ে।
‘কী ব্যাপার তোমার বলো তো মেঘনা? কাল সন্ধ্যে থেকে তোমাকে ফোন করে যাচ্ছি, তুলছো না কেন? কি ভাবো, আমার চিন্তা হয় না?’
দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে পার্থকে ভিতরে ঢুকবার রাস্তা করে দিয়ে মেঘনা বলল – ‘কাজে ছিলাম একটা।’
পার্থ ভিতরে ঢুকলো।
‘এমন কী কাজ যে একবারও আমার ফোন রিসিভ করা যায় না? মেঘনা, তুমি কি কাল রাতে ড্রিংক করেছিলে? মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে।’
চুপ করে থাকলো মেঘনা। মেঘনাকে চুপ করে থাকতে দেখে পার্থ বলল – ‘ঠিক আছে। জবাব দিতে চাও না যখন, দিতে হবে না। এখন চলো আমার সাথে, বেরোতে হবে এক্ষুনি।’
‘কোথায়?’ মেঘনা জিজ্ঞাসা করলো।
‘জানি, তোমার কাছে কোনও খবর নেই। অরুণ দেবনাথের নাম শুনেছো?’
‘কে অরুণ দেবনাথ? ও হ্যাঁ, মনে পড়লো। সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফার তো?’
‘হ্যাঁ, সেই। কাল রাতে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।’
‘কী! আত্মহত্যা? হঠাৎ?’ চমকে উঠল মেঘনা।
‘জানা যায়নি এখনও। ভোর পাঁচটা নাগাদ ডায়মন্ড হারবার রোডে তার ফার্ম হাউস থেকে পুলিশ তার ডেড বডি উদ্ধার করেছে। পুলিশ এখনও সেখানেই আছে। আমরা আগে সেখানে যাবো, তার পর পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে বাকি খবরটা নেবো।’ পার্থ নিজের কথা শেষ করলো।
‘পার্থ, আমার শরীরটা যে ভালো নেই একেবারে। যেতে পারবো না আমি।’
মেঘনার কোথায় পার্থ খানিক ভ্রুকুটি করে তাকালো তার দিকে।
‘বুঝতে পারছি। হ্যাং ওভার। বেশ, তাহলে আমিই যাই।’ পার্থ বলল।
‘তাড়া আছে? একটু বসতে, চা করে দিতাম।’
‘না থাক। তুমি বরং রেস্ট নাও। সময় পেলে ফোন করবো। রিসিভ করো কিন্তু।’
পার্থর ফ্ল্যাট থেকে বেরোবার সময় মেঘনা তাকে জিজ্ঞাসা করলো – ‘আজ সন্ধ্যায় কি তুমি ফ্রী আছো?’
‘কেন বলো তো?’
‘এখানে এসো একবার। দরকার আছে।’

পার্থর চলে যাওয়ার পর সোফাতে খানিক চুপ করে বসে রইল মেঘনা। তার পর সেখান থেকে উঠে নিজের বেড রুমে গেল। বেড রুমের এক কোণায় এক কাঠের টেবিলের উপর রাখা আছে তার ভ্যানিটি ব্যাগ। সেই ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে ভালো করে দেখে সেটা বেশ কিছু টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো সে।
‘না, এটার আর প্রয়োজন হবে না।’ মনে মনে ভাবলো সে।
কী একটা কারণে মনটা বড় অস্থির করছে তার। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না সে। কখনও ঘরময় পায়চারি করছে, কখনও নিজের বিছানার নিচে রাখা এক ছবিকে বারবার দেখছে। বেলা এগারোটা নাগাদ মেঘনা ফোন করলো একটা।
‘থ্যাংক ইউ সায়ন্তন। তুই না থাকলে কাজটা হতোই না।’
পুরনো স্মৃতির ভিড় মেঘনার মস্তিষ্ককে চঞ্চল করে তুলছিল বারবার। একটা শব্দ তার ছোট বেলাকে বীভৎস করে তুলেছিল। পরবর্তী কালে সেই শব্দটা সে যেখানেই শুনেছে, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে তার। “ক্লিক” এক এমন শব্দ যাকে আমি ঘেন্না করি।’ মেঘনা বলেছিল একবার পার্থকে।
পার্থ আশ্চর্য হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিল। মেঘনার সেই একই উত্তর – ‘সময় এলে সব জানতে পারবে।’

