তুমি রবে নীরবে
-বিকাশ দাস
বিকেল বেলা কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছি। রাস্তায় আসতেই ঠিক সেই মুহুর্তে পিছন থেকে মেয়ের গলায় কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ভাবছি এমনি করে কে ডাকছে আমায়? আমার আশেপাশে কাউকে তো দেখতে পাচ্ছিনা। মেয়েটার কণ্ঠস্বর ক্রমশঃ আমার দিকে ভেসে আসছে। ভাবছি কে আবার আমায় ডাকছে? না না অন্য কাউকে ডাকছে হবে হয়তো। আমার তো কোন মেয়ে বন্ধু নেই। আমি নিজের মতো করে হেঁটে চলেছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। বেশ সুন্দর দেখতে। গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা। পড়নে তুঁতে রঙের শাড়ি। ম্যাচিং ব্লাউস। কপালে ছোট্ট লাল বিন্দি। সুশ্রী আর মিষ্টি। দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের মেয়ে।
মেয়েটি দুম করে আমার সামনে এসে বলল, কি মশাই? শুনতে পাচ্ছেন না? আপনার নাম ধরে এতো করে ডাকছি আর আপনি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে হন হন করে চলে যাচ্ছেন? আপনার নাম তো আভাস?
– হ্যাঁ, আভাস।
– মশাই, আভাস নন্দি।
– হ্যাঁ,আপনি কি আমাকে চেনেন?
– আলবৎ চিনি।
– আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছিনা।
– আপনি আমায় কি করে চিনবেন, মশাই?
আমি তো একবারে আকাশ থেকে পড়লাম। মেয়েটি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলল।
– আপনি ছাড়া আপনার চারপাশে কে আছে বলুন তো?
-আচ্ছা ঠিক আছে। বলুন কি প্রয়োজন। কেন ডাকছিলেন?
-আপনি তো এই কলেজে পড়ান?
-হ্যাঁ, পড়াই, কেন বলুনতো?
– এতো কেন কেন করেন কেন বলুন তো? আপনাকে বাড়িতে অভি বলে ডাকে, তাইতো!
-হ্যাঁ, তাই। আমার ডাক নাম। আপনি এতো কিছু জানলেন কি করে?
– আপনার বাবা এখানে থাকেন না। আপনি আপনার মায়ের সঙ্গে গড়িয়ায় থাকেন। আপনার মোবাইল নম্বরও জানি। বলবো?
– আচ্ছা ওসব ছাড়ুন কি দরকার বলুন। আমার একটু তাড়া আছে। মাকে ডাক্তার দেখানোর আছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন।
– মাসিমার আবার কি হলো?
– আপনি আমার মাকে চেনেন?
– হ্যাঁ, চিনি। আচ্ছা তাহলে কাল কথা হবে। আজ মাসিমাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিন। কাল না হয় কথা হবে।
যাক মায়ের কথা বলে মুক্তি পেলাম। আমি দ্রুত বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঘুরে লক্ষ্য করলাম মেয়েটি ঠিক আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি একটু মনে মনে ভয়ও পেলাম। আজকাল যা দিন পড়েছে কোনো মেয়ে কেমন বলা যায় না। কি ভাবে কাকে কখন ফাঁসিয়ে দিতে পারে। ওনাকে তো আগে কোনদিন কলেজে দেখিনি। আমাদের পাড়াতেও দেখিনি। হয়তো এ শহরে নতুন এসেছে। একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে উনি এতো কিছু আমার ব্যাপারে কি করে জানেন! আমার পরিবারকেও চেনে। মেয়েটির নামও জিজ্ঞাসা করলাম না। যাক এসব ভেবে লাভ নেই। বাসে বসে আজেবাজে চিন্তায় মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ভাবলাম এ ঘটনার কথা মাকে জানাবো। আবার ঠিক করলাম, না থাক মাকে পরেই জানাবো।
আজ রাত্রে ঠিক এগারোটার সময় আমার মোবাইল বেজে উঠলো। এই সময় আমি খেয়ে দেয়ে কালকের লেকচার ঠিকঠাক করি। একটু আধটু গান শুনি। রাত্রি বারোটায় শুয়ে পড়ি। আননোন নম্বর দেখে কেটে দিচ্ছিলাম। বারবার ফোন বেজে যাচ্ছিলো। এতে রাতে আবার কার ফোন? ফোন তুলে বললাম।
– কে বলছেন?
