মহালয়ার আগে
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
‘বম্ বম্ ভোলে।দিমাগের চাবি খোলে’। নন্দী ও ভৃঙ্গীর এই সুন্দর গানের তালে নৃত্য করতে করতে মহাদেব কৈলাস অভিমুখে যাত্রা করেছেন ভূত প্রেতদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে। সারা বছর নিজের সাধনায় লিপ্ত থাকেন তিনি। কিন্তু দেবী পক্ষের শুরু থেকেই তিনি থাকেন মাতা পার্বতীর সাথে। কারণ একটাই মা দুর্গা বাপের বাড়ি যাবেন। সমস্ত কিছু ঠিকঠাক নেওয়া হল কিনা তার তদারকিতে ব্যস্ত থাকেন মহেশ্বর।
কৈলাসে ফিরেই গনেশের সাথে দেখা সবার আগে। খুব চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছেন বিঘ্নহরতা। শৈশব থেকেই গনেশ খুব ধীর স্থির এবং মাতা পার্বতীর আজ্ঞাবহ। আর স্পষ্ট কথায় গনেশের জুরি মেলা ভার।
– কী রে গনশা। কী হলো বাবা তোর? মহাদেবের গুরুগম্ভীর আওয়াজে গণেশ তার চিন্তার ক্ষেত্র স্থল থেকে বেরিয়ে এসে বিনম্র প্রণাম জানায় পিতৃদেবকে।
– বাবা, মামা বাড়ির লোকজনরা একদম ভালো নেই। স্বর্গ থেকে অসুররা বিতাড়িত হবার পর মর্তে আস্তানা গড়ে তুলেছে।
– কী বলছিস! অসুরের দল এখন মর্তে হানা দিয়েছে?
– হ্যাঁ বাবা। মামা বাড়ির সুজলা-সুফলা পরিবেশ অসুররাই নষ্ট করছে। মর্ত্যে তাদের আকৃতি বিশালাকার নয়। বরং অদৃশ্য বলা যেতে পারে। এমনভাবে প্রতিটি মানব শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়ছে যে মানব মনকে সারাক্ষণ সুর অসুরের দ্বন্দ্বে মাতিয়ে রেখেছে। স্বর্গ নিয়ে যেহেতু দেবতারা মত্ত তাই অসুররা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারাও মেতে উঠেছে মর্ত্য নিয়ে।
মানবরা যখন সৃষ্টি হল প্রজাপতি ব্রহ্মার শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে তখন দয়া মায়া, মমতা, ভালোবাসা যে অনুভূতিগুলোকে মানব শরীরে ডাউনলোড করে দেওয়া হয়েছিল তা এখন হিংসা, ক্রোধ, অভিমান, লোভ এইসব অসুরিয় ভাইরাসগুলি দ্বারা আক্রান্ত। যতদিন না ঠিকঠাক আপডেট করা হচ্ছে মানব শরীরগুলোকে ততদিন দেবতারা পারবেনা মানবসমাজকে বাঁচাতে।
– এতো সাংঘাতিক ব্যাপার।দেবতাদের এত সুন্দর ‘পর্যটন ভূমিকে’ অসুরগুলো বিষাক্ত করে তুলেছে। এতো রীতিমত উদ্বেগের বিষয়। গনশা তোর মাকে শীঘ্রই খবর পাঠা। বল, আমি এক্ষুনি তার উপস্থিতি কাম্য করি।
মহাদেবের ডাক পেয়ে দুনিয়া সংসারের সমস্ত কাজ ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির মা দুর্গা।
– কি হলো? এত জরুরি তলব। তোমার ভূত-প্রেতদের খেতে দিচ্ছিলাম।
গণেশ এতক্ষণ যা বলল তা সবিস্তারে দুর্গাকে জানালেন মহাদিদেব। দু’জনেই ভীষণ চিন্তিত।
– দুর্গাতো বলেই উঠলো বছরে তিনবার বিভিন্নরূপে সপরিবারে মর্তে যাই। তাও এবার বন্ধ করতে হবে দেখছি।
– প্রচন্ড বিরক্তির স্বরে দেবাদিদেব বলে দুর্গা তোমার মুখে একথা শোভা পায় না। কোথায় অন্যায়ের প্রতিকার করবে তা নয় পালিয়ে বাঁচতে চাইছো। ধিক্..
