গল্প- অচল কয়েন

অচল কয়েন
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

আজকাল কি হয়েছে কে জানে, ছোট্ট সাইজের একটাকার কয়েন কেউ নিতে চায় না। অনেকদিন যাবৎ মানিব্যাগে পড়ে আছে। চালাবার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু সফল হয়নি মালতী। কিন্তু ওতো নিয়েছিলো, কে কখন কোন ফাঁকে গছিয়ে দিয়েছে। মালতী আয়ার কাজ করে আয় করে। ওর কাছে টাকার মূল্য অনেক। হলেই বা একটাকা, তাই বা কে দেয় শুনি! মালতী রোজ ডানকুনি লোকালে যাতায়াত করে কোলকাতায়। কাজের জন্যেই করে। বাড়িতে স্বামী পুত্র শাশুড়ী। স্বামীটা মাতাল, কুঁড়ের হদ্দ। নির্লজ্জ। বউয়ের রোজগারে খায়। অনেকবার দূর করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। দু’কান কাটা। দু’দিন এদিক ওদিক কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছে। সে নাকি শুধরে গেছে, আর ভুল হবে না। ফেরেববাজ। মালতীর গা সওয়া হয়ে গেছে। পাত্তা দেয় না। আসলে ছোট্ট ছেলেটার কথা ভেবে। ওই অচল নয় তবু অচল হয়ে পড়ে থাকা ছোট্ট এক টাকার কয়েনের মতো। আছে, পড়ে থাক ব্যাগের এক কোণে, মূল্যহীন হয়ে।

ট্রেনের কামরায় রোজই একজন বয়স্ক মানুষ গান গেয়ে ভিক্ষে করে। মালতী গান শোনে কিন্তু ভিক্ষে দেয় না। সেদিন কি মনে হলো, ব্যাগ খুলে সেই দু’খানি কয়েন বার করে, লোকটির হাতে দিলো। ভাবলো, যাক, এতদিনে ওগুলোর একটা গতি হলো। ওমা, মালতীর কি সেই কপাল? লোকটি, মৃদু হেসে, কয়েন দু’টি মালতীকে ফেরৎ দিয়ে বললো- এই নিয়ে কতজনকে যে ফেরৎ দিলাম হিসেব নেই। ভিখিরিদের দেবার জন্যেই মনে হয় সরকার এগুলো বানিয়েছে। যতসব বাজার অচল মাল।
অত লোকের সামনে, বড্ড কানে লাগলো কথাগুলো। মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু সামলে নিলো। পাশ থেকে সান্ত্বনা বাক্য এলো।
– অসভ্য, ভিখিরির আবার বড়ো বড়ো কথা। দ্যান কেন? পেয়ে বসে সব। বিধান নগর ষ্টেশন। এখানেই মালতী নামবে। কয়েন পুনরায় ব্যাগে ।

মালতী আজ কার মুখ দেখে বেড়িয়ে ছিল কে জানে। ষ্টেশন থেকে বেড়িয়েই চটির বুড়ো আঙুলের দিকটা খুলে গেল। মালতী জানে, মুচি কোথায় বসে। অনন্ত ত্রিশ পা, তাকে লেংচে লেংচে চলতে হবে। ছি ছি, সব্বাই দেখবে। বিচ্ছিরি ব্যাপার। ছেলেরা হলে একরকম, কিন্তু একটা মেয়ে ছেঁড়া চটি টানতে টানতে লেংচে লেংচে চলছে, কেমন যেন আশ্চর্য হাস্যকর ঘটনা। সুতরাং, চটি হাতে। খালি পায়ে অগতির গতি মুচির দরবারে।

চটি সারাই হয়ে গেছে। বারো টাকা মজুরি লাগবে। মুচির হাতে তার দাবি মতো বারো টাকা দিলো মালতী। একটা দশটাকার নোট, আর সেই দু’টি কয়েন।
মুচি দশটাকার নোট পকেটে রেখে, কয়েন দু’টি ফেরত দিয়ে বললো, এগুলো থাক, আপনার কাজে লাগবে।

