গল্প- যাহা বলিব সত্য বলিব

যাহা বলিব সত্য বলিব
– উজ্জ্বল দাস

 

ভাবতে ভাবতে গোটা একটা লম্বা বছর কেটে গেলো সায়নীর। অরিন্দমের সাথে ব্রেকআপটা হয়ে গেছে মনে মনে। কতোদিন মাঝ রাতে প্রবল অনিদ্রায় ঘুম ভেঙে অরি-অরি বলে চিৎকার করে উঠেছে সায়নী। না, অরিন্দম ফিরে আসেনি আর। ছোট্টো দুধের শিশুটাকে সায়নীর কোলে রেখে অরিন্দমের আর ফেরা হয়নি সেদিন। আজ মেয়ের বয়স মাত্র ষোলো মাস।

সায়নী বাবা মায়ের কাছে চলে এসেছে মেয়েকে নিয়ে। ছোট্ট মেয়ে সৃজা। বুঝতেও পারবে না বাবাকে দেখতে কেমন হয়, তারা সন্তানের জন্য কতখানি। বিকেল বেলা বাড়ির সামনেটায় বসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে দু’ গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল সৃজার মায়ের।

বাবা মা দু’জনেরই যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তারা অর্থনৈতিক ভাবে খুব দুর্বল না হলেও বেশ স্বচ্ছল তাও নয়। দাদু দিদা মিলে নাতনির দায়িত্ব নিতে হিমশিম খাচ্ছেন দু’বেলা। শুভময় বাবু পেশায় অবসরপ্রাপ্ত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সুতরাং তার পেনশনের টাকায় এতোগুলো পেট। রোজই এটা নেই সেটা নেই-এর ঘরে মেয়ে আর নাতনি ও বড়ো বালাই। এককালীন অবসরের টাকায় বাড়িটা কোনো রকমে হয়েছে। বয়সের সাথে সাথে বাড়িতে ওষুধের ব্যবহার ও যথেষ্টই বেড়েছে।

মা সন্ধ্যা বেলা সন্ধ্যাহ্নিক সেরে সদরে ধূপ দেখতে আসছিলেন। মেয়েটা আপন মনেই মাটিতে হাত ঠুকে ঠুকে খেলছিলো সায়নীর পাশে। চুল বাঁধা হলে সায়নী মেয়ের নরম নরম গালটা একটু কষে টিপে দিয়ে আদর করে উঠে গেলো রান্না ঘরের দিকে। আর যেতে গিয়েই

ক্যাঁচ…. চ….চ..চ…চ…ঘ ট ঘট ঘ ট ঘ ট ঘ ট ঘট…

করে কানের কাছে আওয়াজটা হতেই মাথা ঘুরে পরে গেলো মেঝেতে। ব্যাস অজ্ঞান। প্রায়ই যা হয় আরকি।

পাড়ারই ডাক্তার গোপাল সরেন মশাই এসে বলেছিলেন।

– এটা মানসিক ট্রমা। কখনোই ঠিক হবে না। আগেও বলেছিলাম।

-উপায়! (অবাক বিস্ময়ে বাবা জানতে চেয়ে ছিলেন)

-দেখুন উপায় কিছু নেই তবে…

-তবে!!

-দক্ষিণে একবার নিয়ে গিয়ে দেখতে পারেন। ওরা অনেক কিছু পারে বলে শুনেছি।

-ডাক্তার বাবু, এতো পয়সা কোথায় পাবো, তার চেয়ে থাক। বাড়িতেই যা করার আপনিই করুন।

– সবই তার ইচ্ছে।

কথা কটা বলে শুভময় বাবু ভেতর ঘরে চলে এসে ছিলেন চোখের জল ফেলার তাগিদেই। মেয়েটার দিকে আর তাকানো যায় না ইদানিং। অনেক কষ্টে খুঁজে খুঁজে আই.টি’তে চাকরি করা ভালো ছেলে, অরিন্দমের সাথে বিয়ে দিয়ে ছিলেন মেয়ের। কপালে যে এত কষ্ট জুটবে তা কি আর জানতেন।

(দুই)

চরম রাগ রাগ মুখ নিয়ে গজ গজ করতে করতে সেদিন মেয়েকে কোলে করে অরিন্দমের হাত ধরেই ফিরছিলো সায়নী। অনেক কিছু কেনা কাটা হয়েছে আজ, কিন্তু সবই মেয়ের জন্য। সায়নীর দোকান থেকে বেরোনোর আগে একটা কুর্তি পছন্দ হয়েছিলো। অরিন্দম নাকি বলেছে আবার পরে কিনে দেবে। অন্ধকারও হয়ে আসছিলো বেশ। মেয়েকে নিয়ে অন্ধকার দিয়ে ফেরাও সমস্যার। এই সব নিয়ে গজরাতে গজরাতে বাড়ির আগে তিন মাথার মোড়ের সামনেটা আসতেই ….