ওপার থেকে মেয়ের কণ্ঠস্বর ।
– বা! এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? আচ্ছা মশাই আপনি। আমার গলা চিনতে পারছেন না? আমি সেই মেয়ে। আজ বিকেলে আপনার সাথে দেখা হলো। কথাবার্তা হলো।
– না, ঠিক বুঝতে পারছিনা।
– আচ্ছা আপনি বেশ তো মশাই! এতক্ষণ আপনার সাথে কথা বললাম এর মধ্যেই ভুলে গেলেন। আপনার মা, মানে মাসিমা অসুস্থ! কি এবার মনে পড়লো মশাই। আচ্ছা ঠিক আছে। আমার নাম অনামিকা। তখন আপনাকে আমার নাম বলা হয়নি। আগে বলুন মাসিমা কেমন আছেন?
– ভালো আছেন। কাজের কথা বলুন এতো রাত্রে কেন ফোন করেছেন? শুনুন, এ ধরনের আচরণ আমার পছন্দ নয়। আপনার কিছু দরকার থাকলে চটপট বলে ফেলুন। না হলে আমি ফোন রেখে দিচ্ছি।
– না না ফোন রাখবেন না। এরপর দেখলাম মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, আমি আপনার গান শুনতে চাই। একটা গান শোনান না?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম। শুনুন, আমি গান গাইতে পারিনা ।
– মিথ্যে কথা বলছেন? আমি জানি আপনি ভালো গান করেন।
– আপনি কি করে জানলেন?
– মশাই আপনি গান জানেন এতো সবাই জানে। বিশেষ করে রবীন্দ্র- নজরুল সংগীত। আমি আপনার গলায় গজলও শুনেছি। সত্যি দারুণ।
– দেখুন এ ভাবে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আপনি একজন মেয়ে হয়ে এতো রাতে এক অপরিচিত পুরুষকে ফোন করে বলছেন গান শোনাতে। আপনার একটু লজ্জা শরম বলে কি কিছু নেই।
যেই বলা মেয়েটি কান্না জুড়ে দিলো।
– আচ্ছা আপনি কাঁদছেন কেন? আমাকে কি ভয় দেখাচ্ছেন? কি ভেবেছেন আমি গলে পড়বো?
– আপনি যদি গান না শোনান, তাহলে আমি কিন্তু এক্ষুুুুণি আপনার বাড়ি চলে আসবো। আপনাকে জড়িয়ে ধরবো। বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেবো । আপনি আমায় ভালবাসেন।
– আপনি এসব যাচ্ছেতাই কি বলছেন?
– সত্যি বলছি। আমি সব করতে পারি।
মনে মনে ভাবলাম। না একটা গান শুনিয়ে দি। যদি ছাড়া পাই। এ তো দেখছি নাছোড়বান্দা মেয়ে। গান না গাইলে মুশকিল। ইচ্ছে করছিলো ফোনটা কেটে দিই। কিন্তু পারলাম না। ওনার জেদের কাছে হেরে গেলাম। এই বলে গান শুনিয়ে দিলাম । এবার ঠিক আছে? আমি ঘুমোতে যাচ্ছি। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। অনেক পড়াশোনা আছে।
– আর একটা গান প্লিজ। ওই গানটা ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম নিবিড় নিভৃতে পূর্ণিমানিশীথিনী সম’ জানেন এটা আমার খুব প্রিয় গান।
আমি এই গানটা শুনিয়ে দেবার পর বুঝলাম উনি খুব খুশী। গুড নাইট বলে ফোন ছেড়ে দিলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এমনি করে প্রত্যেক রাত্রে মেয়েটি আমাকে ফোন করতো গান শোনার জন্য। আমি গান শোনাতে বাধ্য হতাম। কথায় কথায় উনি ফোন করে বলতেন, জানেন আপনার গান না শুনলে আমার ঘুম আসে না। আমি রোজ একই কথা বলতাম কিন্তু ওনার উপর কোনো প্রভাব পড়তো না।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আচ্ছা আপনার বাড়িতে কেউ নেই। এতো রাত্রে ফোন করেন কেউ কিছু প্রশ্ন করে না?
