গল্প- লার্নিং অ্যাপ

লার্নিং অ্যাপ
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

 

 

স্নেহা বরাবরের খুব ভালো স্টুডেন্ট। কিন্তু ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় তার রেজাল্ট আশানুরূপ হয় নি। অঙ্কে ও বিজ্ঞান দু’টো বিষয়ে নাম্বার বেশ কমেছে। তনুরুচি ম্যাম সবার সামনেই বলে ওঠে স্নেহার মাকে -‘একটু খেয়াল রাখুন মেয়েটার দিকে।’

স্নেহার মা সৌমি রিপোর্ট কার্ড নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে থেকেই তনুরুচি ম্যাম এর কথাই শুধু ভাবছে। সে তো স্নেহার খেয়াল রাখবে বলেই কোনদিন নিজের কেরিয়ারের কথা তেমনভাবে ভাবেনি। স্নেহার বাবা পুলক রায়। নামকরা ডাক্তার। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সারাদিন যে কত রকমের মানসিক রোগীদের কাউন্সেলিং করেন তার হিসাব নেই। চেম্বার থেকে ফিরে এসে সৌমির সাথে মাঝে মাঝে একটা দু’টো কেস হিস্ট্রি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে আজকাল পুলকবাবুও বাচ্চা থেকে কিশোর কিশোরী কিংবা যুবক যুবতীদের মানসিক রোগ নিয়ে বেশি চিন্তিত। প্রতিদিন চেম্বারে দশটা পেসেন্টের মধ্যে ছটা অল্প বয়সী রোগী।

স্কুল থেকে ফিরে এসে সৌমীর রান্না করতে ইচ্ছে করলো না আজ। তাই সে অনলাইনে থালি অর্ডার করে নিল। স্নান পূজো সেরে স্নেহার রুমে ঢুকে দেখে সে চুপচাপ জানলার দিকে চেয়ে বসে আছে। যে মেয়ে মোবাইল ছাড়া কিছুই চেয়ে দেখেনা, সে আজ বাইরের দৃশ্য দেখছে! স্নেহার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে, মাথার মধ্যে একটা চুমু খেয়ে সৌমি বলে-‘কি দেখছিস বাইরে?’মায়ের স্নেহ স্পর্শে স্নেহা পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে-‘মা, আমার রেজাল্ট কি সত্যিই এতটা খারাপ হয়েছে? একশোর মধ্যে অংকে ৭৮ ও বিজ্ঞানে ৮০পেয়েছি। এইটা কি খুব খারাপ মার্কস?’

সৌমি স্নেহার হাতগুলি নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে–‘মোটেই না। তবে তুমি তো খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট তাই টিচাররা তোমার কাছ থেকে হান্ডেট পার্সেন্ট আশা করে। ঠিক আছে, এবার স্নানে যাও। আমি কিন্তু তোমার পছন্দের থালি অর্ডার করে দিয়েছি।’

আধঘণ্টার মধ্যে ডোর বেল বেজে উঠল। পেমেন্ট করে খাবারটা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা মাত্রই মোবাইলটা বেজে উঠলো। মোবাইলের স্ক্রিনে ফুটে উঠল এক অচেনা নাম্বার। সৌমি হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে অপরপ্রান্ত থেকে বলে উঠলো- ক্যান আই স্পিক স্নেহা’স মাদার?
সৌমি বলল- ইয়েস, ইউ ক্যান স্পিক।

অপরপ্রান্ত থেকে বলে উঠলো- হান্ডেট পার্সেন্ট লার্নিং অ্যাপ থেকে বলছি ম্যাম। আপনি কি জানেন আপনার মেয়ে ওর অংকের জন্য আমাদের অ্যাপ ব্যবহার করে। আপনার মেয়ে তো নতুন ক্লাসে উঠলো। অংকে ওর পার্সেন্টেজ কেমন হয়েছে ম্যাম?
সৌমি শান্ত গলায় বলে উঠে-সেভেন্টি এইট পার্সেন্ট।
মেয়েটি বলে ওঠে- কম্পিটিশনের বাজারের জন্য যথেষ্ট কম নাম্বার তাই না। আপনি যদি ওর যথাযথ কাউন্সিলিং করান তাহলে কিন্তু ওর মার্কস ইম্প্রুভ হতে পারে। ম্যাম আমাদের ‘হান্ডেট পার্সেন্ট’লার্নিং অ্যাপ থেকে অভিজ্ঞ টিচার আপনার বাড়িতে গিয়ে আপনার মেয়ের একটা অংকের টেস্ট নেবে। তাহলেই বোঝা যাবে ও ঠিক অংকে কোন জায়গায় দূর্বল।