দুপুরের দিকে পার্থ একবার ফোন করেছিল।
‘অরুণ দেবনাথের কাছে একটা প্রাইভেট রিভলভার ছিল। সেটা দিয়েই নিজেকে গুলি করেছেন তিনি। কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। বহু বছর তো বিদেশে ছিলেন। লন্ডনে একটা ফ্ল্যাট আছে তার। এই কিছু দিন হলো কোলকাতা এসেছিলেন। কারোর সাথে কোনও শত্রুতা আছে বলে তো জানা যায়নি। পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। দেখা যাক, কত দূর কী হয়।’
পার্থর কথাগুলো চুপচাপ শুনে গেল মেঘনা। শেষে বলল – ‘আজ সন্ধ্যায় আসছো তো?’
‘যাবো মেঘনা। যাবো নিশ্চই।’


……….

পার্থ বলেছিল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আসবে সে। তার আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে মেঘনা। সোফার সামনের সেন্টার টেবিলে সাজানো আছে একটা বেশ দামী বিলেতি মদের বোতল, দু’টো কাঁচের গ্লাস। সামনের দেয়ালে টাঙিয়ে দিলো একটা ছবি। প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ পার্থ এলো। যাবতীয় সরঞ্জাম দেখে তো সে অবাক।
‘কী ব্যাপার মেঘনা?’
পার্থর হাত ধরে মেঘনা তাকে সোফাতে বসালো। নিজে বসলো তার পাশে। হালকা নীল রঙের স্লিপ লেস নাইটিতে দেখতে অপূর্ব লাগছে মেঘনাকে। পার্থর আরও কাছে এসে মেঘনা বলল – ‘তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই পার্থ। হয়তো নিজের হুঁশে থাকলে সে কথাগুলো তোমায় বলতে পারবো না। তাই এই সরঞ্জাম করা।’
কথা শেষ করে পার্থকে একটা পেগ বানিয়ে দিলো মেঘনা। নিজেও নিলো একটা পেগ। পেগে এক চুমুক দিয়ে মেঘনা বলল – ‘আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটা যে কতটা অটুট সেটা আমি জানি পার্থ। তুমি চাইলেই এক ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে পারতে। কিন্তু তুমি সেটা করলে না। অপেক্ষা করে গেলে আমার, আজও অপেক্ষাই করে যাচ্ছ। কিন্তু আমি নিরুপায় পার্থ। আমি যে তোমায় ভালোবেসেও বিয়ে করতে পারবো না। কেন পারবো না তার পিছনে বেশ কিছু কারণ আছে। আজ অবধি সেই কারণগুলো তোমায় বলিনি। কিন্তু আজ বলবো।’
কথা শেষ করে বাকি পেগটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলল মেঘনা। পার্থর গ্লাসও ফাঁকা। পরের পেগ বানিয়ে মেঘনা বলল – ‘পার্থ, তোমাকে ভালোবেসেও চিরকাল তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছি। কিন্তু আজ সে দূরত্ব রাখবো না পার্থ। তোমার যেটা পাওয়ার, তুমি ঠিকই সেটা পাবে।’
কথার শেষে পার্থর দিকে আরও একটু এগিয়ে এলো মেঘনা। নিজের বাঁ হাত দিয়ে পার্থর গলা জড়িয়ে তার মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে গিয়ে মেঘনা বলল – ‘আজ আমি তোমার পার্থ, আজ আমি তোমার।’ মেঘনা নিজের ঠোঁট রেখে দিলো পার্থর ঠোঁটের উপর।

