এক অন্যধরনের দুর্গাপুজো
-সৈকত সরদার
সে অনেক বছর আগের কথা, ছোটবেলার কোন কথাই এখন ওর মনে পড়ে না। অবশ্য ও তো এখনও ছোটই। কতই বা বয়স হবে, সেটাও জানে না ঠিক করে। মোটামুটি সবকিছু যখন বুঝতে শিখল, তখন ও দেখে যে ও রাস্তায়, বাটি হাতে বসে আছে, যার যা মনে হচ্ছে দিয়ে যাচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারল না ও কে?এখানেই বা কি করছে? পাশের লোকগুলো জানিয়ে দিলো ও নাকি ভিখারি। পথচলতি মানুষ যা দেবে তাই দিয়ে ওকে পেট চালাতে হবে। প্রথমটাই মেনে নিতে কষ্ট হলেও পরের দিকে সয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা।
যাই হোক এভাবেই দিন চলছিল। কিন্তু ভালো লাগত না ওর এভাবে লোকের হাত পেতে টাকা নেওয়া। লোকের ওর দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকানো। কিন্তু কিছু করারও ছিল না। গত বেশ কয়েকটা দুর্গাপুজতে ও দেখেছে ওর বয়সি ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের হাত ধরে ঘুরতে যায়, জামাকাপড় কিনতে যায়, আরও কত কিছু। আর ও খালি নিজের বাবা মায়ের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু মনে করতে পারে না। খুব ইচ্ছে করে অন্যদের মত করে পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ইস্কুলে যেতে, বন্ধুদের সাথে হই হই করে বাড়িতে ফিরতে, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করতে কিন্তু ও বোঝে এসবই ওর কাছে স্বপ্ন, না পূরণ হওয়া কিছু ইচ্ছে। জীবন ওকে এত কম বয়সেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে ওর এসব পাওয়ার অধিকার নেই। তাই ও আর এসব ব্যাপার নিয়ে ভাবে না। কি হবে এসব নিয়ে ফালতু ভেবে, যার নিজের জন্মেরই কোন পরিচয় নেই, তার এসব ভেবে লাভ নেই, তার চেয়ে বরং বাটিটা নিয়ে স্টেশনে গিয়ে বসলে কিছু হয়ত আসতে পারে তাতে অন্তত একটা বেলা পেট চলে যাবে। এইসব ভেবে ও নিজের বাটিটা নিয়ে বসে পড়ে।
সেদিন একটু অন্যরকম ঘটনা ঘটল। সবাই ইচ্ছেমত কিছু দিয়ে চলে যায়। কিন্তু সেদিন একজন মাঝবয়সি মহিলা একটা দশ টাকার নোট দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। তিনি ওকে ওর নাম জিজ্ঞাসা করলেন। ও কিছুই বলতে পরল না। কি করে বলবে ও তো আর নাম জানে না। সেদিনকার মত মহিলাটি চলে গেলেন। পরের দিন আবার আসলেন। আবার ওর সাথে কথা বললেন, রোজই আসেন, রোজই ওর সাথে গল্প করেন। ওরও বেশ ভালোই লাগে মহিলার সাথে কথা বলতে। তিনি ওকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন গল্প বলেন, ছবি দেখান। অনেক কিছু শেখান। এভাবেই চলে এলো আরও একটা দুর্গাপুজো।
একদিন গল্প করতে করতে মহিলাটি বলেন, “যাবি তুই আমার সাথে?”
ছেলেটা অবাক, “কোথায় যাব?”
“কেন, আমার সাথে যাবি। আমার বাড়ি যাবি, আমার ছেলে হয়ে।”
“কিহ? আমি আপনার ছেলে হলাম কি করে?”
“কেন হতে পারবি না?”
ও ভাবল এক মুহূর্ত। এরকমই একটা জীবন তো সে চেয়ে এসেছে সব সময়। নিজের মায়ের মুখ ওর মনে পড়ে না। তায় এতদিন মা দুর্গাকেই নিজের মা মনে করে আবদার করে এসেছে একটা ভালো জীবনের। তাই হয়তো দুর্গা মা নিজেই তার কাছে মা পাঠিয়ে দিয়েছে। এইসব ভাবতে ভাবতে তার সম্বিত ফিরল ভদ্রমহিলার ডাকে।
“কি রে? কি ভাবছিস? যাবি না আমার সাথে? ডাকতে পারবি না আমাকে মা বলে? দিতে পারবি না আমাকে তোর নিজের মায়ের জায়গাটা?”
ও আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। দু’চোখ ভরা জল নিয়ে ওর নতুন মায়ের কোলে ঢোলে পড়ল। শুরু হল ওর জীবনের নতুন পথ চলা। এই দুর্গা পুজোটা ওর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ ও যে এই পুজোতে সব থেকে বড় উপহার পেয়েছে, একটা আসল মা পেয়েছে, যার কাছে ও ওর জীবনের সকল আবদার এক নিমেষে ও নির্ভয়ে বলতে পারে।