মেয়েটির সোজাসাপ্টা জবাব,
-আজ্ঞে মশাই, আমি হোস্টেলে থাকি। সঙ্গে আমার এক বান্ধবী।
এবার সত্যি করে উনাকে ধমক দিয়ে বললাম,
-দেখুন এগুলো ঠিক হচ্ছে না। আপনি কি করেন, কেনই বা আমাকে ফোন করেন আপনি কি চান আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না।
– দেখুন আভাস বাবু। যতদিন এ শহরে আছি আপনাকে রোজ আমাকে গান শোনাতে হবে। আপনার গান না শুনলে আমার ঘুম আসেনা। আপনাকে কতবার করে বলেছি। এতে আপনার কোথায় অসুবিধে। আবার বলছি আপনি যদি গান না শোনান তাহলে যেদিন কলেজে আসবেন, আমি সকলের সামনে আপনাকে জড়িয়ে চিৎকার করে বলবো, আই লাভ ইউ। একেবারে হিন্দি সিনেমার মতো। তখন আমাকে দোষ দেবেন না। আমি রোজ রাত্রে শুধু এক দু’খানা গান শুনতে চেয়েছি। আর তো কিছু চাইনি।এতে আপনার মহাভারত অশুদ্ধ হবেনা। একটা মেয়ের জন্য এইটুকু করতে পারবেন না?
আমিও মনে মনে ভাবলাম যাক এই অজুহাতে আমার গান করা হয়ে যাবে। একটু আধটু রেওয়াজ হয়ে যাবে। সারাদিন কলেজ করে সময় পাইনা। কোনোদিন যদি টাকা হয় নিজের গানের এ্যালবাম বার করবো।
এই ভাবে প্রত্যক রাতে ওনাকে গান শোনানোর পর্ব চলতে থাকলো। অনেক গানের অনুরোধ থাকতো যেমন ‘সে দিন দু’জনে দুলেছিনু বনে’ / ‘চরণ ধরিতে দিওগো আমারে’ / ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’ / ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’…
রোজ রাতে ঠিক সময়ে ওনার ফোন আসতো। ঘরের কেউ জানতে না পারে বলে আগেভাগেই আমি আমার শোবার ঘরে চলে আসতাম। এই ভাবে প্রায় এক মাসের উপর চললো। আমিও ইতিমধ্যে তিক্ত বিরক্ত হতাম। রোজ ভাবি ওনাকে বলে দেবো কিন্তু সাহস কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নানান ভাবে আমার এই করে দেবে ওই করবে বলে আমায় জব্দ করতো। এই ভাবে ওনাকে রোজ গান শোনাতে হতো খুব রাগ হতো আমার। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতাম যে কবে এ ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পাবো। ছুটকারা পেলে বাঁচি।
আজ সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু আমার কলেজ যাওয়া খুব দরকার। স্নান খাওয়া সেরে অপেক্ষা করে আছি। বৃষ্টি একটু কমলে বেড়িয়ে পড়বো। টিপ টিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। ছাতা হাতে নেওয়ার আমার কোনদিনই অভ্যাস ছিলো না। আজও নিই নি । ছাতা না নেওয়ার জন্য মার কাছ থেকে অনেক বকুনি খাই।
এখন আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। কলেজের গেটের সামনে আসতে দেখলাম সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে। খুব দামি সালোয়ার কামিজ পড়ে। দেখতে অপূর্ব লাগছে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি পাটের ঝোলানো ব্যাগ। ব্যাগের সামনের দিকে রবিঠাকুরের দাড়িওয়ালা ছবি। চারপাশে নজর কাড়া আল্পনার নক্সা। আমি ওনাকে দেখেই নিজেকে আড়াল করে কলেজের ভেতরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। উনি ঠিক আমাকে ধরে ফেললেন। নিজেকে কিছুতেই ওনাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না।
মেয়েটির গলা ভেসে এলো।
– কি মশাই! আমাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা বলুন তো, আপনার আমি কি ক্ষতি করেছি? আপনি আমাকে দেখে দিব্যি এড়িয়ে যাচ্ছেন যে? নিশ্চিন্ত থাকুন আপনাকে প্রাণে মারবো না। একটু না হয় রোজ রাতে গান শুনতে চেয়েছি, এইতো। আরে বাবা আর তো ক’টা মাস তারপর এই শহর ছেড়ে চলে যাবো। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না।
খুব আগ্রহে মেয়েটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন।
– আসুন আসুন, বৃষ্টি জোরে পড়ছে। ও আপনি তো আবার ছাতা আনেন নি। শুনেছি আপনার ছাতা নিয়ে চলার অভ্যাস টভ্যাস নেই।
– আপনি এসব আবার কোথা থেকে জানলেন?
