Site icon আলাপী মন

গল্প- চামচিকে

চামচিকে
– সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

কি সর্বনাশ। যে ভয় পাই ঠিক সেটাই হলো। ওরে কমলা, কোথায় গেলি রে, শিগগির আয়।
কমলা এ বাড়ির পুরনো কাজের বউ। অনেকদিন থাকার ফলে প্রায় নিজের লোকের মতো হয়ে গেছে। কুটনো কোটা ফেলে কমলা দৌড়ে এলো, গিন্নির ঘরে।
কি হয়েছে গো মা।
গিন্নি ভয়ে আধমরা। চোখ মুখ কুঁচকে ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠলেন,,
ঝাঁটাটা নিয়ে আয় না তাড়াতাড়ি। চামচিকে ঢুকেছে ঘরে, দেখতে পাচ্ছিস না, কানা।
তাইতো… কালো কুচকুচে একটা বিগ সাইজ চামচিকে, ঘরের এ দেওয়াল থেকে ও দেওয়াল পাঁইপাঁই করে মস্তানি করে উড়ছে।গোঁত্তা মেরে কখনো নিচের দিকে নামছে, আবার ফরফর করে ওপর দিকে। হেলিকপ্টার। গিন্নি খাটের কোনায় জড়সড় হয়ে বসে, চামচিকের সার্কাস খেলা দেখছে আর মুখে হুশহুশ আওয়াজ করতে করতে ডান হাতটা তাড়াবার ভঙ্গিতে ছুঁড়ছে।

বাগবাজারের দু’শো বছরের পুরনো বিশাল অট্টালিকা। সেই জৌলুশ আজ আর নেই। শরিক অনেক। কেউ কারোর খবর রাখেনা। নিজের অংশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পারলে রাখো। সম্ভব নয়। এই সাবেক বাড়িতে হাত দিতে গেলে, কোমরের জোর চাই, ট্যাঁকের জোর চাই। নেই, সুতরাং মেরামতের অভাবে চারিদিকে ফাটল ধরেছে।
সেই ফাটলের ফাঁকফোকরে চামচিকেদের খাসা বাসা। দিনের বেলা চুপচাপ, কিন্তু সন্ধ্যের মুখে ওদের তেজ দেখানো শুরু হয়। তাই সন্ধ্যের আগেই গিন্নি বারান্দার দিকের দরজা জানালা রোজ বন্ধ করে দেন। যেদিন কোনও কারণে ভুল হয়ে যায়, সেদিনই এই ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে। আজও সেই ভুল হওয়া দিন।

কমলা এখন ঝাঁটা হাতে মা শীতলা। ঝাঁটা তো নয়, যেন ভীমের গদা। আস্ফালনের ঘুরপাক। আয় আয় ওরে পাষন্ড, ঝাঁটাঘাতে করিব তোরে নিকেশ।
চামচিকে কম যায় না। ঠিক ঝাঁটাকে ডজ করে মারাদোনা ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কমলার জেদ ততই বাড়ছে।
মা তুমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াও তো একটু । দেখাচ্ছি ব্যাটাকে মজা। কমলা শাড়ীর আঁচল কোমরে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো। সারামুখে রণচণ্ডী ভাব। দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধংদেহী।
এইবারে খেলা জমেছে। চামচিকে মারতেই হবে। ওর শেষ রাখা নিরাপদ নয়। ব্যাটারা ঘাঁজেঘোঁজে সেঁধিয়ে যায়। রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পরলে, সুড়ুৎ করে বেড়িয়ে খেল দ্যাখাতে শুরু করে। সে বড়ো ভয়ংকর ব্যাপার। ভ্যাম্পায়ারকে বিশ্বাস করতে নেই।
গিন্নি দরজার বাইরে থেকে উৎসাহ সাপ্লাই দিচ্ছে…
ছাড়বিনা কমলা, মার ব্যাটাকে মার..।