– অবিবেচকের মতো কথা বলার জন্য ক্ষমা করবেন প্রভু। বলুন আমায় আপনি কি আজ্ঞা করেন।
-সমস্ত দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির উৎস তুমি দেবী। তাই আমার একার কথা নয় সবার কথায় তোমার শোনা দরকার। আজি বিকেল চারঘটিকায় এক জরুরী সভার আয়োজন করো। যদি কেউ অনুপস্থিত থাকে তাহলে তার পদস্খলন করা হতে পারে।
দেবী দুর্গা নারদকে মনে মনে স্মরণ করতেই ঢেঁকির পিঠে চড়ে নারদ সশরীরে দেবী দুর্গার কাছে উপস্থিত। দেবী দুর্গা মহাদেবের আজ্ঞা নারকে বুঝিয়ে বলে এবং প্রত্যেককে অবগত করতে আদেশ দেন।
যথারীতি বৈকাল চার ঘটিকায় জরুরী সভা শুরু হয়। বাঘছালের উপর অধিষ্ঠান করেছেন মহাদিদেব। সবথেকে নিকটতম আসনে বসে আছেন পার্বতী। সারিবদ্ধ ভাবে বসে আছেন প্রজাপতি ব্রহ্মা, শ্রীবিষ্ণু, ইন্দ্র, কুবের, বরুন, পবন, গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মনসা, শীতলা ইন্দ্রের ছেলে জয়ন্ত আরো অনেক ইয়ং দেবোতারাও।
কোনরকম ভুমিকা ছাড়াই দেবাদিদেব সর্বপ্রথম ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তাঁর মর্ত্য সামলাতে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। যেই না জিজ্ঞাসা করা, ইন্দ্র বলে ওঠে,_’দেবাদিদেব মর্তের মানব সবসময় আমার বিরুদ্ধাচারণ করে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হলে আমায় অকথা কুকথা বলছে কিন্তু নিজেরা কি একবারও নিজেদের ক্রিয়া-কলাপ এর দিকে দৃষ্টিপাত করছে। প্রভু যেদিন থেকে ‘প্লাস্টিক ‘নামক বস্তুটির উদ্ভাবন হয়েছে সেদিন থেকেই মানব পরিবেশে দূষণের মাত্রা লাগামছাড়া হয়েছে। গভীর সমুদ্র বক্ষে তিমি মাছের পেটে প্লাস্টিক মিলছে। প্লাস্টিকের কোন ক্ষয় নাই। আর যদি পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করো তাহলে পবনের দপ্তরের আরো দূষণের মাত্রা বাড়ছে। শুধু কি দূষণ প্রভু, মানব দেহে লোভ নামক ভাইরাসটা এতো জাঁকিয়ে বসেছে সব কিছুতেই মানব প্রফিট খুঁজচ্ছে। শান্ত, সৌম্য, নির্জন স্থানে গড়ে উঠেছে ‘টুরিস্ট স্পট।’যেখানে প্রকৃতির নির্জনতা পছন্দ সেখানে কোলাহল হলে আমাকে তো বিদ্রোহ করতেই হচ্ছে। অতি বৃষ্টি, বাদল ফাটা ইত্যাদি আরো ধ্বংসাত্মক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে বাধ্য হচ্ছি।
– ঠিক আছে ঠিক আছে। কুবের তোমার কি কিছু অভিযোগ আছে মানবজাতি সম্বন্ধে?
– প্রভু, মানবজাতির প্রত্যেক মানব আজ ধনকুবের হতে চাইছে। যতটা দরকার তার বেশি তাঁরা সঞ্চয় করছে। ফলে একদলের দারিদ্রতা কিছুতেই মেটাতে পারছি না। ফলে বাধ্য হয়ে মানব সমাজের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিতে হচ্ছে।
– মহাদেব বলে উঠলেন তোমরা সকলেই জানো দু’দিন বাদে মহালয়া। দেবীপক্ষের সূচনা। মহিষাসুরের হাত থেকে স্বর্গকে বাঁচাতে আমরা দেবতারা সকলে মিলে দেবী দুর্গাকে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু আমাদের স্বর্গে শান্তি থাকলেও দেবী দুর্গার ভক্তরা ধরাধামে চরম অশান্তির মধ্যে আছে। আমরা একত্রিত হয়ে কি এর কোন সমাধান করতে পারিনা?