ক্যাঁচ…. চ….চ..চ…চ…ঘ ট ঘট ঘ ট ঘ ট ঘ ট ঘট…

পাশে গা ঘেঁষেই একটা ধূসর গ্রাফাইট রঙের আর্টিগা এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। চোখের পলকে সবেগে অরিন্দমকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে নিমেষে চোখের আড়াল হয়ে গেছিলো। সায়নী জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিলো অরিন্দমকে কিন্তু মেয়েকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে চম্পট দিয়েছিলো কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা দুষ্কৃতির দল। সায়নী মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলো বেশ খানিকক্ষণ। তারপর জ্ঞান ফিরতে দেখেছিল সামনে বয়স্ক শ্বশুর শ্বাশুড়ি দাঁড়িয়ে। দু’জনেরই অসুস্থ শরীর। ডাক্তার কাকু মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত। আর জনা কয়েক প্রতিবেশী যারা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসে মা আর মেয়েকে। সায়নীর মাথায় কালো হয়ে কালশিটে পরে গেছে। মেয়েটার কিছু হয়নি ভাগ্যিস।

দিনের পর দিন এ থানা ও থানায় ঘুরে ঘুরেও কোনো সুরাহা তো দূর, আস্তে আস্তে ব্যাপারটাই ধামা চাপা পরে গেছে। কোলের একরত্তিটাকে নিয়ে যতটা সম্ভব লড়াই করে চলেছে সায়নী। তাবড় তাবড় বড়ো মাপের সব অফিসারেরাও নাকি একবছর ধরে তদন্ত করেই চলেছেন।

(তিন)

অরিন্দম এখন কোথায় কেউ জানে না কোনো হদিসও নেই। এমনকি অরিন্দম নিজেও জানে না যে সে কোথায় আছে। দু’বেলা শুধু কে একজন এসে ডাল আর রুটি দিয়ে যাচ্ছে গত একবছর ধরে ব্যস। তার মুখও দেখার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি। শুধু কিডন্যাপ হয়ে গাড়িতে করে যাওয়ার সময় আছন্ন অবস্থায় যে কথাগুলো ওর কানে আসছিলো সেগুলো আজও ভয়ঙ্কর। আজও ভীষণ টাটকা স্মৃতি ….

-পৌলমি কেমন দিলাম, শালা অনেক দিন পরে মালটাকে পেয়েছি নাগালে। পুরো মুঠোয় যাকে বলে। বহুত বার বেড়েছিলো। কি ফিজিক দেখেছিস। নিত্য নতুন রেপ মারাচ্ছিলো বল। কি করি দেখ এবার!

-হ্যাঁ রে বৈশাখী ঠিক বলেছিস। শালা। বুঝতে পারেনি আসলে কাদের সাথে পাঙ্গা নিতে গেছে। চার জনে মিলে টেনে আমরা ওঠাতে পারছিলাম না গাড়িতে, এতো লম্বা। কি বল অদৃজা।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস। চল শালা, এখুনি জিন্সটা খুলে এখানেই হয়ে যাক একবার কি বল। ঠুসে দি শালাকে।

-এক্ষুনি! দাঁড়া একটু। সামনের পেট্রোল পাম্প থেকে তেলটা নিয়ে নিই। আমারও আর তর সইছে না। সামনেই একটা নতুন খালি বাড়ি পড়ে আছে না। কেউ থাকে না ওখানে।

– খাচ্ছিলো তাঁতী আইটিতে, রেপ করতে গিয়ে নিজের লাইফটাই নষ্ট করলো। আরো যে চারটে মালকে আটকে রেখেছি আমরা, কেউ টের পাইনি তো বল।

-আরে ধুর, কোথায় রেখেছি। মশা মাছিও জানে না মাইরি। কি প্ল্যান করেছিলাম বল, সৃজনী তোর মনে পরে- যেদিন তোকে এই পাঁচজন মিলে খেয়েছিলো।

-পরবে না আবার। সেদিন বাবার ওষুধটা আমার ব্যাগেই পড়েছিল, আর বাবা নার্সিংহোমে কাতরাতে কাতরাতে ওষুধটা না পেয়ে সোজা ওপরে। ছেড়ে দেবো ভেবেছিস। ওষুধটা পেয়ে গেলে বাবাও বেঁচে যেত আর মা’ও অসময়ে বাবার কথা ভেবে ভেবে বিছানা নিতো না। আর আমার বর! সেও তো হারামি। আমায় বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। আমি কি স্বেচ্ছায় রেপ্ট হতে গেছিলাম! ছিঃ, থু…. থু শালা।

-বুঝলি বৈশাখী তেলটা নিয়ে সামনের বাড়িতে লাগিয়ে দিস গাড়িটা। সিগারেটও শেষ। দু’টো বোতলও তুলতে হবে রাস্তায়। তার পর সারা রাত ধরে মালটার রোস্ট করবো আর খাবো।

-ঠিক বলেছিস অদৃজা। এখনো ঘোর কাটেনি মনে হয়। তল পেটে একটা লাথি কষিয়ে রাখ। আমার ছেলেটার সেদিন জন্মদিন ছিলো। তাড়াতাড়ি করে অফিস থেকে ফেরার সময় আমায় তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করেছিলো বোকা** গুলো। চিৎকার করতে গিয়ে তলপেটের লাথিটা বাঁ* আজও মনে পরে। আর ঠিক তখন পৌলামিও আমার সঙ্গে ছিলো। ওকেও ছাড়েনি কুত্তার বাচ্চারা। আমার আর ছেলের জন্মদিনটাই হয়নি। একমাস হাসপাতালে কেটেছিলো আমার।

-হ্যাঁ ভুলবো কি করে বলতো। আমার ওড়নাটা টেনে গলায় চেপে পেঁচিয়ে রেখেছিল। চিৎকার ও করতে পারিনি। কিছু বোঝার আগেই আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে দরজাগুলো টেনে আটকে দিয়েছিলো। সারা রাত ধরে অত্যাচার করেছিলো। সব জানাজানি হওয়াতে আমার বিয়েটাই হয়নি আর। সবচেয়ে প্যাথেটিক তো অদৃজার। কিরে বল, তাই না।

-কুত্তার জাত! শালা কাপুরুষের বংশধর! আমার পেটের বাচ্চাটা যে এভাবে নষ্ট করে দিতে পারে কেউ আমি তো ভাবতেই পারিনা আজও। এরা মানুষ!! আমি প্রায় ছ-ছটা মাস বিছানা থেকে উঠতেই পারিনি। বাঁচবো কিনা জানতাম না। আমার মুখ বন্ধ করতে গিয়ে আমার পেটেই ওরা সপাটে লোহার রড কষিয়ে দিয়েছিলো। সব চেয়ে বড় কথা আমি ওর বৌ সায়নীর বান্ধবী। সেটাও ও জানতো আর আমায় যে টার্গেট করেই রেখেছিলো এটা পরিষ্কার। আমার অর্গান ফেলিওরের দিকে যাচ্ছিলো। কি ভাবে বেঁচে গেলাম জানি না।তবে ওরা আমাদের চার জনকে রোজ ফলো করতো। নাহলে আমরা চারজন যে একই জায়গায় চাকরি করি, কার কখন ডিউটি, কখন ছুটি সব ওদের মুখস্থ ছিলো একেবারে। দেখ বৈশাখী, সৃজনী, পৌলমী – আমরা এই পাঁচটাকেই শেষ করে দেবো। আইন এদের শাস্তি দেবে না। দিলেও ওদের সঙ্গে প্রমাণ করতে দৌড়োতে হবে। উকিলের পেটও ভরাতে হবে। এমনিতেই কয়েক লাখের ওপর কেস জমে আছে। তোরা কি বলিস?

-আমিও তোর সঙ্গে একমত। রোজ রোজ আমরা কোর্ট- আদালত-থানা-পুলিশ করতে পারবো না। আমরা আমাদের কোর্টেই ওদের বিচার চালাব।

তারপর পুলিশরাও জানতে চাইবে “ঠিক কোথায় কোথায় হাত দিয়েছিল! কি কি করে ছিলো! কি পরে ছিলেন! কেনই বা পরে ছিলাম! প্রথমে কি করলো! তারপর কোনটা খুললো!”

আমরাই বিচার করবো এই সব অমানবিক, কাপুরুষ কুত্তাগুলোর। তারপর যদি আমাদের ধরা পড়তে হয় তাই সই। কিন্তু ওদের সারা শরীরে আমরা কেটে কেটে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিতে দিতে নুন ছড়াবো। মাঝে মাঝে আকন্ঠ গিলে যার নেশায় ওরা মাতাল হয়েছিল, যার নেশায় বুঁদ হয়ে ওরা আমাদের জীবনগুলো শেষ করেছে সেই মদের বোতলও উপুড় করে দেবো ওদের মুখে। কাঠগড়ায় গিয়ে সবাই মিলে ধর্মগ্রন্থের ওপর হাত রেখেই নাহয় স্বীকার করবো..

“যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না”

এই ভাবে কথা বলতে বলতে বৈশাখী গাড়িটা দাঁড় করালো নতুন তৈরি হওয়া খালি বাড়িটার সামনে….

ক্যাঁচ…. চ….চ..চ…চ…ঘ ট ঘট ঘ ট ঘ ট ঘ ট ঘট…
~সমাপ্ত~

Loading

6 thoughts on “গল্প- যাহা বলিব সত্য বলিব

Leave A Comment