হাইস্পিড পাখা চলছে। মনে আশা, যদি ঘুরন্ত পাখার ব্লেডে ধাক্কা খেয়ে অক্কা পায়। ভাবা যায় না। কি অসম্ভব দক্ষতায় সে বাধা অবলীলায় পেড়িয়ে যায়, কমলা অবাক হয়ে বলে , কি সেয়ানা গো…!
ব্যাটা সবদিকে যাচ্ছিস, দরজার দিকে যাচ্ছিস না কেন? বেড়িয়ে যা, নইলে মরবি। কে কার কথা শোনে। হুমকি কোনো কাজেই এলো না। চামচিকে যেন খিলখিল করে হাসছে আর উড়ছে। ক্ষুদ্র প্রাণীর এ হেন তাচ্ছিল্য অসহ্যকর। মানুষের বোধহয় এটাই স্বাভাবিক স্বভাব। তাচ্ছিল্য অসহ্য। সব সহ্য করা যায়, তাচ্ছিল্য কিছুতেই নয়।
যুদ্ধ চলছে। কমলা বনাম চামচিকে, রেফারির ভূমিকায় গিন্নি।
হারেরেরেরেরেরে…..

এবার মঞ্চে কত্তার প্রবেশ। পাশের ঘরে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে চলে এসেছেন। হাতে দু’ভাঁজ করা খবরের কাগজ।
উড়ন্ত চামচিকের দিকে চোখ রেখে, কমলাকে বললেন সরে যা। ভাবখানা এমন, যেন, কমলাকে বলছেন, দেখে শিখে নে, কি ভাবে চামচিকে জব্দ করতে হয়। যেন বোলার বদল হলো, সেট ব্যাটসম্যানকে আউট করতে হবে।
গিন্নির গলায় অনাস্থার সুর…
থাকনা ও করছে তো… তুমি পারো নাকি…হাঁটুতে ব্যাথা..
কত্তা শত্রুপক্ষের চালচলন গতিবিধি শনাক্ত করে নিলেন, তারপর ভাঁজ করা খবরের কাগজখানা বাগিয়ে ধরলেন, ব্রুশ লি’র ভঙ্গিমায়। আয় বাছাধন, দেখাচ্ছি মজা।

চামচিকে যেন টের পেয়েছে, প্ল্যান নাম্বার টু ফিল্ডে নেমেছে। বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী। কত্তার কপাল লক্ষ্য করে ফরফর করে উড়ে আসছে। একেবারে হাতের কাছে। কত্তা কাগজ চালালেন, একেবারে ক্রিশ গেইল স্টাইল। ছক্কা। একঘায়ে বাজিমাৎ। দাপুটে চামচিকে পাখা গুটিয়ে মেঝেতে কাৎ। ভবলীলা সাঙ্গ।
সামান্য নীরবতা। কমলা তালি বাজিয়ে ধেইধেই করে নেচে উঠলো…মরেছে মরেছে…
কত্তার ঠোঁটে যুদ্ধ জয়ের বাঁকা হাসি। আড়চোখ গিন্নির দিকে।

গিন্নী এতক্ষণ দমবন্ধ করে ছিলেন। হাঁফ ছেড়ে বললেন, ওফ, বাবা..কমলা আগে দরজা জানালা বন্ধ কর।
কত্তা আবার পাশের ঘরে ফিরে চললেন। চলার ভঙ্গিতে, সেঞ্চুরি নট আউট, উইন।

পিছন থেকে গিন্নী বললেন,
একতলার ভাড়াটেটাকে কবে তাড়াবে? সাত মাসের ভাড়া বাকি। রোজই তো আজ দেব কাল দেব করে, অথচ নেশাভানের কামাই নেই। রোজ চিৎকার চ্যাঁচামেচি। এতো ভারী জ্বালায় পড়লুম।
ওই ভাড়াটে চামচিকেটাকে তাড়াও দেখি।
কত্তা আলতো গলায় বললেন, হবে হবে,
সব হবে। ঠিক সময়ে হবে।
কত্তা ঘরে ঢুকে গেলেন। গিন্নী দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
মুরোদ জানা আছে। চামচিকে মারা ব্যাটাছেলে, নেতার কাছে ভিজেবিড়াল, যত্তসব।

Exit mobile version