– সরস্বতী বলে উঠলো, একমাত্র জ্ঞানই পারে মানব জাতিকে রক্ষা করতে। জ্ঞানের প্রসার এর জন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তো মানব জাতি তৈরি করেছে কিন্তু বর্তমানে সেখানে জ্ঞান নাই। মানবরা নিজেদেরকে জ্ঞানীতে পরিণত করার চেয়ে ধনিতে পরিণত করতে বেশি ভালোবাসছে। আমি তো কোন সমাধানই দেখতে পাচ্ছি না।
প্রায় চল্লিশ মিনিট কথোপকতন চলার পর মুখ খুললেন ‘শ্রীবিষ্ণু’। যতবারই মানবজাতি বিপদের মুখে পড়েছে আমি বিভিন্ন অবতারের রূপ নিয়ে মানুষকে উদ্ধার করতে মর্ত্যে অবতীর্ণ হয়েছি। কিন্তু দিন দিন ‘হিংসা’ নামক ভাইরাস মানব শরীরকে বিষাক্ত করে তুলেছে। ওরা আজকাল দেবতাদের সঙ্গেও হিংসার প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। এই কদিন আগে জন্মাষ্টমী গেল সেখানেই তো আমার কৃষ্ণ অবতারের পুজো হয়। ভাল কথা পুজো করে মানব। কিন্তু পিছনে খালি নোংরা কথা-‘ শ্রীকৃষ্ণের ষোলশো গোপিনী আর আমরা (মানুষ) একটির বেশি স্ত্রীসঙ্গ করলেই অপরাধ। ‘প্রভু ব্রহ্মা যে মানব শরীর তৈরি করেছিল তা আজ বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। দয়া, মায়া, ভালবাসা, ত্যাগ এইসব অ্যাপগুলো মানব শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা আজ লোভ, হিংসা, ক্রোধ নামক অসুরিয় ভাইরাসগুলো দ্বারা আক্রান্ত। ধরাধামে এর অস্তিত্ব সংকটের মুখে।
দেবী দুর্গা সকলকে নমস্কার করে শুরু করলেন তাঁর বক্তব্য- ‘আমি ভাবছি মহালয়ার পুণ্য তিথিতে যেমন মহিষাসুর বধ করে আমার আগমন বার্তা মানবজাতিকে জানান দিয়ে থাকি তেমনি এবার মহালয়ার দিন থেকে পূজামণ্ডপগুলোতে সারপ্রাইজ ভিজিট এর কথা ভাবছি। আমাদের মধ্যে সকলকে পালা করে পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করতে যেতে হবে। কোথাও ভক্তিভাব, কোথাও অর্থের প্রাচুর্য, কোথাও অহংকারের বুদবুদ এইসব ভাইরাসগুলোকে চিহ্নিত করে আসতে হবে দেবতাদেরকেই। একেকটি লিষ্ট করে মন্ডপের নামের পাশে কোন ভাইরাসের আধিক্য তার নাম উল্লেখ করে ষষ্ঠীর দিন আমি যখন রওনা দেব তখন আমার দশ হাতে সেগুলোকে সাজিয়ে দেবে তোমরা।
মহাদেব বলে ওঠেন, – কি পরিকল্পনা তুমি করছো তা সকলকে বুঝিয়ে বলো তো।
– যে মন্ডপে ভক্তির আধিক্য বেশি সেখানে চারদিন থাকবো পুরো সময়ের জন্য। আর যেখানে অর্থ, হিংসা, স্বার্থ ইত্যাদির আধিক্য বেশি সেখানে থাকব আংশিক সময়ের জন্য। সকাল সন্ধ্যা পুজোর সময়টুকুতে। আমার করুণা দয়ার চেয়ে যাদের কাছে পার্থিব আনন্দ-ফূর্তি বেশি সেইসব নরাধমদের আমি একদম পছন্দ করি না। সোনার, হীরের অলংকারের চেয়ে আমার ফুলের অলংকার বেশি পছন্দ। মানব শরীরে লোভ, লালসা, হিংসা এই অসুরিয় ভাইরাসগুলোকে ধ্বংস করতে সময় লাগবে। ততদিন না হয় আমরা সকলে ব্রম্ভ্রা
ব্রম্ভ্রার সৃষ্ট মানব জাতির জন্য প্রার্থনা করি সৎ বুদ্ধি, সৎকর্ম, সৎঅভিলাষা এগুলো যেন তাদের মানব শরীরে এর ফরমাটে নতুন ভাবে ডাউনলোড হয়। মানব শরীর যেন লোভ-লালসা ক্রোধ হিংসা এইসব অসুরিয় ভাইরাস থেকে হয় মুক্ত।