ম্যাম, আপনি যদি আগ্রহী থাকেন এই সানডেতে আমাদের অভিজ্ঞ টিচার আপনার বাড়িতে গিয়ে একটা স্পেশাল সিটিং নেবে। আপনি আপনার সুবিধা মত সময় চেয়ে নিতে পারেন। একনাগাড়ে অনর্গল বলে চলেছে অপরপ্রান্তের মেয়েটি। স্নেহার অংকের নাম্বার কমার জন্য সৌমি ও বেশ চিন্তিত। মেয়েটির উপযাচক হিসাবে পরামর্শগুলো খুব খারাপ লাগছে না। এই তো সেদিন সৌমির এক বান্ধবী তার ছেলেকে ‘ওয়েল ডান’ নামক কোন লার্নিং অ্যাপে ভর্তি করেছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ বলে কথা সৌমিও অস্থির হয়ে উঠেছে।

সৌমি ‘হান্ডেট পার্সেন্ট’ লার্নিং অ্যাপের মেয়েটিকে বলে ওঠে ঠিক আছে আগামী সানডে বিকেল পাঁচটার মধ্যে একটা সিটিং অ্যারেঞ্জ করুন। মেয়েটি গদগদ হয়ে বলে ওঠে’ওকে ম্যাম, আপনাকে আমি পরে ফোন করে কনফার্ম করে নেব।’ মিনিট পনেরো বকবক করার পর মেয়েটি ফোনটি রাখলো।

এতক্ষণ বাথরুমের দরজা ফাঁক করে স্নেহা মায়ের সাথে মেয়েটির কথোপকথন শোনার চেষ্টা করছিল। সৌমি ফোন রাখা মাত্রই সেও বাথরুমে ঢুকে পড়ে আবার। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে স্নান সেরে বেরিয়ে এসে তার মাকে জিজ্ঞাসা করে ‘কে ফোন করেছিল মা?’

সৌমি বলে, ‘হান্ডেট পার্সেন্ট লার্নিং অ্যাপ থেকে তুমি অংক সার্চ করো?’
স্নেহা জানায় ‘মাঝে মাঝে করি মা। যেগুলো স্যারের কাছে বুঝতে অসুবিধা হয় সেগুলো বা যেগুলো একদম ভুলে যাই।’
সৌমি স্নেহাকে বলে ‘ওরা এই সানডে এসে তোমার একটা স্পেশাল টেস্ট নেবে তৈরি থেকো।’

লাঞ্চ রেডি করতে করতেই পুলকও চেম্বার থেকে ফিরে আসে। পুলকের সদাহাস্য চেহারা দেখলেই সৌমির সব মানসিক ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে সৌমি পুলককে বলে ‘হান্ডেট পার্সেন্ট’লার্নিং অ্যাপ এর কথা। সবিস্তারে শোনার পর পুলক হাসতে হাসতে বলে- ‘ওরা একটা স্পেশাল টেস্ট নিয়েই বলে দেবে তোমার মেয়ের অংকে কোথায় দুর্বলতা। সৌমি, একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো স্নেহার কাছ থেকে তুমি কি চাও।’ এই কথা বলে পুলক চেঞ্জ করতে রুমে চলে যায়।

ডাইনিং টেবিলে প্লেট রেডি করতে করতে সৌমি ভাবতে লাগলো পুলকের কথাগুলো। পিছন থেকে স্নেহা এসে জাপ্টে ধরে বলে, ‘মা আমার খুব খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।’ মেয়ে ক্ষুধার্ত এই কথা শোনা মাত্রই তাড়াতাড়ি করে খাবার রেডি করে মেয়েকে খেতে দেয়। স্নেহাকে তৃপ্তি করে খেতে দেখে সৌমির মন আনন্দে ভরে গেল। মনে হতে লাগল পেলেই বা অংকে সে কম নাম্বার তার মেয়ে তো তার ই আছে।

