বিবেক দংশন
– পারমিতা ভট্টাচার্য
‘আচ্ছা মা আর কতদিন সহ্য করবে ওই পাগলীটার অত্যাচার? ওকে কোনও অ্যাসাইলামে পাঠানোর ব্যবস্থা তো করলেই হয়। বহু বছর তো হলো মা।’
কিছুটা রাগান্বিত গলায় রীণা কথাগুলো বলছিল তার মাকে।
‘পাগলী বলিস না। হাজার হোক ওতো তোর বোন।’
‘আমিও আর পারছি না মা। প্রতি দিন এতো মারধোর, অশান্তি আমিও আর সহ্য করতে পারছি না।’
রীণার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা বলল – ‘আমি বুঝি তোর জ্বালাটা। ওর জন্য তোরও একটা নিজের সংসার হচ্ছে না। যেই দেখাশোনায় আসে, সেই পাগলী বোন দেখে ফিরে যায়।’
টপটপ করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে রীণা বলল – ‘এবার তোমরা কাবেরীর একটা ব্যবস্থা করো মা।’
ইন্দিরা দেবী ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো রীণার দিকে।
কাবেরী জন্ম থেকেই পাগল নয়। সেও ছিল রীণার মতই সুস্থ, স্বাভাবিক একটা মেয়ে। যদিও সে কম কথা বলা, লাজুক স্বভাবের মেয়ে ছিল। লেখাপড়াতেও সে ছিল যথেষ্ট ভালো। পুজো করে পেট চালানো বাবা একটাও প্রাইভেট শিক্ষক দিতে পারেনি কাবেরীকে কোনও দিনই। তবুও মাধ্যমিকে দারুণ রেজাল্ট করে। পয়সার অভাবে সায়েন্স পড়তে পারেনি সে। তাই আর্টস নিয়েই ভর্তি হয়। এই সময়ই ঘটে যত অনর্থ। প্রাইভেট স্যারের সাথে তার মন পড়লো এক সূত্রে বাঁধা। অপূর্ব সুন্দরী কাবেরী ভেসে গেল আবেগের স্রোতে। স্যার তাকে কথা দিয়েছিল বিয়ে করবে বলে। এর পর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট পজেটিভ এলে কাবেরী খুশি মনে স্যার আনন্দ বাবুকে সব জানায়। তার পরেই ভোল পাল্টে যায় স্যারের। বনেদি বাড়ির ছেলে আনন্দ ভ্রষ্টা মেয়ে বলে অপবাদ দিয়ে স্কুলে সবার সামনে অপমান করে কাবেরীকে। এর পর বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়েও করে নেয় সে। কাবেরীকে ঠেলে দেয় ডাস্টবিনের অন্ধকারে। এই ধাক্কাটাই সামলে উঠতে পারেনি মৃদুভাষী কাবেরী। ঘরে-বাইরে অপমানিত হতে হতে একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে সে। না,ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তারা নিতে সক্ষম হয়নি। কারণ বড়োলোকদের পকেটের টাকা সকলের মুখ বন্ধ করতে সক্ষম। গরীব সনাতন বাবুদের মতো লোকেদের জন্য কোনও সাহায্যের হাতই সেদিন এগিয়ে আসেনি। আর আনন্দদের মতো লোকেরা তাই সমাজে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেরিয়েছে চিরকাল। মাঝখান থেকে শেষ হয়ে গেছে এই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারটি।
সে দিন রাতে প্রচন্ড ধ্বস্তাধ্বস্তির পর ইন্দিরা দেবী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবে আর চলতে পারে না। সারা রাত তার পাগলী মেয়েকে পাহারা কে দেবে দিনের পর দিন? একটু চোখের আড়াল হলেই সে পালিয়ে যায় এখান ওখান। তাই এর পর থেকে কাবেরীর ঠিকানা হলো একটা বদ্ধ ঘর। সারা দিন দরজা জানালা বন্ধ ঘরের মধ্যে ভ্যাপসা দুর্গন্ধের ছড়াছড়ি। এক পিঠ চুল ছিল কাবেরীর। এখন তা কাটতে কাটতে ঘাড় অবধি এসে ঠেকেছে। শুধুমাত্র খাবার দেওয়ার সময় আর ওষুধ খাওয়ানোর সময়ই বাড়ির লোকেরা তার ঘরে ঢোকে। কারণ, তার অমানসিক অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা বাড়ির লোকেদের আর নেই। এভাবেই মন্দের ভালো কেটে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলো। কিন্তু একদিন ঘটল বিপত্তি। একদিন কাবেরীর বাবা সনাতন বাবু তাকে খেতে দিতে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে ভুলে যায়। সেই সুযোগে কাবেরীও বেরিয়ে পড়ে ঘরের বাইরে, বাড়ির বাইরে….একেবারে সোজা রাস্তায়। যখন খোঁজ পড়লো তখন শূন্য ঘর। সারা দিন তার কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। পুলিশে নিখোঁজ ডায়েরি তারা করেনি। পাড়ার ছেলেরা সবাই দিন রাত এক করে খুঁজতে লাগলো কাবেরীকে। আত্মীয় স্বজনরাও খবর পেয়ে খোঁজ খবর নিতে লাগলো চারিদিকে। সে দিনটা এভাবেই কেটে গেল। পরের দিন ভোরে জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে পুকুর পারে ঝোপের ভিতর থেকে কাবেরীর সংজ্ঞাহীন প্রাণটা উদ্ধার করে বাড়িতে খবর দেয়। তখনও তার হৃৎপিন্ডটা সচল ছিল। যদিও ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত জামাকাপড় আর সারা শরীরে আঘাতের চিহ্নে তাকে চেনাই যাচ্ছিল না। কষ বেরিয়ে এসেছে রক্ত যা শুকিয়ে গেছে। সারা পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে সেই পুকুর পারে। তারই মধ্যে কিছুজন কাবেরীকে তুলে নিয়ে এলো বাড়িতে। কারোর বুঝতে বাকি রইল না ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছে।
কাবেরীর জ্ঞান আসতেই ইন্দিরা দেবী আর মাথার ঠিক রাখতে পারলো না। তার চুলের মুঠি ধরে বাড়ির উঠোনে নিয়ে এসে ফেললো। গায়ের যতটুকু জোর আছে তা সবটুকু প্রয়োগ করে চ্যালা কাঠ দিয়ে মারতে লাগলো তাকে। কাবেরীও কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে শান্ত হয়ে পড়ে। ইন্দিরা দেবীও দাওয়ার খুঁটি ধরে মাটিতে মাথা ঠুকে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওদিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় বাবা সনাতন বাবু জল নিয়ে একবার মেয়ের মুখে দেয়, একবার ইন্দিরা দেবীর মুখে দেয়। অবশেষে ইন্দিরা দেবী একটু ধাতস্থ হলে মনে মনে স্থির করেন – আর নয়। ভগবান যখন দেখেও বিচার করতে পারেন না তখন এ ঘটনার বিচার সে নিজেই করবে।
পর দিন সকালটা ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। সামনেই পুজো এসে গেছে। আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে কী যেন আনমনে ভাবছে ইন্দিরা দেবী। হয়তো রীণার আর কাবেরীর ছেলে বেলার কথা। কত খুশিতে ভরা ছিল এই সংসারটা। অভাব থাকুক, কিন্তু আনন্দের অন্ত ছিল না।
এক লহমায় কী ভাবে যে কী হয়ে গেল! এত খুশি চারিদিকে, অথচ কত বড় অন্ধকারের চাঁই এ পরিবারটির পাঁজরে পোঁতা হয়ে গেছে। কোথাও কোনও আনন্দ নেই, খুশি নেই। দু’ চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়েই পড়ছে ইন্দিরা দেবীর। অন্য দিন এতক্ষণে তাঁর ঠাকুর ঘরের কাজ সারা হয়ে যায়। আজ সে শিউলি তলা থেকে একটা ফুলও কুড়িয়ে ঠাকুরের চরণে দেয়নি। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে চলেছে – ‘ঠাকুর, এই তো তোমার বিচার।’