এ কোথাকার কয়েন? এই দেশেরই তো। সরকার তো বাতিল করেনি, তাহলে? মালতী জানে এসব কথায় চিঁড়ে ভিজবে না। সুতরাং, হজম, হজম। হজম করতে শেখো।
আইনত সচল অথচ বাজারে অচল কয়েন, আবার ব্যাগে লজ্জায় সেঁধিয়ে গেল।

কাজ শেষে রাতে ঘরে ফিরে মালতী দেখলো, কেমন যেন থমথমে করছে ঘরটা। ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শাশুড়ী দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে বসে আছে। অকেজো স্বামীটা ঘরে নেই। কোথায় কোন মালের ঠেকে ভিড়েছে নিশ্চয়।

মা, রান্না করোনি?
জল খেতে গিয়ে টের পেলো মালতী, রান্নার জায়গা পরিস্কার, রান্না হয়নি।
শাশুড়ী ডুকরে কেঁদে উঠলো…
-আমার ছেলেটাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। হারামজাদার ব্যাটারা বলে কিনা আমার ছেলে ছিনতাই করেছে। আমার ছেলে মাতাল কিন্তু চোর নয়। ওগো, আমার ছেলেটার কি হবে গো! জেলখানায় নিয়ে গিয়ে মেরে মেরে শেষ করে দেবে গো..ওরে আমার নিতাই রে…
মালতীর মাথা গরম হয়ে গেল। কাপড় বদল করতে করতে বললো, কিচ্ছু হবে না। চুপচাপ মুড়ি চিবিয়ে শুয়ে পড়ো। এখন আমার পক্ষে রান্না করা সম্ভব নয়। দুধ আছে, ছেলেটাকে দুধমুড়ি খাইয়ে দেব।

ভোর হয়েছে। কাজে বেরুতে হবে। মালতী উঠে দরজা খুলে অবাক। দরজার পাসে নিতাই, নিতান্তই গোবেচারার মতো বসে আছে। দরজা খোলো পেয়েই সুরুৎ করে মালতীকে পাশ কাটিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে সিঁধোলো। মালতীর মাথায় আগুন জ্বলছে।
-নির্লজ্জ বেহায়া, যমের অরুচি বেটাছেলে, নিষ্কর্মার ঢেঁকি। এবার শাশুড়ীকে শুনিয়ে,
– কি বলেছিলাম, মিললো আমার কথা.. এইসব অচল মালের, নোংরা জেলখানাতেও ঠাঁই হবে না। শেষমেশ আমার আঁচলের তলাতেই এসে জুটতে হবে।
নিতাই যেন বোবাকালা। যেন কিছুই হয়নি, এমনই ভাব করে কাৎ হয়ে শুয়ে রইলো। কাল সারারাত অনেক ধকল গেছে। সুতরাং নিরপদ্রুপ বিশ্রাম চাই। কোলাহল একটু পরেই থেমে যাবে। শান্তি চাই শান্তি। এক চিলতে শান্তি। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। নাক ডাকার আওয়াজ। মালতী ভেবে পায়না, এরা মানুষ নাকি মানুষের মতো দেখতে?

ডিউটি আছে, মালতী ঘরের সব কাজ মিটিয়ে রেডি। নিত্যকার ব্যাপার। মালতীদের রাগ করতে নেই, কষ্ট পেতে নেই, ভবিষ্যত ভাবতে নেই, কেবল বর্তমানের চিন্তায় আকুল থাকা। শখ আর সুখ দুই বোন। ওরা মালতীদের থেকে অনেক দূরে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু আফসোস আছে আষ্টেপৃষ্টে।
ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। পয়সার ব্যাগটা খুলে দেখে নিলো অভ্যেস মতো। সেই কয়েন দু’টো ব্যাগের কোণায় পড়ে আছে বোকার মতো। কি হবে ওগুলো রেখে?
কয়েন দু’টো বার করে মুঠো করে ধরে, ছুঁড়ে ফেলে দিতে গিয়েও কি যেন ভেবে, ফেললো না। কপালে আলতো করে ঠেকিয়ে আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।
বিড়বিড় করে বললো, যত্তসব….
মালতী দরজা টেনে বন্ধ করে বেড়িয়ে গেল। নিতাই নিশ্চিন্তে নাক ডাকছে , ফরফতুউউউউউ,,,,,,

Loading

Leave A Comment