– ঠিক আছে। আসুন আমার ছাতার তলায়। আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন। কলেজের স্টাফরুমে যেতে যেতে একদম ভিজে জল হয়ে যাবেন। আসুন আপনাকে পৌঁছে দিই। আপনার তো আবার ঠাণ্ডা লাগার ধাঁচ আছে।
আমিও ভাবলাম। না উনি ঠিক বলছেন । আর কিছু না ভেবে অগত্যা ওনার ছাতার তলায় আমার মাথা গুঁজে দিলাম। উনি আমাকে স্টাফরুমের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। এটা সেটা নিয়ে উনি এতো বকবক করতে থাকলেন আর আমি হু হ্যাঁ করে কাটিয়ে দিলাম। শেষে ওনাকে ভদ্রতার খাতিরে থ্যাংকস বলে সোজা স্টাফরুমে চলে গেলাম।
জানিনা মেয়েটি আমার কাছ থেকে কি চায়। আমার বাড়ির সবাইকে চেনেন জানেন। ভাবলাম পরের বার দেখা হলে পুরো ব্যাপারটা জানবো। মেয়েটি ওনার নাম বলেছিলো অনামিকা। বাড়ির সবাই আদর করে অনু বলে ডাকে।
মেয়েটি বিনম্রতার সঙ্গে আমাকে জানালো,
– জানেন, আপনি এতদিনে যতো গান শুনিয়েছেন আমি আমার মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছি। আমি আপনার গান মন দিয়ে শুনি। শুনে শুনে গাইবার খুব চেষ্টাও করি কিন্তু হয়ে ওঠেনা। আমি গান গেয়ে রেকর্ড করে আপনাকে একটা স্যাম্পল পাঠাবো। শুনে বলবেন তো আমার দ্বারা গান গাওয়া হবে কি, না? আমি অবশ্য একটু আধটু কবিতা লিখি। বলতে পারেন এটা আমার শখ।
এমনি করে অজান্তে ওনার সাথে আমার বন্ধুত্ব বেড়ে উঠলো । একএক সময় ভাবতাম এতো মেলামেশা ঠিক নয়। হিতে বিপরীত না হয়ে যায়। ওনাকে বলেই দেবো, দেখুন প্রেম ট্রেমের মধ্যে আমি নেই। একদিন মেয়েটিকে বলেই দিলাম। মেয়েটি একটু গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো,
-বলে আবার প্রেম হয় নাকি? প্রেম তো হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বেড়িয়ে আসে। কেউ কি বলতে পারে প্রেম কখন, কবে কি ভাবে দু’জনের মনের মধ্যে দোলা দিতে পারে? আচ্ছা ওসব কথা বাদ দিন। সত্যি বলছি, আপনার গলার মধ্যে মাদকতা আছে। গাইবার এক বিশেষ সৌজন্যতা আছে যেটা সকলের ভালো লাগবে।
শুনুন, কাল বিকেলে মধু কাকার চায়ের দোকানে বসবো। আপনাকে আমার কিছু জরুরি কথা বলার আছে। আপনি তো মাঝে মাঝে অনুরোধ পেলে গানের ফাংশন করেন। এই পৃথিবীতে আমরা ঢের দিন বেঁচে থাকি মৃত্যুর ধ্বনি শুনে শুনে তার মধ্যে আনন্দ খুঁজে নিতে হয়। কি ঠিক বললাম তো?
