ছন্দপতন
– পারমিতা ভট্টাচার্য
আজ মহাসপ্তমী। আলোর রোশনাই আর ঢাকের আওয়াজে গমগম করছে চারিদিক। একরাশ অন্ধকার শুধু রাইয়ের মনের গহীনে। তার জীবনে কোথাও কোনও খুশি নেই, আনন্দের ঝলকানিও নেই। গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে তার বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব। আজ রাস্তায় খুশির ঝলকে মেতে ওঠা মানুষের ঢল দেখে তার মনে পড়ে যায় শুধুই অর্কর কথা। দু’ বছর আগেও অর্ক এ সময় জীবিত ছিল। যদিও উত্থানশক্তিরহিত হয়ে গিয়েছিল সে। তবুও তার বারংবারের একটাই আকুতি ছিল, পূজা মণ্ডপে যাওয়ার। কিছুতেই তাকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যাচ্ছিল না। একে তো যন্ত্রণায় সারা শরীর দুমড়ে, মুচড়ে, কুঁকড়ে যাচ্ছিল, অন্য দিকে পাড়ার মণ্ডপে গিয়ে ঠাকুরের মুখ দেখার শেষ ইচ্ছা। নিয়ে গিয়েছিল রাই তাকে পাড়ার পূজো মণ্ডপে। কি যে খুশি ছিল সে, সে দিন তা ধারনাও অতীত। কিন্তু আজ সব ফাঁকা। রাইয়ের চোখের জল আজ যেন কিছুতেই বাগ মানছে না। তার শাশুড়ি মা তাকে অনেক বার নিয়ে যেতে চেয়েছেন পাড়ার মণ্ডপে। কিন্তু সে কিছুতেই পারেনি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে।
আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে অর্কর মৃত্যু হয় ক্যান্সারে। প্রথম দিকে কিছুই তেমন বোঝা যায়নি। পরে ক্রমে তার শরীর খারাপ হতে থাকে। আস্তে আস্তে তার ওজন কমতে থাকে। বীভৎস রকমের রোগা হয়ে যায় সে। কেমোথেরাপির পরেই তার সারা মাথা নেড়া হয়ে যায়। অবশেষে সব যন্ত্রণার মুক্তি ঘটিয়ে অর্ক ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অর্কর মৃত্যুর পর রাইয়ের বাপের বাড়ির লোকজন অনেক চেষ্টা করেছিল তাকে নিয়ে যাওয়ার, নিজেদের কাছে রাখবার। কিন্তু এক মাত্র ছেলের মা বাবা ছিল রাইয়ের শ্বশুর শাশুড়ি। রাইকেও ভীষণ ভালোবাসতেন তারা। তাছাড়া রাইয়ের শ্বশুর বাড়ির চারিদিক জুড়ে ছড়িয়ে ছিল অর্কর স্মৃতি। ইচ্ছে করলেও এই বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যেতে পা ওঠেনি রাইয়ের। তাই পাঁচ বছরের মেয়ে তৃষাকে নিয়ে সে শ্বশুর বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। বহু চেষ্টা করে সে অর্কর অফিসের কাজটা জোগাড় করেছিল। যদিও অর্কর অফিসের কলিগরা এ ব্যাপারে তাকে খুব সাহায্য করেছিল। এই চাকরিটা পেতে রাই প্রায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কারণ, বাড়িতে বৃদ্ধ দুই মানুষের খরচ, মেয়ের পড়াশোনা, সংসার খরচা…. কোথা থেকে চালাবে সে? যা কিছু জমানো টাকা ছিল সবই অর্কর চিকিৎসায় শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন সে কথাই মনে মনে ভাবে রাই – কত স্বপ্ন ছিল, কত আশা ছিল ছোট্ট মেয়ে তৃষাকে নিয়ে তাদের। জীবনের কিছু স্বপ্ন কোনও দিনই পূরণ হয়ে না। এই সবই ভাবতে থাকে রাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎই তার সংবিৎ ফেরে ছোট্ট তৃষার ডাকে। ছোট্ট তৃষা আর তার ঠাকুমা কল্পনা দেবী জোর দিতে থাকে রাইকে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অবশেষে ওদের জেদের কাছে হার মানতেই হয় রাইকে।
আলমারি খুলে দাঁড়িয়েই থাকে রাই। কত দিন পর যে সে আলমারি খুলল। সারা আলমারি জুড়ে শুধুই অর্কর স্মৃতি। তার উপহার দেওয়া বিভিন্ন সময়ের শাড়ি। শাড়িগুলো সরাতেই তার হাতে লাগলো একটা ছোট্ট শিশি। সন্তর্পণে সেটাকে চকিতে লুকিয়ে ফেলল সে। চোখ তার ভেসে যাচ্ছে জলে। অবশেষে শাড়ি পরে সে তৈরি হল যেমন তেমন করে। কল্পনা দেবী ওদের নিয়ে পূজা মণ্ডপে গেলেন। কিন্তু রাই যেন স্থির হতে পাচ্ছে না একটুও। পুরনো স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। মণ্ডপে একটু থেকেই রাই বাড়ি ফিরে এলো। ঘরে এসে দরজায় তুলে দিলো খিল। আস্তে আস্তে আলমারিটা খুলে সেই লুকনো শিশিটা হাতে নিয়ে সে অর্কর ছবির সামনে তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। কত স্মৃতি মনের মাঝে ভিড় করে আসে আজ।
সেদিনও ছিল এরকমই এক সন্ধ্যা। সে বার পূজো এসেছিল দেরিতে। বাড়ির সবাই গিয়েছিল সত্যনারায়ণ পূজোতে পাশের বাড়ি। অর্কর তখন লাস্ট স্টেজ। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া শরীর আর মৃত্যু যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট চিৎকারে রাই তখন বিধস্ত। কিছুতেই আর সহ্য করতে পারত না অর্কর অসহ্যকর গোঙানি। আস্তে আস্তে রাই মনস্থির করে নিয়েছিল অর্ককে সে এই যন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি দেবে। কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব? মেরে ফেলবে সে অর্ককে? এত ভালোবাসা, এত প্রেম, এত স্বপ্ন এক লহমায় নিজের হাতে কি করে শেষ করবে সে? কিন্তু অর্কর আর্ত চিৎকার আর তীব্র যন্ত্রণা বাধ্য করে রাইকে অর্ককে চিরমুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নিতে।
নার্সিং ট্রেনিং নিয়ে থাকার সুবাদে ডক্টরের প্রেসক্রাইব করা ইনজেকশন রাই-ই দিত অর্কর মেরুদণ্ডে। সারাদিনে দু’বার এই ইনজেকশন দিতে হতো। সকালে একবার দিয়ে রাই অফিস যেত। আবার সন্ধ্যায় একবার দিত। আসলে অর্কর চিকিৎসা করাতে গিয়ে ধনে- প্রাণে শেষ হয়ে গিয়েছিল অর্কর পরিবার। তাই শেষটায় আর নার্সিং হোমের খরচ কুলান করতে পারছিল না রাই। আর তাছাড়া কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি নেবার কোনও ক্ষমতাই অর্কর শরীরে ছিলনা। তাই শেষে অর্ককে নার্সিংহোম থেকে বাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল রাই। এই ভেবে যে কটা দিন বাঁচে বাড়ির লোকের সাথেই থাকুক সে। কিন্তু অর্কর জীবনের এই ভয়াবহ অবস্থা রাইকে একপ্রকার পাগল করেই তুলেছিল। তাই সে মরিয়া হয়ে উঠেছিল অর্ককে এই বীভৎস যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার জন্য।
