Site icon আলাপী মন

গল্প- অজানা মন

অজানা মন
-সঞ্চিতা রায়(ঝুমা )

 

একটু পরেই সুতপা আসবে। সুতপা আসবে,অথচ নির্ঝরের মনে কোনো আনন্দের ঝিলিক নেই। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। সুতপার সঙ্গে আজ আবার অনেক দিন পর গঙ্গার ধারে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ফুচকা খাওয়ার কথা, যা নাকি একদিন তাদের দু’জনেরই খুব খুব প্রিয় ছিল। শ্রীতমা এ বাড়ি থেকে চলে গেছে একমাস হয়ে গেল। ল্যাপট্যাপে কাজ করতে করতে নির্ঝরের চোখ বারবার সামনে সাজিয়ে রাখা টেডিবিয়ারগুলোর দিকে চলে যাচ্ছে। কত রকম সাইজের, কতরকম রঙের টেডি। শ্রীতমা এগুলো নিয়ে শিশুর মত খেলা করতো। হয়তো এভাবেই সে মনকে আনন্দে রাখতো। নির্ঝরের দিক থেকে কোনো মনোযোগ তো সে কোনোদিন পায়নি। বিয়ের পর থেকে তার সম্পর্কে বড় উদাসীন ছিল নির্ঝর। সেই উদাসীনতার কারণ খুঁজতে খুঁজতে একদিন শ্রীতমা জানতে পারে, সুতপার কথা। এক সময় নির্ঝর নিজেই জানায়, শ্রীতমাকে সে কোনোদিনও ভালবাসতে পারবে না, কারণ তার মন জুড়ে শুধুই সুতপা। কলেজ ফেস্টে তাদের পরিচয়। কাজলনয়না সুতপা যেমন আবৃত্তি করতে পারে, তেমনই সুন্দর গান গায়। মুগ্ধ নির্ঝর। নির্ঝরের সমাজসেবা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা মন ছুঁয়ে যায় সুতপার। পরিণতি ভালবাসা । কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতো না। বিশ্ববিদ্যালয় স্তর উত্তীর্ণ হয়ে দু’জনেই চাকরি পেয়ে যায়। সুন্দর একটা ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে দুজনে। কিন্তু জাত বর্ণ সংক্রান্ত বাধা দুই বাড়ির আপত্তিতে বিয়ে পর্যন্ত পরিণতি পায় না এই প্রেম। দু’জনেই ঠিক করেছিল,আর তারা বিয়ে করবে না। কিন্তু নির্ঝরের মা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয় নির্ঝরের অন্যত্র বিয়ের দাবীতে। পরিস্থিতির চাপে নির্ঝর বাধ্য হয় শ্রীতমাকে বিয়ে করতে। সব কিছু জানার পর শ্রীতমা কষ্ট পেলেও সিদ্ধান্ত নেয় নির্ঝরকে মুক্তি দেবে। তাতে অন্তত নির্ঝর সুতপার সঙ্গে অনেক বেশী সময় কাটাতে পারবে। ডিভোর্স পেপারে সই করে সে চলে যায়। সুতপাকে সব জানায় নির্ঝর । সে আজ মুক্ত। কি জানি, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তাদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূর্ণ হবে। রান্নাঘরে বাসনগুলো পরিপাটি করে সাজান । খুব গোছানো ছিল শ্রীতমা। ফুলদানিতে রজনীগন্ধাগুলো শুকিয়ে গেছে। নির্ঝর রজনীগন্ধা ভালবাসে বলে রোজ স্কুল থেকে ফেরার পথে রজনীগন্ধা নিয়ে আসতো শ্রীতমা। স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা শ্রীতমা। ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় লাল টিপ লাগানো। মনে হচ্ছে এই বোধহয় বাড়িতে ফিরে টিপটা খুলে রেখেছে শ্রীতমা। সারা বাড়িতে শ্রীতমার অদৃশ্য উপস্থিতি । বাড়ির সামনে দিয়ে ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ফুচকাওয়ালা যাচ্ছে। শ্রীতমা ফুচকা খেতে খুব ভালবাসে। ফুচকার ঘন্টা শুনে শিশুর মত দৌড়ে ফুচকা খেতে যেত। নির্ঝরকে বারবার বলতো তার সাথে খেতে। নির্ঝর রাজী হ‘ত না। কিন্তু নির্ঝর ঠিক যতটা ঝাল খেতে পছন্দ করে সেভাবে আলু মাখিয়ে নিয়ে, বাটিতে টকজল নিয়ে, প্যাকেটে ফুচকা নিয়ে ছুটে এসে নির্ঝরকে দিত। মোবাইলে রিং হচ্ছে, সুতপা জানাচ্ছে মিনিট দশের মধ্যেই সে পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু কেন কেন নির্ঝরের আজ গঙ্গাপারে সেই প্রিয় জায়গায় যেতে একটুও ইচ্ছা করছে না। বারবার মনে হচ্ছে শ্রীতমা বড় অদ্ভূতভাবে মনে হচ্ছে ‘তার শ্রীতমা’ কথাটা। মনে হচ্ছে তার শ্রীতমা তাকে একবার বলুক “ওই যে ফুচকাওয়ালা যাচ্ছে, চল ফুচকা খাই”। অথবা ছুট্টে আসছে তার জন্য ফুচকা নিয়ে। দরজায় বেল বাজছে। সুতপা এসে গেছে। একটুও খুশী কেন হতে পারছেনা নির্ঝর। তবে কি আশা করেছিল, শ্রীতমা ফিরে এসেছে। হয়তো বা। কবে কিভাবে সে শ্রীতমাকে ভালবেসে ফেলেছিল, বোধহয় নিজেও বুঝতে পারেনি সে কথা। বারবার শুধু মনে হচ্ছে ওই বোধহয় শ্রীতমা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুল নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়াবে। কিভাবে বেড়াবে সে সুতপার সাথে? তার পা দু’টো যেন অবশ হয়ে আসছে। সুতপার জায়গাটা তো সে তার অজান্তেই শ্রীতমাকে দিয়ে দিয়েছে।

Exit mobile version