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
– যাক এসব আপনার মাথায় ঢুকবে না।
আমি বললাম, এর আগে আমার গান কোথায় আপনি শুনেছেন?
– শুনেছি মশাই, শুনেছি। সব বলবো একদিন। ডু নট ওয়ারি।
আমি জেনে শুনেই বললাম। আমি ছোটবেলা থেকে গান শিখে এসেছি। ইচ্ছে ছিল বড় গায়ক হবো। কিন্তু বুঝতে পারতাম আমার অভাবের সংসার। গান গেয়ে কি আর সংসার চালানো যায়। বি এড করেছি। ইংলিশ নিয়ে এম এ করেছি। কলেজে পার্ট টাইম ইংলিশ পড়াই। যতোটুকু টাকা পাই তাতে কোনমতে মা ছেলের সংসার চলে যায়। যদি একটা পাকাপাকি ভালো চাকরি পাই। তখন গানের ব্যাপারে কিছু ভাবনা চিন্তা করবো।
দেখলাম মধু কাকার চায়ের দোকানে আগে থেকেই অনামিকা বসে আছেন। আমাকে আসতে দেখে উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
আসুন আসুন।
আমি বললাম, বলুন কি বলবেন? আমার তাড়া আছে।
– আচ্ছা মশাই। বেশি সময় নেবোনা। অনেক দিন আপনার সাথে দেখা হয়নি তাই আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হলো বলে এখানে আপনাকে ডেকে নিলাম। এক এক বার ভাবি আপনার বাড়ি গিয়ে আপনার সাথে আড্ডা মেরে আসি। আপনার মায়ের সাথে গল্প করে আসি। আপনার কোন আপত্তি নেই তো? থাকলে বলে দিন।
আমি একটু উঁচু গলায় বললাম। আচ্ছা বলুন তো, এতো মানুষ থাকতে আপনি আমার পেছনে পড়লেন কেন? আপনাকে দেখলে মনে হয় আপনি বেশ বড় ঘরের মেয়ে। অর্থবান পরিবার। অথচ এরকম ব্যবহার করছেন কেন আমার সাথে?
– হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আমার বাবার প্রচুর টাকা। সে তো বলতে পারবো না, কেন আপনাকে বিরক্ত করি। হ্যাঁ, শুনুন। যে কারণে আপনাকে এখানে ডেকেছি। এই নিন ভিজিটিং কার্ড। ইনি কে চিনতে পারলেন?
আমি হাতে কার্ড নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলাম কার্ডের উপর নাম লেখা আছে, সুনির্মল বর্মন। ইনার খুব নাম ডাক আছে। ইনি একজন নাম করা মিউজিক ডিরেক্টর।
– আজ্ঞে । ঠিক বলেছেন আভাস বাবু।
মেয়েটি উল্লাস ভরা হাসি নিয়ে আমার প্রতি অধিকার ফলাও করে বলে উঠলেন। কাল বর্মনদাকে ফোন করে ওনার সাথে দেখা করে আসবেন। ওনাকে আপনার ব্যাপারে সব ডিটেলসে বলা আছে। বর্মনদা আমার খুব পরিচিত । উনি আপনার গান শুনেছেন এবং খুব তারিফ করেছেন। আপনাকে দিয়ে কিছু গান গাওয়াবেন।
আমি ইতস্ততঃ হয়ে বললাম, কি বলছেন এতো বড় লোক। আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন না তো?
– আচ্ছা বলুন তো এতে আমার কি স্বার্থ থাকতে পারে? কাল দেখা করে বর্মনদা কি বললেন আমাকে জানাবেন। হ্যাঁ, আর ভুলবেন না আমি রোজ রাতে আপনাকে ফোন করবো আর গান শোনাতে হবে।
এই ভাবে মাস দু’য়েক রোজ রাত্রে ওনার পছন্দ মতো গান শোনাতে হতো। নিজেকে খুব খারাপ লাগতো কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম।
মাঝে মাঝে উনি আমাকে মধু কাকার চায়ের দোকানে আসতে বলতেন। অনেক সাবজেক্ট নিয়ে কথাবার্তা হতো। কিন্তু ওনার মাথার থেকে আমার গান শোনার ভুত কিছুতেই ছাড়াতে পারছিলাম না। রোজ ঘড়ির কাঁটা ধরে ওনার ফোন আসতো আর আমাকে গান শোনাতে হতো।
ওনার কথামত বর্মন বাবুর সাথে দেখা করলাম। আমার গান শুনলেন। গলার প্রশংসা করলেন। ইনি নিশ্চয় ওনার পরিচিত। না হলে আমাকে এতো কেন পাত্তা দেবেন। আমাকে কিছু গান দিয়ে বললেন, -প্র্যাকটিস করো। আগামী সোমবার আমার সাথে সকাল দশটায় দেখা করো। সেদিন রেকর্ডিং করবো আর অনামিকাকে বলে দিও। তুমি পাশ করেছো। একদিন তুমি খুব বড় গায়ক হবে যদি চেষ্টা চালিয়ে যাও।
তারপর কিছুদিন দিন কেটে গেলো। দেখলাম ওনার আর রাতে ফোন আসেনা। কলেজেও দেখা হয় না। মনে মনে বেশ নিশ্চিন্ত হলাম। এবার মেয়েটির জ্বালাতন থেকে রেহাই পেলাম। যেন খাঁচা ভেঙে খোলা আকাশ পেলাম। ওনার ফোন না আসাতে আমার ভালোই লাগছিলো। নিজেকে খুব রিলিফ মনে হচ্ছিলো।
সপ্তাহ খানেক যাওয়ার পর মনটা যেন কেমন কেমন করে উঠলো। অনেক প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো মনে। উনি আর কেন ফোন করেন না? ওনার আবার কিছু হলো নাতো? সারাদিন মনটা খচখচ করতো। কোন কাজে ঠিক ভাবে মন বসাতে পারতাম না। ভেতর ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। আজ হঠাৎ কেন এমন মনে হলো। আমি তো ওনার কাছ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলাম। তবে জীবনটা আমার অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে কেন? মনে হচ্ছিলো আমি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলছি ।
দিনের পর দিন ওনার ফোন না আসাতে আমার মন প্রচণ্ড চঞ্চল হয়ে উঠতো। রাতে ঠিক মতো ঘুমোতে পারতাম না। জানিনা কেন আমার কষ্ট হতো। কাউকে শেয়ারও করতে পারতাম না। মনে হতো আমার শরীর আছে কিন্তু প্রাণ নেই। তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। ভীষণ ভাবে ওনার অভাব ফিল করতাম। ওনাকে কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। রোজ রাতে ওনার ফোনের জন্য হাঁ পিত্যেশ করে জেগে থাকতাম। মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ছোটো মনে হতো। প্রতিদিন আহত হতাম ওনার কথা ভেবে। তবু মনে আশা রাখতাম একদিন না একদিন উনি ফোন করবেন। ওনার পছন্দ মতো গান শোনার জন্য আমার কাছে জেদ করবেন। আমাকে ভয় দেখাবেন। একবার মনে হতো ওনার কাছে যাই। ওনার খবর নিই। কিন্তু উনি কোথায় থাকেন তাও জানতাম না। এমন মূর্খ আমি। আমি চোখ বন্ধ করলে শুধু ওনার সঙ্গে কাটানো সময়গুলোর স্নিগ্ধ রাতগুলোর কথা মনে পড়তো। যদিও তখন সেই রাতগুলোতে ওনাকে গান শোনানো আমার কাছে খুব বিরক্তবোধ ছিলো। কখন যে ওনার সাথে আমার এক গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো আমি টের পাইনি। এখন বুঝতে পারছি সেগুলো ওনার আন্তরিক আচরণের বিবহলতা আমাকে এখন বেশ গ্রাস করছে। আমি কি শেষ পর্যন্ত এক অন্ধ বিবরের বাসিন্দা হয়ে থেকে যাবো? আমার যৌবনের উল্লাসের মদমত্ত আগল খুলে দাঁড়িয়ে আছি। আর ভাবতাম। উনি আসুক। আমাকে জড়িয়ে ধরুক। চিৎকার করে বলুক আমি আভাসকে ভালোবাসি। ওনার নিস্তব্ধ প্রণয়ের আঘাতে আমি বারবার রক্তাক্ত হওয়ার ইচ্ছে রাখতাম। যেন অবসন্ন হই। আলোর উৎসবে রাতের অন্ধকারে ওনার সঙ্গী হই।
মনকে জিজ্ঞেস করতাম কেন উনি এতোদিন আমার জীবনে এসে আমার গান শোনার জন্য উন্মাদ থাকতেন। আমার গান শুনতে না পেলে উনি রাতে ঘুমতে পারতেন না। আমার হৃদয় কি এতোই পাষাণ ছিলো যে সেই অনুভুতিটুকু বুঝতে পারিনি। উনি কি আমাকে ভালোবেসে ছিলেন? এই ভালবাসাবাসির অবুঝ খেলা আমি কেন বুঝতে পারিনি?