ক্রমে সে তার মনকে দৃঢ় করে। নিজেকে বোঝাতে থাকে….’এটা আমাকে পারতেই হবে।’
সে খুঁটিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রান্না ঘরে গিয়ে চা বসায়। ততক্ষণে বাড়ির সকলেই উঠে গেছে। সবাইকে চা দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে কাবেরীর ঘরে যায় সে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া প্রাণটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। ইন্দিরা দেবী কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। চা’টা কাবেরীর দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে তার হাতটা আজ একটু কেঁপে উঠল। বুকের ভিতর হাজার হাজার সর্প দংশন করে চলল। যেমনই হোক নাড়ি ছেঁড়া ধন তো তার। কিন্তু একাজ তাকে করতেই হবে।
সেদিন বাড়িতে কেউই ছিল না। কাবেরীর মা ছাড়া। রীণা সকালে কলেজ বেরিয়ে গিয়েছিল আর সনাতন বাবু গিয়েছিল একটু দূরে কয়েক ঘর যজমানের বাড়ি পুজো করতে। দুপুরে বাড়ি এসে কাবেরীর নিথর দেহ ঘরে দেখল তার বাবা। চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তার চিৎকারে পাড়ার সবাই এক এক করে বাড়িতে জমা হতে লাগলো। শুধু ইন্দিরা দেবী পাথরের মত বসে রইল দওয়ায় খুঁটি ধরে। আজ চোখের জল যেন বাষ্প হয়ে গেছে তার। গলা দিয়ে তার আর কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। শুধু একটা দলা পাকানো কান্না গলার মধ্যে আটকে আছে তার। সবাই জানলো, গতদিনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই মৃত্যু হয়েছে কাবেরীর। ইন্দিরা দেবী কাউকে কিচ্ছুই বলতে পারলো না। এমন কি বাড়ির লোকেদেরও না। শুধু বিবেক দংশনে পুড়ে ছাই হতে থাকলো তার মাতৃ হৃদয়। কী করে পারলো সে? এই একটা প্রশ্নই তাকে কুরেকুরে খেতে লাগলো। ঠাকুরের সামনে মাথা ঠুকে ঠুকে আজ কপালে তার গভীর ক্ষত। কিন্তু আজ আর ভগবানের কাছে তার কিছু যেন বলার নেই। কাবেরী মারা যাওয়ার পর থেকে ইন্দিরা দেবীও খাওয়া – দাওয়া ছেড়ে দেয়। কিছু দিনের মধ্যেই সে বিছানায় শয্যাগত হয়ে পড়ে। ডাক্তার বলে, শোক কাটিয়ে উঠতে না পারলে তাকেও বাঁচানো মুশকিল হয়ে যাবে। এমতাবস্থা সংসারের যখন, তখন রীণাকে পছন্দ করে পাত্র পক্ষ খবর পাঠায়। এ কথা কানে শুনে ইন্দিরা দেবী একটু সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু মনের যন্ত্রণা কাউকে বলতে না পারাটা যে কী কষ্টের তা ইন্দিরা দেবী বুঝতো। সেই অঘ্রাণেই রীণার বিয়ে হয়ে যায়। রীণার বিয়ের পর ফাঁকা বাড়িতে ইন্দিরা দেবী হাঁফিয়ে উঠতো সর্বক্ষণ। হার্টের প্রবল সমস্যা দেখা দেয়। মনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একদিন রাতে যে ঘুমের ওষুধ কাবেরীকে চায়ের সাথে খাইয়েছিল সে, সেই ওষুধই সে নিজেও খায়। তার পর সব শেষ। কী ভাবে একজনের ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে একটি পরিবার সমূলে শেষ হয়ে গেল এটা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।
সমাপ্ত।