বোধন
-পারমিতা ভট্টাচার্য
অঞ্জন আর দীপিকার বিয়ে হয়েছে সাত বছর। কলকাতার বহুতল আবাসনে বেশ অনেকটা অর্থ খরচ করে ওরা একটা দুই কামরার ফ্ল্যাট কিনেছিল। দু’জনেই চাকরি করে। ফ্ল্যাটটাও খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিল দীপিকা। এভাবে বেশ ভালই কাটছিল দু’জনের জীবন। এরপর দীপিকা প্রেগন্যান্ট হল। ওদের তো খুশির অন্ত নেই। সাথে দুই পারিবারেরও।অঞ্জনের চাপেই প্রায় বলতে গেলে দীপিকা অফিস থেকে ছুটিটা একটু আগেভাগেই নিয়ে নিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। দীপিকা পা হড়কে পড়ে গেলে সব আশা ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। পনেরো দিন যমে- মানুষে টানাটানি করার পর দীপিকা সুস্থ হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো গেল না। সেই থেকে এখনও অবধি দীপিকা নিঃসন্তান। অঞ্জন যদিও চেষ্টার কোনও খামতি রাখেনি। বহু ডাক্তার দেখিয়েও কোনও সুরাহা মেলেনি। একটা সন্তানকে কেন্দ্র করে ওদের জীবন থেকে কেমন যেন সমস্ত আনন্দ, খুশি উধাও হয়ে গেছে। কে যেন এক ফুঁয়ে সমস্ত আশা –আকাঙ্খাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। দীপিকা নিজেকে দোষী ভাবতে ভাবতে চলে যায় গভীর ডিপ্রেশনে। এরপর অঞ্জনের মা অর্চনা দেবীও পরবর্তী প্রজন্মের আশায় তার আবার বিয়ে দিতে চান। অর্চনা দেবী প্রায়ই বলতে থাকেন— ‘আর কটা দিনই বা বাঁচব? নাতি নাতনির মুখ দেখে মরতে পারলে তবেই মরে শান্তি পাবো।’ কিন্তু অঞ্জন? কিছুতেই রাজি হয়না বিয়েতে। ও দিকে অর্চনা দেবী তো নাওয়া- খাওয়া ছেড়ে পণ করেছেন মরার আগে নাতি –নাতনির মুখ দেখলে তবেই শান্তি পাবেন। দীপিকাও অঞ্জনকে বলে মায়ের কথা মেনে নিতে। এক বিষম পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় অঞ্জনকে। একদিকে অবুঝ মা অন্যদিকে নিজেদের মানসিক যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট যা তাদেরকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে।
এমতবস্থায় তারা ঠিক করে যে সন্তান দত্তক নেবে। কিন্তু এতেও অর্চনা দেবী একেবারেই বেঁকে বসে। কিছুতেই তাঁকে রাজি করানো যায় না। অন্যদিকে দীপিকাও ডিপ্রেশনে চলে যেতে থাকে বিশ্রীভাবে। ডাক্তারবাবুও পরামর্শ দেন সন্তান দত্তক নেওয়ার। অঞ্জন নিজের মাকে অনেক বোঝাতে থাকে –তার কথা, দীপিকার কথা। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তেই অনড় থাকেন। কোনও শুভ অনুষ্ঠানে তিনি নিয়ে যেতে চান না দীপিকাকে। সব মহলেই দীপিকাকে বাঁজা বলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। দীপিকাও আজকাল কোথাও যেতে চায়না। সেও ধীরে ধীরে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। অফিসও যায় খেয়াল খুশী মত। এসব নিয়ে অঞ্জনও পড়ে মহা বিপাকে।