এই ভাবে মাস ছয়েক কেটে গেলো। ইতিমধ্যে দু’একটা বর্মন স্যারের গান গেয়ে আমার একটু নাম ডাক হলো। কলকাতা ও আশেপাশের গ্রাম শহর থেকে লাইভ শো পেতে থাকলাম। সিনেমারও এক দু’টো গান গাইলাম। আমার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। গানের চাপে কলেজের পার্টটাইম চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। গান গেয়ে ঘরে লক্ষ্মী আসতে শুরু করলো।
তবু আমার সেই অভ্যেসটা কিছুতেই গেলোনা রোজ রাতে মোবাইল চেক করাা ওনার কোন মিস কল আছে কি না। ওনার কোন মেসেজ আছে কিনা। একদিন হঠাৎ হোয়াট’স আপ দেখলাম উনি ওনার ছবি পাঠিয়েছেন। রাজকন্যার মতো লাগছিলো। সৌন্দর্য ফেটে পড়ছিলো। কপালে সূর্যডোবা টিপ। দু’চোখে উপলব্ধির কাজল। গলায় সোনার সরু চেন। ঠোঁটে সনির্বন্ধ হাসি। খোঁপায় ফুলের মালা। ছবির নীচে মেসেজ। ভালো থেকো। গান ভালোবেসে গেও। নিয়মিত রেওয়াজ করো। তোমার নাম যশ হবে। আমি তক্ষুনি ওনাকে ফোন করলাম কিন্তু ফোন সুইচড অফ। মনে খটকা লাগলো কেনই বা উনি ছবি পাঠালেন? কেনই বা ওনার ফোন সুইচড অফ। মনটা আরো আনচান করতে লাগলো। আমি ওনার সংস্পর্শের অন্তরঙ্গতা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম।
– অভি আজ তোর সময় হবে।
-কেন মা?
