বোধন
– রাখী চক্রবর্তী
“শরত্কালে শিউলি ঝড়ে
মায়ের বোধন দু’দিন পরে” ।
ফুলকির খুব আনন্দ হয় শরৎকাল এলে।
শিউলি ফুলের গন্ধেতে মো মো করে জমিদার বাড়ির বাগান। ফুলকি রোজ ভোর বেলায় জমিদার বাড়ির বাগানে পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ে। তারপর মনের সুখে শিউলি গাছ থেকে এক এক করে সব ফুল তুলে নেয়। তারপর বাড়ি ফিরে সেই ফুলের মালা গেঁথে মা কালির মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্রি করে। শরৎকাল ফুলকির খুব পছন্দ। মা দুগ্গা আসে তো তাই, দু’টো পয়সাও পায়।
আজ পঞ্চমী। খুব ভোর বেলায় জমিদার বাড়ির বাগানে পাঁচিল টপকে ঢুকে শিউল ফুল কুড়িয়ে জামার কোচরে ফুলগুলো নিয়ে যেই বাগান থেকে বের হতে যাবে ঠিক তখনি জমিদার বাবুর হুমকিতে জামার কোচর থেকে সব শিউলি ফুলগুলো মাটিতে পড়ে গেল। ফুলকি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, মশাই আমাকে মাপ করে দাও আর ফুল তুলতে আসব না। জমিদার বাবু নরম গলায় বললেন, সব ফুল কুড়িয়ে নে।
ফুলকি মাথা নিচু করে সব ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বলল,
– মশাই তুমি খুব ভালো ।
– কি নাম তোর? কে আছে তোর।
– ফুলকি আমি আছি, মা আছে, বাবা নেই ।
– কি করে তোর মা
– ইট ভাটায় কাজ করে।
– তুই কি করিস?
– আমি তোমার বাগান থেকে ফুল তুলে সে ফুলের মালা গাথি তারপর কালি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি মালাগুলো নিয়ে। বিক্রি হলে বাড়ি ফিরি।
জমিদার বাবু বললেন, আজকে সব ফুলের মালা আমি নেব। বিকেল বেলায় আসবি এই বাগানে। দাম পাবি ভালোই। ফুলকির মাথা নাড়িয়ে দে ছুট…
আজ অনেক টাকা পাবে ফুলকি। বারো বছরের ফুলকি মনে মনে হিসাব করে নিল।মার জন্য শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ কিনবে।নিজের জন্য একটা জামা কিনবে। আর জমিদার বাড়িতে তো দুগ্গা পুজো হয়। এই বার না হয় মা দুগ্গাকে একটা ছাপা শাড়ি কিনে দেবে। ফুলকির অনেক দিনের ইচ্ছা মা দুগ্গাকে একটা শাড়ি দেবে। কতো কথা ভাবতে ভাবতে শিউলিফুলের মালা গাঁথলো ফুলকি।
আজ পঞ্চমী। ঢাকের শব্দে ফুলকির মন নাচছে। জমিদার বাড়িতে যাবে বিকেল বেলায়। আর তর সইছে না। কখন হবে দুপুর, তারপর বিকেল, জমিদার মশাই যে কেন বিকেল বেলায় যেতে বলল ফুলকি তা ভেবে পাচ্ছে না।
যাইহোক ফুলের মালা নিয়ে ফুলকি জমিদার বাড়ির বাগানে পাঁচিল টপকাতে গিয়ে দেখল বাগানের দরজা খোলা আছে।ফুলকি বাগানে ঢুকেই দেখে জমিদার মশাই দাঁড়িয়ে আছে। সব মালাগুলো জমিদার মশাইয়ের হাতে দিতেই ফুলকি এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নিল।
– টাকা নিবি না ফুলকি। দেখ কততো টাকা ।পুজোর জামাকাপড় কিনতে হবে তো তোকে।
ঢাকের বাদ্যি, কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ কেমন যেন অচেনা লাগছে ফুলকির। কখন যাবে মার কাছে তাই ভেবে যাচ্ছে। জমিদার বাবু ফুলকিকে জাপটে ধরে ফুলকির মুখটা টিপে ধরল। “আমি বাড়ি যাব আমাকে ছেড়ে দাও”। মুখের মধ্যেই গুঞ্জারিত হচ্ছে ফুলকির মনের কথা।
আজ খুব জোরে ঢাক বাজছে। মার বোধন বলে কথা। ফুলকির চারপাশে শিউলি ফুলের মালা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে। তবে ফুলকির অর্ধনগ্ন দেহ শিউলি ফুল স্পর্শ করেনি।
ও কাকু, মা দুগ্গার শাড়ি দেখাও। এবার মা দুগ্গাকে একটা শাড়ি দেব। মার জন্যও শাড়ি নেব একটা। আজ বুঝি মায়ের বোধন। ঐ তো মা দুগ্গা ত্রিশূল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সব অসুরদেরকে কি বধ করে মা দুগ্গা? না কি স্বগের অসুরদের বধ করে শুধু। বলো না কাকু?
ফুলকির স্বপ্নর বিসর্জন হল আজ। আজ যে মা দূর্গার বোধন।