শেষে অঞ্জন সিদ্ধান্ত করেই নিল যে তারা বাচ্চা দত্তক নেবে। যদি দীপিকাকে বাঁচাতেই হয় তবে দু’টো কচি কচি হাতের খুব দরকার ওদের। আর মাকে যেমন করেই হোক বোঝাতে হবে।অফিস থেকে আসার সময় অঞ্জন সোজা গেল একটা হোমে। তার বন্ধুদের থেকে হোমের ঠিকানা সে আগেই নিয়ে রেখেছিল। হোমে কথাবার্তাও বলে সে। একটু হলেও আশার আলো সে দেখতে পেল সেদিন। বুকের থেকে জগদ্দল পাথরটা যেন একটু হলেও নড়ে চড়ে উঠে তার।
এর কিছুদিন পর ব্যস্ত অঞ্জন হঠাৎই দীপিকাকে একদিন বলল—‘চলো, আজ আমরা একটু ঘুরে আসি।’
‘লং ড্রাইভ? কতদিন যাইনি।কিন্তু তোমার অফিস?’– জিজ্ঞাসা করল দীপিকা।
‘আজ অফিসে ছুটি নিয়েছি। তুমিও যেওনা আজ অফিস। দু’জনে মিলে ঘুরে আসি চলো একটা জায়গা থেকে।’—বলল অঞ্জন।
‘কোথা থেকে?’—আবার জিজ্ঞাসা করলো দীপিকা।
অঞ্জন বলল—‘চলোই না। একটা অন্য জগত থেকে ঘুরে আসি। আর কোনও প্রশ্ন নয় দীপু।’
দীপিকা কি যেন বলতে চাইছিল। ওকে থামিয়ে দিয়ে অঞ্জন বলল –‘রেডি হও।’
দীপিকা দেখল শহরের উপকণ্ঠে একটা সুন্দর জায়গা। কত ফুল, কত গাছ। কত ফুলের মত শিশুরা খেলা করছে মাথে। সে এক মনোরম দৃশ্য। অঞ্জন আর দীপিকা সেই মাঠে এসে দাঁড়ালো। দীপিকার আর বুঝতে বাকি রইলো না তারা কোথায় এসেছে। সমস্ত ফরম্যালিটি শেষ করে এক বছরের ছোট্ট বৃষ্টিকে কোলে পেল দীপিকা। খুশিতে চোখে জল চলে এলো দীপিকার। এই কোমল স্পর্শের অপেক্ষায় ওদের জীবনটা ব্যর্থ হতে বসেছিল। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
কিন্তু বাড়ি এসে মহা বিপত্তি দেখা দিল। অঞ্জনের মা অর্চনা দেবী কিছুতেই সেই বাচ্চাকে মেনে নিলেন না। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল অঞ্জন তার মাকে। কিন্তু তাঁর সেই একই কথা –‘বলেছিলাম আর একটা বিয়ে কর। কার না কার অবৈধ সন্তান উঠিয়ে নিয়ে এলি। আমি ওকে মানিনা। ও আমার রক্তের কেউ নয়।’ কেউ কিছুই বোঝাতে পারল না অর্চনা দেবীকে। তিনি ছোট্ট বৃষ্টিকে ছুঁয়েও দেখেন না। আদর করা, কোলে নেওয়া, গল্প বলা তো দূরের কথা। কিন্তু একদিন ঘটল অঘটন। ছোট্ট বৃষ্টির রাত থেকে প্রবল জ্বর। সাথে খিঁচুনিও হতে লাগলো। মাথায় জলপটি, জ্বর কমার ওষুধ কিছু দিয়েই তার জ্বর কমানো গেল না। অগত্যা হাউস ফিজিসিওন এর কথায় নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হলো বৃষ্টিকে। টানা তিন দিন চোখ মেলে তাকালো না সে। ওইটুকু শরীরটাতে সূচ বেঁধানো আছে তার। দীপিকা তো পাগলের মত হয়ে গেছে প্রায়। একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে। অঞ্জনেরও কোনও ভাষা নেই তাকে সান্তনা দেবার। অঞ্জন শুধুই ডাক্তারের কাছে মিনতি করছে –‘আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন।’ এই বলে। এই কদিনে অর্চনা দেবী একবারও আসেনি ছোট্ট বৃষ্টিকে নার্সিংহোমে দেখতে। কিন্তু যখন ছেলে- বউ থাকেনা তখন তিনি ধর্না দিয়ে পড়ে থাকেন ঠাকুরঘরে। হাজার হোক, নিজের রক্ত নাই হোক বৃষ্টিকে পেয়ে ওনার ছেলে –বউএর জীবনে খুশির ঝলক এসেছে। সেটা কি তিনি বোঝেন না? সবই বোঝেন। আর তার জন্যই তো বৃষ্টির এতো বড় বিপদটা ঘটলো। কেউ জানুক আর নাই জানুক, তিনি তো জানেন। ছোট্ট বৃষ্টি সেদিন পা পা করে এসে তাঁর সাধের নাড়ুগোপালের নাড়ু তুলে খাচ্ছিল। তাই দেখে অর্চনা দেবী মাথার ঠিক রাখতে পারেন নি। হাত থেকে টেনে ফেলে দিয়েছিলেন আধ-খাওয়া নাড়ু। শুধু তাই নয়, গালে কষিয়ে দিয়েছিলেন দু’টো চড়। সেই আঘাতই সহ্য করতে পারেনি ছোট্ট বৃষ্টি। এর ফলেই রাত থেকে প্রবল জ্বর এসে যায় তার। এখন বিবেক দংশনে জর্জরিত অর্চনা দেবীর সহায় একমাত্র সেই ভগবানই। নাওয়া – খাওয়া ছেড়ে পড়ে আছেন ভগবানের পায়ে যাতে বৃষ্টি ভাল হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
হঠাৎ,অর্চনা দেবী যখন গোপালের পায়ে পড়ে কাঁদছেন আর বৃষ্টির ভাল হয়ে যাবার মিনতি করছেন ঠিক তখনই অঞ্জন তার মাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। ছেলে দেখল মা ঠাকুরের পায়ে পড়ে কাঁদছে। তার ডাক শুনে তড়িঘড়ি ছুটে এলেন তিনি। অঞ্জন করুণ স্বরে মাকে বলল—‘তোমাকে এক্ষুনি নার্সিংহোমে যেতে হবে মা। বৃষ্টির জ্ঞান ফিরে এসেছে।আর শুধুই তোমাকে ডেকে যাচ্ছে ঠাম্মা ঠাম্মা করে। চলোনা মা। আজ সব ভুলে ওই ছোট্ট মেয়েটার মুখ চেয়ে। অর্চনা দেবী তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যান। নার্সিংহোমে গিয়ে দেখেন পাগল প্রায় দীপিকাকে। অর্চনা দেবীকে দেখে তাঁর পায়ে পড়ে কাঁদতেই থাকে সে। তাকে শান্ত করে বৃষ্টির কাছে ছুটে যান অর্চনা দেবী। বৃষ্টির মাথায় হাত রাখতেই চোখ মেলে দেখে ঠাম্মাকে। অমনি ঠাম্মা বলে ডেকে ওঠে সে। সেদিন আর তিনি বাঁধা দিলেন না তাঁকে ঠাম্মা ডাকাতে। প্রাণভরে শুনতে লাগলেন সেই বহু আকাঙ্খিত ডাক। চোখের জল আর ধরে রাখতে পারেন না অর্চনা দেবী। ঠাকুরের প্রসাদী ফুল ছুঁইয়ে দেন বৃষ্টির কপালে।
এরপর দুর্গাপুজোতে তারা সবাই মিলে যায় গ্রামের বাড়ি। বাড়ির পুজো, হৈ হৈ ব্যাপার। বৃষ্টিও এখন পুরো সুস্থ। ষষ্ঠীর দিন আচমকাই অর্চনা দেবী বৃষ্টিকে কোলে নিয়ে বাড়ির সকল লোকের সামনে মা দুর্গার বোধনের সময় ঠাকুর দালানে এলেন। মায়ের আশীর্বাদী ফুল ছোঁয়ালেন বৃষ্টির কপালে। হেরে গেল তাঁর বনেদি আভিজাত্যের দেমাক। জয়ী হল তাঁর মমত্ববোধ। শেষ অবধি তাঁর মনে শুভ বুদ্ধির উন্মেষ ঘটল দেবী মহামায়ার বোধনের মধ্য দিয়ে। তিনি এটা বুঝলেন যে রক্ত দিয়ে সবসময় সম্পর্কের বিচার হয়না, সম্পর্ক হল আত্মিক বন্ধন। দূর থেকে দীপিকা আর অঞ্জন দেখতে লাগলো এই তো তাদের চেনা মা। যাকে তারা এতদিন পাগলের মতো খুঁজেছে। আজ তাদের বাবা- মা হওয়া সার্থক। ওরাও গিয়ে দাঁড়ায় অর্চনা দেবীর পাশে। শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন।