ক্যানভাসে আঁকা ছবি
-অঞ্জনা গোড়িয়া
আকাশ ভরা শরতের মেঘ। কেমন নাচতে নাচতে চলেছে এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। মাঝে মাঝে ঘন কালো মেঘমূর্তি দোলা পাকিয়ে গর্জন করছে। মনে হচ্ছে এ যেন মহিষাসুরের হুংকার ধ্বনি। প্রস্তুতিপর্ব চলছে স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধে। আমার দেবী মা’ও রণমূর্তি ধারণ করে অপেক্ষায়। আসুক দেখি একবার সম্মুখে।
কাশের দোলায় মাথা নেড়ে আগাম জানান দিচ্ছে, আমি আসছি। ভয় নেই তোদের। এমন দৃশ্যেরই ছবি আঁকতে এসেছে অনিরুদ্ধ। চেনা সেই ময়নামতির মাঠটায়। ছোট বেলায় কত খেলাধূলো করত এই মাঠে। সব মনে পড়ছে আজ। অনিরুদ্ধ বেশ কয়েক বছর পর কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরেছে। এখন সে বিখ্যাত চিত্র শিল্পী। কলকাতায় বিরাট এক প্রদর্শনী হবে। তাই সে ফিরে এসেছে গ্রামে। নতুন কিছু সৃষ্টি করতে। হাতের জাদুতে। অনিরুদ্ধ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দূরে।
কি অনাবিল সৌন্দর্য! দেখে আর চোখ ফেরাতে পারে নি। চেয়ে আছে ওই লাল গরুটার দিকে। সাদা কালো ছোপের বাছুরটা দুধ টেনে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাম্মা বলে ডাকছে। নিঃসৃত দুগ্ধে যে তার পেট ভরে না । কি করে ভরবে? আগেই নিঙড়ে বের করে নেওয়া হয়েছে সমস্ত দুধ তার শরীর থেকে। ঠিক তার পাশেই কদম গাছের তলায় বসে আছে এক রমনী। নিশ্চিন্ত মনে কোলের শিশুটিকে স্তন পান করাচ্ছে। মুখটা ম্লান। যেন ঘন কালো মেঘের আস্তরণে ঢাকা। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। রং তুলিটা বের করে আপন মনে এঁকে চলেছে সেই ছবি। দুই মায়ের দুগ্ধ পানের ছবি। রমনীর কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কিছুক্ষণ পর চোখ ফিরে তাকালো রমনী। দেখল দূর থেকে তাকে। কোনো এক অচেনা ছেলে তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আর কি যেন করছে। ততক্ষণে সে সাবধানী হয়ে গায়ের শতছিন্ন কাপড় দিয়ে ঢেকে নিল নিজেকে। কোলের ছেলেকে বুক থেকে সরিয়ে বুকে তুলে নিল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ালো। জোরে কেঁদে উঠলো শিশুটি খিদের তাড়নায়। রমনী রেগেমেগে ছুটে এল ছেলেটার দিকে।
লজ্জা করে না তোমার? আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছো। কি আছে দেখার আমাকে? দেখছো না ছেঁড়া কাপড় পরে আছি। ছেলেটাকে একটু দুধ খাওয়াচ্ছি। সেই দিকে হাঁ করে চেয়ে আছো?
একটুও শান্তি দেবে না?
যেখানেই যাই, পুরুষের হাতছানি।
শরীর দেখতে এত সুখ? দেখবে আমার শরীর। টান মেরে খুলে দেব শাড়িটা? দেখো আর আঁকো।
কিন্তু টাকা চাই আমার। বুঝলে, অনেক অনেক টাকা। দিতে পারবে তুমি? বলো দিতে পারবে? এক নিঃশ্বাসে বলে গেল গাঁয়ের বধূ।
অনিরুদ্ধ, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে, রঙ তুলি ফেলে। ছবিটা এখনো অসম্পূর্ণ। উত্তর দেবার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।তবু শান্ত স্বরে বলল, আমি একজন শিল্পী। ছবি আঁকি প্রকৃতির। ছবি আঁকি স্নেহমহী মায়ের। স্নেহমহী দেবী মায়ের। শরীরের ছবি আঁকি না দিদি।
রমনীর বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়ল আকাশ বাতাস। পারবে তুমি বাঁচিয়ে দিতে আমার এই কোলের শিশুটিকে? ডাক্তার বলেছে এর হার্ট ফুটো। অপারেশন করতেই হবে। কোথায় পাবো এত টাকা? মাতাল বরটা জুয়া খেলে সব নিঃস্ব করে দিয়েছে। তবু স্বাদ মেটে নি। আরও আরও টাকার নেশায় ছেলেটার দিকে ফিরেও তাকায় না। গাঁয়ের প্রধানের কাছে গেলাম কিছু সাহায্যের জন্য। তাঁর লকলক করছে জিভ। বলল, রাতে আসিস আমার ঘরে। সব পেয়ে যাবি। বিপদ জেনেও গিয়েছিলাম। আমার যে টাকা চাই। শরীরটাকে শুষে নিয়ে বের করে দিল ঘর থেকে। বলল, আবার কাল আসিস একবার, দেখি কি করতে পারি? আমার শিশুটা মরে যাবে। আমার আর শরম নেই গো। কবেই মরে গেছে সব নাক-লজ্জা। বেঁচে আছি শুধু এর জন্য। তুলবে ছবি উলঙ্গ নারীর। আমি তাতেও প্রস্তুত। টাকা চাই, অনেক টাকা। আমরা কি এভাবেই মরব?
অনিরুদ্ধ, শাড়ি দিয়ে ঢেকে দিল তার সারা শরীর। আমি এই গাঁয়েরই ছেলে দিদি। জানি না তুমি কে? তবু আজ থেকে আমি হলাম তোমার ভাই। এমন করে ভায়ের কাছে বলতে নেই। চলো, ওকে আগে ভর্তি করাই হসপিটালে।
এই অসমাপ্ত ছবিই প্রদর্শন করল অনিরুদ্ধ। ক্যানভাসে আঁকা এক মায়ের বেদনার ছবি। দারুণ ভাবে সাড়া পেল। নিলামে উঠল। বিক্রি হলো প্রায় ৫০ হাজার টাকায়। তুলে দিল দিদির হাতে। আমার আঁকা আজ সার্থক দিদি।
দূর থেকে শোনা যাচ্ছে সেই গান, দুর্গা দূর্গতি নাশিনী…