বিলিতি মদের বোতলটা অর্ধেক থেকে বেশি খালি হয়ে গেছে। মেঘনা আর পার্থ এখনও বসে আছে সোফাতে। মেঘনা নিজের সমস্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে পার্থর শরীরের উপর। হঠাৎ পার্থর নজর গেল সামনের দেয়ালের দিকে। দেয়ালে টাঙানো আছে একটা ছবি।
‘এই ছবিটা তোমার কাছেও আছে বুঝি?’ পার্থ জিজ্ঞাসা করলো মেঘনাকে।
‘হুম, আছে। ফেমাস ছবি- ন্যুডিটি অফ ওয়ার। ছবিটা সে সময় কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছিল। পরে অনেক কপি তৈরি করা হয় সেই ছবিটার। অনেকের বাড়িতেই এই ছবিটা দেখতে পাবে তুমি।’
মেঘনা সোফা থেকে উঠে ছবিটার দিকে এগোলো। ছবিটা হাতে নিয়ে পুনরায় ফিরে এলো সোফাতে।
‘ছবিটা আমি নিজের কাকার বাড়িতেও দেখেছি।’ ছবিটা মেঘনার হাত থেকে নিজের হাতে নিয়ে পার্থ বলল।
‘ছবিটা তুমি বহুবার দেখেছো হবে পার্থ। আরও একবার দেখো। ভালো করে দেখো। কিছু দেখতে পাচ্ছো ছবির মধ্যে, কিছু খুঁজে পাচ্ছো ছবির মধ্যে?’
পার্থ মেঘনার দিকে একবার তাকিয়ে ছবিটার দিকে ভালো করে তাকালো। কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে তাকিয়ে থাকার পর বলল – ‘নতুন কিছুই পাচ্ছি না মেঘনা।’
‘ছবিতে কী দেখছো বলতো?’ মেঘনা জিজ্ঞাসা করলো।
‘একটা যুদ্ধক্ষেত্র, আশেপাশে সৈনিক, সামনে দিয়ে চলে আসছে একটি মেয়ে….’
‘পুরোটা বলো, ভালো করে।’ পার্থর কথা মাঝপথে থামিয়ে বলল মেঘনা।
‘পুরোটা বলো মানে? ঠিকই তো বলছি।’ বলল পার্থ।
‘না পার্থ, পুরোটা বলো। যেমন, সামনে দিয়ে চলে আসছে একটি মেয়ে নয়, সামনে দিয়ে চলে আসছে একটি নগ্ন মেয়ে। যার বয়স বারো বছর। অসহায় একটি মেয়ে। কিছুক্ষণ আগেই যার বাপ মা মারা গেছে। কতগুলো নৃশংস সৈনিক ধেয়ে এসেছিল তার দিকে। ছিঁড়ে খেতে চেয়েছিল তার সমস্ত শরীরকে। মেয়েটি কোনও রকমে সেখান থেকে পালায়। গায়ে একটা সুতোও নেই তার। সে দৌড়াচ্ছে, পাগলের মত দৌড়াচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তার কোনও ঠিক নেই। হঠাৎ সে দেখলো সামনে থেকে কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। লোকটি মেয়ের কাছে এসে মুচকি হাসলো। মেয়েটির নগ্ন দেহতে কোনও কাপড় চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেনি সে। তার হাতে ছিল একটা ক্যামেরা। তাই দিয়ে সেই অসহায় নগ্ন মেয়েটির একটা ছবি তুলে নিলো সে। তার পর সে চলে গেল। পার্থ, ঘটনাটা ১৯৯১ সালের। গল্ফ ওয়ার চলছিল সে সময়। মেয়েটির পরিবার তখন থাকতো কুয়েতে। সে যুদ্ধে মেয়েটি খুইয়েছিল নিজের মা, বাবা আর ছোট্ট ভাইকে। কোনও রকমে মেয়েটি ইন্ডিয়া আসে। তখন অনেক ভারতীয়রাই ফিরে এসেছিল নিজের দেশে। সেই ভিড়ে মেয়েটিও ছিল। যে