অণু গল্প- শীতলপাটি

শীতলপাটি
– সুজিত চ্যাটার্জি

 


ঠাকুমা, ঠাকুমাই রয়ে গেল। কিছুতেই আপডেট করা গেল না।সেই রামপ্রসাদী, সেই কে.এল.সায়গল. সেই.. বোঝালেও বুঝবে না, ওসব এখন আর চলেনা। তাঁবাদি হয়ে গেছে।যেখানেই যাই ঠাকুমাকে বলে যাই। অভ্যেস। ঠাকুমা..পুরুলিয়া যাচ্ছি। দু’দিন পরে ফিরবো।ঠাকুমা ফোকলা। হেসে বললো-
যা, ঘুরে আয়, ভালো জায়গা।
যাচ্ছি অফিসের কাজে, ‘যা ঘুরে আয়’। কাজ আর ঘুরে বেড়ানো এক নয়, কে বোঝাবে!
-শোন ঘেঁটু, আসবার সময় একটা শেতলপাটি আনিস। খুব ভালো, সস্তা।
-কি হবে শীতলপাটি, কি কাজে লাগবে তোমার?
– গরমকালে পেতে শোবো, খুব আরাম।
-বোঝো ঠ্যালা। বলি, শীতলপাটি পাতবে কোথায়? শোওয়া তো খাটে, ডানলোপিলো গদিতে, এ. সি. চালিয়ে।
-ও, তবে থাক। অনেক দিনের ইচ্ছে কিনা তাই,
এইটা ইচ্ছে। আসলে আদ্দিকালের সখ। সেটা কিছুতেই ছাড়া যাবে না।বর্ধমানের নাম শুনলেই মনে পড়ে যাবে মিহিদানা সীতাভোগ। কৃষ্ণনগর হলে সরপুরিয়া। দেওঘর হলে প্যাঁড়া। অভ্যেস অভ্যেস। আদ্দিকালের ছাপোষা অভ্যেস।নাহ্, ঠাকুমাকে আধুনিকা করা অসম্ভব।

পুরুলিয়া যাচ্ছি। রাতের ট্রেন। রিজার্ভড শোয়ার জায়গা। কি মাথায় ভূত চাপলো, ষ্টেশন থেকে একজন ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একটা হাওয়া বালিশ কিনে ফেললাম। মাথায় দিয়ে শোয়া যাবে। মনে মনে ইচ্ছেটা অনেক দিনের। চেপে রেখেছিলাম। ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে তাগড়াই বালিশ বানিয়ে , আরামে শুয়ে পরলাম। ট্রেন চলেছে আপন গতিতে, আপন লক্ষ্যে।হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে উঠল। মায়ের ফোন। এত রাতে মায়ের ফোন কেন। মন কুগাইতে শুরু করেছে। নিশ্চয় খারাপ কিছু , নইলে…

সত্যিই তাই। একটু আগে ঠাকুমা মারা গেছে। ঘন্টা কয়েক আগের জলজ্যান্ত মানুষটা নেই। ভাবা যায়? হায়রে জীবন.. কি আর করা। বয়স তো কম হয়নি। প্রায় নব্বই। তবুও মন মানেনা। বড্ড আদরের, ভালবাসার, মায়ার ভরা আদ্দিকালের শেষ মানুষ আমার। চোখে তো জল আসবেই।

নতুন কেনা হাওয়া বালিশটা হাওয়া বেড়িয়ে গিয়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছে। ফুটো ছিল নিশ্চয়ই। অনেক দিনের শখের জিনিস। হাওয়া হারিয়ে নেতিয়ে পড়ে আছে।বিশ্বাসঘাতক।

পুরুলিয়া ক্যানসেল। ফিরে এলাম। ঠাকুমার শেষ যাত্রার সাথী হবো। শিয়ালদা থেকে একটা শীতলপাটি এনেছি। ঠাকুমার শেষ ইচ্ছে। শিয়ালদা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেব। ঠাকুমাকে আদ্দি প্রথায় দাহ করা হবে। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে নয়, কাঠে।

ঠাকুমার আদ্দিকালের দেহ পুড়ছে। পুড়ছে আদ্দিকালের প্রথায়। পুড়ছে আদ্দিকালের বিশ্বাসী শীতলপাটি। দাউদাউ করে। অহংকারী আপডেট মন, হুহু করে, যেন কানেকানে ফিসফিস করছে.. আদ্দিকালের জিনিস, বেইমানি করেনা, হাওয়া বালিশের মতন।

Loading

Leave A Comment