গল্প

গল্প- সময়

সময়
-সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)

 

 

পুরীর সমুদ্র তটে বসে বসে বেহালা বাজাচ্ছে প্রত্যুষা। আজকাল ও পদবী বর্জন করেছে রীতিমত আইনের স্বীকৃতি নিয়েই। সব জায়গায় শুধু প্রত্যুষা লেখা শুরু করেছে। বেহালা সুর ভীষণ সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরী করেছে সমুদ্র তটে। দিনমনি আজকের দিনের মত তার রাঙা আভা চারিদিকে ছড়িয়ে বিদায় নিচ্ছেন। সমুদ্র এবং পশ্চিম আকাশ লাল আভায়িত। প্রত্যুষা সান্ধ্য রাগ বাজাচ্ছে চারিদিকে অপূর্ব এক সঙ্গীতময় পরিবেশ সৃষ্ঠি হয়েছে। এক একটা রাগ বাজানো শেষ হলে প্রত্যুষা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছে। আর সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। সমুদ্র যে তার খুব প্রিয়। নুলিয়াদের কাছ থেকে চেয়ার নিয়ে বসেছিল। খুব কাছে কারুর একটা অস্তিত্ব টের পেল প্রত্যুষা। কেউ একজন চেয়ার ভাড়া করে কাছেই বসেছে।
“কেমন আছ ভোর?” প্রত্যুষা চমকে উঠলো। এই নামে তাকে তো শুধু একজনই ডাকতো। পাশের চেয়ারে বসে প্রভাত। হ্যাঁ প্রভাত’ই তো।
“তুমি! বেড়াতে এসেছো?” খুব শান্ত গলায় বললো প্রত্যুষা।
“হ্যাঁ বেড়াতে!”। ভোর, তুমি কার সাথে এসেছো?”
“আমার সঙ্গীতের সাথে দেখছো না” বলে বেহালার দিকে তাকালো প্রত্যুষা।
“তুমি”?
”আমিও একাই বেড়িয়ে পরেছি”।
“এবার আমি উঠি, আমার হোটেলের ব্যালকনিতে বসে অনেক রাত পর্যন্ত আমি বেহালা বাজাই আর সমুদ্র দেখি। আমার ভাল লাগে। যাই।” প্রত্যুষার চলে যাওরার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো প্রভাত।
ব্যালকনিতে বসে সমুদ্র দেখছে প্রত্যুষা। বেহালাটা ঘরের বিছানায়। মন ফিরে ফিরে যাচ্ছে ফেলে আসা দিনগুলোতে।
“এই প্রত্যুষা আর কত স্নান করবি? চল চল এবার হোটেলে চল।”
“আরে দাঁড়াও না, আনন্দ করতে এসেছি এত তাড়া কিসের? আমি এখন ঢেউদের সাথে খেলা করছি এখন উঠবো না।” খুব খুব ভাল লাগে প্রত্যুষার সমুদ্রে স্নান করতে।
“আরে আবার ঝিনুক কুড়াতে লাগলি, ভিজা জামা কাপড়ে, ঠাণ্ডা লাগবে। চল চল।” “যাচ্ছিরে বাবা যাচ্ছি”। প্রত্যুষার এই প্রাণ চঞ্চলতা দেখে একজন খুব মজা পাচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিল, আমি যদি ওর হাত ধরে ঢেউয়ের সাথে লাফাতে পারতাম। হ্যাঁ, প্রথম দেখাতেই প্রত্যুষাকে ভালো লেগেছিল প্রভাতের। ধীরে ধীরে আলাপ পর্ব শেষ হ’ল। এরপর প্রভাত আর প্রত্যুষার ডুয়েট গান, জমজমাট আড্ডা এসব নিয়ে বেশ কেটে গেল কয়েকটা দিন। প্রভাতের বাবা মায়ের ও বেশ লাগলো প্রত্যুষাকে। ফিরে আসার দিন এসে গেল। ঠিকানা, ফোন নম্বর বিনিময় হ’ল। ঘটনাচক্রে দু’জনেই এক শহরের। প্রত্যুষার বাড়ি বর্ধমানে। আর প্রত্যুষ ওখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিল। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বেরে ওঠে।
প্রভাত বলে, “দেখো,আমাদের দু’জনের নামের মানে এক। আমরা দু’জনেই ভোর। আমি তোমাকে ভোর বলে ডাকবো”। বন্ধুত্ব প্রেমে পরিণতি পায়। প্রভাতের বাবা মা জলপাইগুড়ি থাকতো। আর প্রভাত কলকাতায় আই. টি. সেক্টারে চাকরি পায়। তাই প্রভাত চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে প্রভাতের বাবা মা দু’জনের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। প্রত্যুষার বাবা মায়েরও ছেলে খুব পছন্দ হয়। চারহাত এক হয়ে যায়।