ভালো মানুষটা মেয়েটিকে ইন্ডিয়া নিয়ে আসে, মেয়েটি তার সাথেই থাকতে শুরু করে। লোকটা বিয়েথা করেনি। ভাগ্যবশত সেও ছিল বাঙালি। কোলকাতার কাছে একটা জায়গায় থাকতো সে। পরবর্তী কালে সেই মেয়েটিকে লোকটা অ্যাডাপ্ট করে। মেয়েটি একটু বড় হয়ে জানতে পারলো যে তার সেই নগ্ন ছবিটি নাকি কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছবিটি মেয়েটির চোখেও পড়লো। সাথে সে দেখলো ছবির সাথে যুক্ত নোংরামি। ছবিটি তখন বিখ্যাত। মোনালিসার মত প্রায় অধিকাংশ বাড়ির দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। মেয়েটির বাড়িতেও সেই ছবিটা ছিল। এক দিন মেয়েটি আড়াল থেকে দেখতে পেল তার তথাকথিত বাবা সেই ছবিটাকে নিজের কাছে নিয়ে মেয়েটির নগ্ন শরীরের দিকে অপলক তাকিয়ে হস্তমৈথুন করছে। তার সেই মেয়েটির শরীরের দিকে কোনও দিনও নজর ছিল, মেয়েটি জানতো না। হয়তো লোকটা জানতে দেয়নি। নিজের বাসনাকে হয়তো সে চেপে রেখেছিল। হয়তো ভয় ছিল যে, যাকে মেয়ে বলে এই সমাজের সামনে স্বীকার করেছে, তার প্রতি এমন ভাবনা মনে নিয়ে আনা মানে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনা। তাই ছবি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া ভালো।’
এতটা এক নাগাড়ে বলে থামলো মেঘনা। পার্থ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটা পেগ বানিয়ে সেটা নিমেষে গলাধঃকরণ করে মেঘনা পুনরায় বলতে শুরু করলো – ‘মেয়েটি নিরুপায় ছিল। সেই লোকটাকে ছেড়ে সে যেতই বা কোথায়? আগে সে লোকটাকে শ্রদ্ধা করতো, এবার ভয় পেতে শুরু করলো। অর্ধেকটা জীবন তার ভয়েই কেটে গেল। মেয়েটির রাগ হলো সেই ফটোগ্রাফারের উপর। সে নগ্ন মেয়েটিকে একটা কাপড় দিতে পারলো না, তার নগ্ন ছবিকে বাজারে বিক্রি করতে পারলো। ‘ন্যুডিটি অফ ওয়ার’, বিখ্যাত ছবি। অরুণ দেবনাথের সব থেকে বিখ্যাত ছবি হয়তো।’
‘কিন্তু তুমি এত কিছু জানলে কী করে?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলো পার্থ।
পার্থর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মেঘনা বলল – ‘আমি সব জানি পার্থ, সব জানি। কারণ, সেই মেয়েটি আমি।’
পার্থর চোখ বড়বড় হয়ে গেল। বিস্ময়ে কন্ঠরোধ হয়ে গেল তার।
‘আমাকে প্রায় পুরো দুনিয়া নগ্ন দেখেছে পার্থ। অনেকেই হয়তো আমার ছবি দেখে নিজের মনের সুপ্ত বাসনা মিটিয়েছে। যার জন্য এটা হলো, সে দিনে দিনে আরও বিখ্যাত হতে লাগলো। বিশ্ব জুড়ে নামডাক অরুণ দেবনাথের। কী করে সহ্য করি আমি সেটা?’
‘তুমি কি বলতে চাও অরুণ দেবনাথ যে আত্মহত্যা করলো….’