অফিস থেকে ফিরেই রাই ঘড়িতে দেখল আটটা বাজে। আজ ফিরতে তার একটু দেরিই হয়ে গেছে। ছোট্ট তৃষার বায়না মেটানোর জন্য রাই বাড়ি আসতেই তার শাশুড়ি মা ছোট্ট তৃষাকে নিয়ে পাশের বাড়ি সত্যনারায়ণ পূজোতে গেলেন। কিন্তু এ কি? এ কোন অর্ক কে সে দেখছে? আজ অর্কর শরীরের যন্ত্রণা এতই তীব্র যে সে একটু শুতে পর্যন্ত পাচ্ছে না। সাথে শ্বাস কষ্টের কারণে বিছানা থেকে সমস্ত জিনিস মাটিতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে সে। চোখ দু’টো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে এক্ষুণি তার। কিন্তু প্রাণ পাখির বড্ড মায়া। তাই সে খাঁচা কেটে উড়তে চেয়েও উড়তে পারছে না। রাইও হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। অর্ককে ইনজেকশন দেওয়ার সময় হয়ে গেছে এমনিতেই। রাই আজ মরফিনের ডোজটা বাড়িয়ে অর্কর শরীরে ভরে দেবে বলেই মনস্থির করল, কিন্তু তার হাত কেঁপে উঠল। বুকের ভিতর হাজার দামামা বাজতে লাগলো, হৃৎপিণ্ডটা এক লহমায় ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইল তার। রাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো অর্কর বুকে। অর্কও শিশুর মত কাঁদতে থাকে তীব্র যন্ত্রণায়। ভালোবাসার মানুষের এত যন্ত্রণা, এত কষ্ট আর সহ্য করা যায়না। সে এবার নিজেকে শক্ত করলো আর মনে মনে বলল ‘আমাকে পারতেই হবে।‘ রাই মরফিনের ইনজেকশনের শিশিটা হাতে নিল, ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা শক্ত করে ধরল আর পরিমাণের থেকে তিনগুণ মরফিন ঢুকিয়ে দিল অর্কর শরীরে। এরপর শুধুই অপেক্ষা। মাটিতে ধপ করে বসে পড়লো রাই। ভাবলেশহীন অবস্থায় কতক্ষণ সে বসে ছিল তা সে নিজেও জানেনা। সম্বিত ফিরে এলো যখন, তখন সে কাঁপা হাতে অর্কর কপালে হাত দিয়ে দেখল বরফের মত ঠাণ্ডা তার দেহ। পালসও স্তব্ধ হয়ে গেছে। মাটিতে ধপ করে পড়ে সংজ্ঞাহীন হয়ে গেল রাই।
যখন জ্ঞান এলো অর্কর দেহ তখন ফুলে ফুলে ঢাকা। একটুও কান্না পাচ্ছে না রাই’এর। কি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে অর্ক। আজ আর কোনও যন্ত্রণা নেই, তীব্র কষ্ট নেই। একেবারে স্থির হয়ে গেছে রাইও। কতটা ভালবাসলে যে ভালবাসার মানুষকে মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া যায় তা শুধুমাত্র সেই জানে।
আজ মহা সপ্তমী। পূজো এসেছে তার নিয়ম মেনে। ছোট্ট তৃষার গলার আওয়াজে আবার উঠে দাঁড়ায় রাই। অত্যন্ত সন্তর্পণে আলমারিতে লুকিয়ে রাখে মরফিনের খালি শিশিটা। না, কোনও অপরাধবোধ কাজ করেনা রাই’এর মনে। সে মনে মনে শুধু এটুকুই ভাবে.. বড্ড ভালবাসত সে অর্ককে। অর্ক আজও তার জীবনের গোটা আকাশ জুড়ে বিরাজমান। অর্ককে সে মেরে ফেলেনি কখনই, তাকে এক আকাশ মুক্তি দিয়েছে বাঁচবার জন্য।
সমাপ্ত।
valo galo