প্রাণভরা ভালবাসায় দু’জনে দু’জনের জীবন ভরিয়ে তুললো।;মিষ্টি আদর, বেড়াতে যাওয়া সব কিছু নিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো তাদের দাম্পত্য। প্রতি বছর প্রত্যুষার জন্মদিনটা অনেক কাজের মধ্যেও মনে রেখে নতুন নতুন চমক দিত প্রভাত। অনেকটা সময় একসঙ্গে গানে গল্পে কাটাতো। অফিসের এতো চাপ সামলেও এতটুকু ক্লান্ত বোধ করত না। বিবাহবার্ষিকীর দিনগুলোতে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়তো। ওই বিশেষ দিনে কাজের চাপ থাকলে রবিবার উদযাপন করতো। গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবে, আগে থেকে প্রত্যুষাকে জানাত না প্রভাত। সেও এক মজাদার আনন্দময় চমক ছিল। ধীরে সব কিছু কেমন বদলে যেতে লাগলো। প্রভাত যেন ক্রমে দূরে চলে যেতে লাগলো। অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে যেত প্রভাত। প্রত্যুষা কিছু জিজ্ঞসা করলে কোনো রকমে সংক্ষিপ্ত হুঁ ,হ্যাঁ তে উত্তর দিত। প্রভাত চায়নি বলেই প্রত্যুষা চাকরি করেনি। নাহলে প্রত্যুষার যথেষ্ট যোগ্যতা ছিল। অথচ প্রভাত মাঝে মধ্যে বলতে শুরু করলো, “তুমি বড় আনস্মার্ট, আমার অফিসের মহিলা কলিগরা কত স্মার্ট। তারা ঘর অফিস দু’টোই কেমন সামলায়”। প্রত্যুষা আশা করেছিল, বিবাহবার্ষিকির দিন অন্তত প্রভাত ওকে একটু সময় দেবে। কিন্তু না প্রভাত শুভেচ্ছা জানালো না। রাতে ফিরে কোনোরকমে একটা হীরের দুল ধরিয়ে দিয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে পরলো। প্রত্যুষা বললো, “এসো আজকে অন্তত আমরা গানে গল্পে রাতটা কাটাই”।
“উফফ্, ঘ্যানঘ্যান কোরো না তো কাজ করতে দাও, দিয়েছি তো দামী উপহার সেটা নিয়ে খুশি থাকো।”
“কিন্তু আমি যে একটু সময় চাই তোমার থেকে, দামী উপহার নয়।”
“দামী শাড়ি, দামী গাড়ি কি দিই নি তোমায়?” “কিন্তু, আমি যে একটু সময়—-” কথা শেষ করতে না দিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয় প্রভাত।
একটা চিঠি লিখে রেখে চলে যায় প্রত্যুষা। পাঠিয়ে দেয় ডিভোর্সের ফর্ম। সময় বয়ে চলে করপোরেট জগতের উন্নতির শিখরে পৌঁছায় প্রভাত। কিন্তু বড় একঘেয়ে লাগে এই জীবন। প্রতিনিয়ত প্রত্যুষার অনুপস্থিতি টের পায় সে। প্রত্যুষাও স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়। ভোরবেলা সূর্যোদয় দেখতে এসেছে প্রত্যুষা। ভোরের রাগ বাজাচ্ছে। মুখে তার অপূর্ব প্রশান্তি। রাগ বাজানো শেষ করে ঢেউ এর উথাল পাথাল দেখছিল প্রত্যুষা।
“আচ্ছা ভোর আমাদের কি আবার মিল হয়ে যেতে পারে না? আমরা দু’জনেই তো একা এখন ও।”
“না, সেদিন সময়টা আমায় দিতে পারো নি আজ আর সেই সময় তোমার কাছ থেকে নেওয়া বা পাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আজ আমি আর তোমায় সময় দিতে পারবো না। আমার সময় জুড়ে এখন আমার গান বাজনা প্রকৃতি সবাই আছে। তাদের নিয়েই বাকিটা জীবন কাটাবো।” খুব শীতল অথচ কড়া গলায় বললো প্রত্যুষা। ধীর পায়ে হোটেলে ফিরে গেল। একবার ও পিছনে ফিরে তাকালো না। প্রভাত সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে পড়লো ইংরেজী সেই প্রবাদ‘ Time and tide wait for none’

Loading

Leave A Comment

You cannot copy content of this page