‘হ্যাঁ পার্থ। অরুণ দেবনাথের আত্মহত্যার মুখ্য কারণ আমি। ইন্ডিয়াতে এসে আমি যেখানে থাকতাম সেখানে প্রায় আমার বয়সী এক ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমার বয়সী বলা ভুল হবে, আমার থেকে কিছু বছরের ছোট সে। ছোট ভাইয়ের মত ছিল সে। সারা দিন ঘরের খাটাখাটুনির পর বিকেলের দিকে একটু সময় পেতাম তার সাথে দু’টো কথা বলার। সে জানতো আমার ইতিহাস। সে এটাও জানে, ন্যুডিটি অফ ওয়ারের সেই মেয়েটি কে? যে দিন সে ডক্টর হলো সে দিন আমার মাথায় একটা প্ল্যান এলো। তখন তাকে আমি প্ল্যানটা বলিনি। প্ল্যানটা তাকে বললাম অরুণ দেবনাথের ইন্ডিয়া ফিরে আসার পর। ওর থেকে শুধু মিথ্যে একটা ব্লাড রিপোর্ট দরকার ছিল। সে রাজি হয়নি। অনেক কষ্টে তাকে রাজি করালাম। তোমাকে তার বিষয়ে কিছুই জানতে দিইনি। লম্বা বিদেশ যাত্রার পর যখন অরুণ দেবনাথ ফিরে আসে, তখন সময় হলো নিজের কাজ হাসিল করার। এক রাতে, একটা বারে গিয়ে পরিচয় করলাম অরুণ দেবনাথের সাথে। সেই বুড়োর ফার্ম হাউস পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না আমায়। বুড়োর রস কম না। রাত ন’টা থেকে প্রায় রাত বারোটা পর্যন্ত পাগলের মত ভোগ করলো আমায়। আমি দিলামও নিজেকে ভোগ করতে। শেষে যখন বুড়ো হাঁপিয়ে গেল, তখন দিলাম আমি নিজের আসল পরিচয়। যেন আকাশ থেকে পড়লো সে। আর তার পর যেটা হলো….’
‘কী হলো তার পর?’ উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলো পার্থ।
‘একটা রিপোর্টের জেরক্স কপি বুড়োটার মুখে ছুঁড়ে মেরে বললাম, “শোন, তুই যার শরীরকে নিয়ে এতক্ষণ ধরে ভোগ করলি, সে এক এইচ.আই.ভি. পেশেন্ট। মানে আমার এডস আছে। তার মানে সংক্রমণে এবার তুইও এসে গেলি। এবার পুরো দুনিয়াকে কৈফিয়ত দে, বিশ্ব বিখ্যাত ফটোগ্রাফার অরুণ দেবনাথ এইচ.আই.ভি. পেশেন্ট। ভেবে দেখ, তোর মান-সম্মান কোথায় মিশে যাবে। এখনও মনে পড়ে সে দিনের কথা, যে দিন তুই আমার নগ্নতাকে ইনক্যাশ করেছিলিস। আমি তো আজ না হয় কাল মরেই যাবো। কিন্তু নিজের মৃত্যুটা একবার চিন্তা করে দেখ। লোকেরা থুতু ফেলবে তোর লাশের উপর। প্রতি মুহূর্তে আমি মরেছি অরুণ বাবু। লোকেদের বাড়িতে দেখেছি আমার নগ্ন ছবি শোভা পাচ্ছে। বিখ্যাত ছবি, ‘ন্যুডিটি অফ ওয়ার’। হয়তো আজকের দিনের জন্যই আমি বেঁচে ছিলাম। আমার কথায় যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে ব্লাড রিপোর্টটা দেখে নে। তুই মর, আমি চলি।” আমি বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে খুব ড্রিংক করলাম। এত বছরের পর মনটা হালকা লাগছিল। পর দিন, মানে আজ তুমি এখানে এসে খবর দিলে যে অরুণ দেবনাথ আত্মহত্যা করেছে। এবার বুঝলে পার্থ, কেন আমার ‘ক্লিক’ শব্দটার উপর এত ঘৃণা। ওই একটা শব্দ আমার নগ্ন শরীরকে প্রকাশ্যে এনেছে। ওই একটা শব্দর জন্য আমি নগ্ন হয়ে লোকেদের বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। ওই একটা শব্দের জন্য আমার সৎ বাপ আমার ছবি দেখে হস্তমৈথুন করেছে।’