পুলকের চেয়ার টানার আওয়াজে সৌমি ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এসে বাস্তবের মাটিতে পা রাখে। তাদের দু,’জনেরই খাবার আলাদা আলাদা প্লেটে রেডি করে একসাথে বসে তারা। স্নেহার খাওয়া হয়ে গেলে সে বেশিনে হাত ধুয়ে তার রুমে চলে যায়। পুলক চিলি চিকেন খুব একটা পছন্দ করে না তাই ফ্রিজে কিছু রাখা আছে কিনা জানতে চায় সে। দৌড়ে গিয়ে গতকালের মাছের তরকারিটা গরম করে আনে সৌমি। মাছের তরকারিটা ভাতে মাখতে মাখতে পুলক বলে ‘পৃথিবীর সব ভালো কিছুই যে সকলের পছন্দ হবে তা নয়। পরম উপাদেয় চিলি চিকেন ছেড়ে আমার কিন্তু মাছের ঝোল পছন্দ। আসলে নিজের ভালোলাগাটা সম্বন্ধে আমাদের যদি একটা নির্দিষ্ট ধারণা থাকে তাহলে অনেক প্রলোভন থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব। সমস্ত ভালো জিনিসের উপর নাইবা থাকল আমার একচ্ছত্র অধিকার। তোমার কাছে যেটা সেরা আমার কাছে সেটা সেরা নাও হতে পারে।’ একটানা কথাগুলো বলার পর সামান্য হেসে ওঠে পুলক বলে ‘বুঝেছো প্রিয়া। কে কি বলল তাতে মাথা কম ঘামাও। তোমার কতটা প্রয়োজন সেটা নিয়ে ভাবো।’

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে টেবিল ও কিচেনটা পরিষ্কার করে সৌমি হাতমুখ ধুয়ে বেডরুমে গিয়ে মানসিকভাবে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটাকে বিছানার মধ্যে এলিয়ে দেয়। পুলক তো শোওয়া মাত্রই ‘ঘুমের দেশে’ পাড়ি দেয়। স্মার্ট ফোনটা নিয়ে সৌমি সোশ্যাল মিডিয়া খুলতেই তার চোখে পড়ে একটা পোস্ট ‘আমাদের সময় সাতানব্বই, আটানব্বই, নিরানব্বই ও একশ এইগুলো কে জ্বরের টেম্পারেচার বলে জানতাম। আর আজকাল এইগুলো হচ্ছে বর্তমান পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নাম্বার।’ সত্যি তো , পরীক্ষার ফলাফলের নাম্বার কোথায় পৌঁছাচ্ছে! নাম্বারগুলো কি শুধুই পরীক্ষার ফলাফলের নাম্বার, না আমাদের চাহিদার মূল্যায়ন। সবাই আমরা এই ইঁদুর দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছি। গন্তব্য কোথায় কেউ ঠিক জানি না। কিন্তু দৌড়াচ্ছি, প্রানপনে দৌড়াচ্ছি! এই সব সাত পাঁচ ভাবনায় যখন সৌমির মাথাটা বুঁদ হয়ে উঠেছে তখন সময় হবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ভেসে এলো একটা মিষ্টি কন্ঠস্বর -‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু। পথে যদি পিছিয়ে, পিছিয়ে পড়ি কভু।’

সৌমি রুম থেকে বেরিয়ে এসে বুঝতে পারে এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি গাইছে তার ছোট্ট মেয়ে স্নেহা।গান গাইতে খুব ভালোবাসে সে। তবে পড়ার চাপের জন্য এই নাইন থেকে গানটা বন্ধ করে দেবে ভেবেছিল সৌমি। মেয়ের ঘরের দিকে দু’কদম যেতে না যেতেই তার বেডরুম থেকে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। পা চালিয়ে ফোনটা ধরলো সে।অপর প্রান্ত থেকে মিষ্টি গলায় বলে ওঠে ‘হান্ডেট পার্সেন্ট’ লার্নিং অ্যাপ থেকে বলছি ম্যাম। ম্যাম, আগামী রবিবার তাহলে বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমাদের অভিজ্ঞ টিচার অতনু রায় পৌঁছে যাবে আপনার বাড়িতে। ম্যাম, প্লিজ আপনার ঠিকানাটা যদি ডিটেলস বলেন তাহলে খুব উপকার হয়।’

সৌমি শান্ত গলায় মেয়েটিকে জানায়, ‘আমায় ক্ষমা করবেন। এই রবিবার আমরা আপনাদেরকে সময় দিতে পারবো না। কারন আমার মেয়ের বিকেল পাঁচটা নাগাদ গানের টিচার আসবে। স্নেহা অংকে কম নাম্বার পাওয়ার জন্য যেমন আমি চিন্তিত তেমনি আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যদি ওর গানটা বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে ওর জীবনের সুখ দুঃখকে সমান ভাবে গ্ৰহন করার যে শক্তি সে এতদিন সঞ্চয় করেছে তা হয়তো চিরতরে লুপ্ত হয়ে যাবে।

 

Loading

Leave A Comment