-তোর বাগুইহাটি বকুল মাসির কথা মনে পড়ে? তখন তুই খুব ছোটো ছিলিস।
-হ্যাঁ, একটু একটু মনে পড়ছে। তখন আমরা ওখানে থাকতাম। আজ সকালে ফোন করে বকুল জানালো। ওর মেয়ে নাকি খুব সিরিয়াস। শেষ শয্যায়। ওকে তুই দেখলে হয়তো চিনতে পারবি।
-কি হয়েছে মা তুমি কি কিছু জানো? শুনেছি ব্লাড ক্যানসার। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। হয়তো আর কটা দিন পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে।
মায়ের কথাটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্তেও মা’কে নিয়ে যেতে হলো।
আমরা বকুল মাসির বাড়ি গেলাম। মেয়েটিকে দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। ইনি তো সেই মেয়েটি। অনামিকাা- খাটে শুয়ে। চোখে মুখে উজ্জ্বলতার ঝলক নেই। যাকে এতোদিন খুঁজছিলাম। আমার চোখে পৃথিবী যেন বনবন করে ঘুরছে। ওনার কোন সাড়া শব্দ নেই। শীর্ণকায়া শরীর নিস্প্রভ।
অনামিকা আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে দু’চোখ এক দৃষ্টিতে চেয়ে। ঠোঁটে স্মিত হাসি। ওনার দু’চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু ঝরে পড়ছিলো। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো। আমি ডুকরে ডুকরে কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছিলাম না। আমার ইচ্ছে করছিলো ওনার সমস্ত সত্তাকে আঁকড়ে জড়িয়ে বলি। অনামিকা, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমরা দু’জন এক দু’জনের চোখের দিকে তাকিয়ে সবার অলক্ষ্যে অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বলছিলাম আর মনে মনে বুঝে নিচ্ছি্লাম পরস্পরকে এক দু’জনার চাউনির আকর্ষী মেখে।
মা আর বকুল মাসি এক দু’জনকে জড়িয়ে কাঁদছিলো। ডাক্তার অনামিকার এক পাশে দাঁড়িয়ে।
মৃত্যুর মাধ্যমে বোধহয় জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার অবসান হয়ে যায়। এ রোগের থেকে হয়তো আর মুক্তি পাবে না । মৃত্যুর আত্মহনের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। একদিন বাগানে সব ফুল ফুটবে মাধবীলতা জুঁই বেলি গোলাপ, গন্ধে ভরে দেবে আমার উঠোন বাড়ি। রাতের অন্ধকারে আলোর বৈধব্য রজনীগন্ধা জানাবে আমি আর বেঁচে নেই।
হাওয়ায় ভেসে আসছে অনামিকার কথার সংলাপের নিস্তব্ধতা আমার কানে।
– জানো? তোমার গান শুনে তোমার কথা স্পর্শ করে সহজে হয়ে গেছি তোমার মনের বাসিন্দা। পৃথিবীর সব সুখদুঃখ, ভালোবাসা, বিষাদ,বেদনা উল্লাস আজ কোন কিছুর আবেগের স্পর্শে রাখতে পারবেনা। আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বুঝিয়ে যাচ্ছিলো যে দূরে সরে থাকা বিরহ মাঝে মধ্যে মিলনের চেয়েও মধুর হয়ে ওঠে।
অনামিকা আমাকে দাঁড় করিয়ে উনি চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে থেকে গেলেন। অন্তরের কথা অন্তরে চেপে।
বছর দু’য়েক পর মাকে নিয়ে আমি মুম্বাই চলে আসি কলকাতার পাট চুকিয়ে। বারো বছর ধরে মুম্বাইতে আছি। কিছুদিন হলো মাও চলে গেলেন আমাকে ছেড়ে। অনামিকার ছবি বড় করে বাঁধিয়ে রেখেছি আমার শোবার ঘরে। রোজ রজনীগন্ধা ফুলের মালায় সাজিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করি। আমার শোকাস্তব্ধ হৃদয়ের আকুল আর্তি ওনার বকবকানি খুঁজে বেড়ায়। অস্থির অনুরণন। অনুচ্চার অব্যক্ত ব্যথা। বুকের ভেতর নিঃসঙ্গতার পাথর চাপিয়ে সঙ্গোপনে আজও রোজ রাতে অনামিকার ফোনের অপেক্ষায় থাকি হৃদয়ের নিভৃতে। জানি, উনি আর ফোন করবেন না। তবু অপেক্ষায় থাকি ।
সত্যি বলছি দাদা, আপনার এই অনন্য প্রতিভার কথা আমার জানা ছিলনা । অসাধারন একটা ছোত গল্প পড়লাম । লেখার মান অসাধারন । স্যালুট জানাই আরেক বার ।
তবে একটা কথা, গল্পের শুরুতে লিখলেন আজ রাত এগারোটায় কিন্তু তারপর অনেক দিনের কথা, অনেক বছড়ের কথা বলা হল, টেকনিক্যালি একটু দেখে নেবেন বিষয় টা । অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানবেন । ইতি আপনার অতি স্নেহের – পরিতোষ ।
বিকাশ, তোর এই প্রতিভার কথা অজানা ছিল ।
আশীর্বাদ রইলো, এগিয়ে যা ।
বিশুদা ।