মেঘনা উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল। তাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলো পার্থ। চেষ্টা করলো মেঘনাকে শান্ত করার।
ঘরে খানিক নিস্তব্ধতা ছেয়ে রইল। মিনিট পাঁচেক পর পার্থ বলল – ‘যদি তোমার বলা কথাগুলো সত্যি হয়, তাহলে আমি তোমায় এক সাজেশন দেবো। তুমি আজ রাতেই এই শহর ছেড়ে চলে যাও। তদন্ত ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। পুলিশ যে কোনও সময় তোমার কাছে আসতে পারে।’
মুচকি হাসলো মেঘনা। বলল – ‘পুলিশ আমাকে পাবে না পার্থ। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো মেঘনা। রাত প্রায় বারোটা বাজে।
‘তুমি চলে যাও পার্থ। রাতে তোমার এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আশেপাশে কেউ জেনে গেলে মুশকিল হবে। আজ আমি টেনশন ফ্রী। যার যা প্রাপ্য, তাকে আমি সেটা দিতে পেরেছি। এটাই আমার জন্য অনেক।’
প্রায় জোর করেই পার্থকে নিজের ফ্ল্যাট থেকে বের করলো মেঘনা। পার্থ জানতো যে মেঘনার মানসিক অবস্থা ভালো না। যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না তার। কিন্তু অবশেষে তাকে মেঘনার জেদের সামনে হার মানতেই হলো।
পার্থর চলে যাওয়ার পর সেই ছবিটার দিকে খানিক অপলক তাকিয়ে রইল মেঘনা। তার দু’ চোখ জলে ভেজা। কিছুক্ষণ পর ছবিটাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল সে। একবার, দু’বার, তিনবার। চারিদিকে ছিটিয়ে পড়লো অজস্র কাঁচের টুকরো।
কাঁচের একটা টুকরোকে হাতে উঠিয়ে স্থির দৃষ্টিতে খানিক সে দিকে তাকিয়ে রইল মেঘনা। মুচকি হেসে মনে মনে বলল – ‘ন্যুডিটি অফ ওয়ার।’


………

পরদিন সকাল থেকে পার্থ অনবরত মেঘনার মোবাইলে ফোন লাগাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই ফোন লাগছে না। হঠাৎ পার্থর কাছে তার অফিসেরই একজনের ফোন এলো।
‘খবর পাস নি পার্থ?’
‘কী খবর?’
‘অদ্ভুত রিপোর্টার তুই। খবর রাখিস না, তাও আবার মেঘনার?’
‘কী হয়েছে মেঘনার?’ মনটা চঞ্চল হয়ে গেল পার্থর।
‘যা, ওর ফ্ল্যাটে যা। মেঘনা কাল রাতে সুইসাইড করেছে। একটা ভিডিও করে গেছে সে। সেই নাকি অরুণ দেবনাথের আত্মহত্যার মুখ্য কারণ। কারণটাও নাকি সে ভিডিও’তে বলে গেছে। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা রে, সত্যি। তুই জানতিস না?’

শূন্যের দিকে তাকিয়ে রইল পার্থ। কথাগুলো যেন বহু দূর থেকে তার কানে ভেসে আসছে।

সমাপ্ত।

Loading

One thought on “গল্প- ন্যুডিটি অফ ওয়ার

Leave A Comment