গল্প- সে দিনের কথা

সে দিনের কথা
– বিশ্বদীপ মুখার্জী

 

 

বিগত এক বছরে কুড়িজন লেখকের বই প্রকাশ করে ফেলেছে তিলোত্তমা প্রকাশনী। পাবলিশিং হাউস হিসেবে বেশ নাম ডাকও হয়েছে। এক বছর আগে অংশুমান এবং তার বন্ধু রুদ্র মিলে শুরু করেছিল ‘তিলোত্তমা প্রকাশনী’। তখন অংশুমান বলেছিল রুদ্রকে – ‘আমরা আজ পর্যন্ত নিজের কোনও একক বই প্রকাশ করতে পারলাম না রুদ্র। কারণ, আমাদের কাছে অর্থ নেই। আজকাল ভালো লেখার মূল্য কেউ দেয় না। যদি তোর কাছে টাকা থাকে, তাহলে নিজের লেখা বই আকারে নিজের হাতে দেখতে পাবি। সেল্ফ পাবলিশিংএর যুগ এটা।’
‘তাহলে কি আমাদের স্বপ্ন কোনও দিন পুরো হবে না?’ বিষাদে ভরা কন্ঠে রুদ্র জিজ্ঞাসা করেছিল।
খানিক চিন্তা করে অংশুমান বলেছিল – ‘হবে ভাই, হবে। তবে এখন না, একটু অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। আগে অন্যের স্বপ্নপূরণ করে দিই, তার পর নিজেদের চিন্তা করবো।’
‘অন্যের স্বপ্নপূরণ মানে?’ ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি রুদ্র।
তখন তাকে নিজের প্ল্যানটা বুঝিয়েছিল অংশুমান। আজকের দিনে এমন বহুলোক আছে যারা টাকার বিনিময়ে নিজের লেখা বই আকারে দেখতে ইচ্ছুক। যুগটাও সেল্ফ পাবলিশিংএর। এটা একটা এমন ব্যবসা যাতে অল্প পুঁজিতে ভালো লাভ করা যেতে পারে। বই প্রকাশ পাবে লেখকের টাকায়। প্রকাশকের জায়গায় নাম থাকবে অংশুমান আর রুদ্রর পাবলিশিং হাউসের। বই বিক্রি হলে লাভের অংশ বাড়বে, আর যদি নাই বিক্রি হয় তাহলেও চিন্তা করার বিশেষ কিছুই নেই। কারণ, যেখানে পুঁজি লাগেনি সেখানে চিন্তা থাকে না।
লেখকদের ভিড় উপচে পড়েছিল। কিন্তু এখানেও মাথা ঘামিয়ে কাজ করেছিল অংশুমান। সে গল্প নির্বাচন করতো। প্রত্যেক লেখকের গল্প প্রকাশ করা হতো না। অংশুমান গল্প বুঝতো ভালো। এমন গল্প সে প্রকাশ করার অনুমতি দিতো যে গুলোর বাজারে বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা একটু হলেও থাকে। ভালো বই প্রকাশ পেতে থাকলো তিলোত্তমা প্রকাশনী থেকে।
‘টাকা থাকলেই যে আপনার বই আমরা প্রকাশ করে দেবো, এটা ভাববেন না। আগে ভালো লেখা লিখুন।’ বহু নতুন লেখক আছে যাদের অংশুমান এই একই কথা বলেছে।

প্রথমবার কোনও বড় নাম করা লেখকের বই প্রকাশ করতে চলেছে তিলোত্তমা প্রকাশনী। দিব্যেন্দু বন্দোপাধ্যায় আজকের দিনে নাম করা লেখক। তাঁর নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে কোলকাতা প্রেস ক্লাবে। সকাল থেকে অনেক কাজ। বাড়িতে বসে থাকলে চলবে না। কিন্তু আজ কিছুতেই নিজের ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে ইচ্ছে করছে না অংশুমানের। মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে আছে। আকাশের দিকে তাকালো সে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সে দিনও তো আকাশে মেঘ ছিল। হ্যাঁ, সে দিন। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে। সে দিনের সকলটাও ঠিক এমনই ছিল। কিছু মাস হয়েছিল তিলোত্তমা প্রকাশনী কে লোকেরা চিনতে শুরু করেছিল। চার – পাঁচজন লেখকের বইও প্রকাশ করে ফেলেছিল তিলোত্তমা প্রকাশনী। সকালে ঘুম থেকে উঠে সামনের চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়েছিল অংশুমান। কেউ একজন তার পাশে এসে বসলো।
‘নমস্কার। আপনি কি অংশুমান ভট্টাচার্য? তিলোত্তমা প্রকাশনীর কর্ণধার?’
অংশুমান ভালো করে দেখলো লোকটাকে। মাঝ বয়সী লোক, এক মাথা কাঁচা – পাকা রুক্ষ চুল, গায়ের রঙ ময়লা বললেই চলে। পরনের জামাকাপড়ও যে খুব পরিস্কার তা নয়। এক নজর দেখে যে লোকটার প্রতি ভক্তি আসবে না মনে সেটা বলাই বাহুল্য। অংশুমানের মনেও কোনও প্রকারের ভক্তি জাগেনি লোকটাকে দেখে। রীতিমত ভ্রুকুটি করেই তাকালো তার দিকে। জবাব দিলো – ‘হ্যাঁ, আমি অংশুমান ভট্টাচার্য।’
লোকটা অকারণ দাঁত বের করে একগাল হাসলো। দাঁতের অবস্থা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অংশুমান।
‘আজ্ঞে, আমার নাম প্রফুল্ল সরকার। ওই টুকটাক লেখালিখি করি আর কি। আপনার নাম শুনেছি আর বেশ কিছু পত্রিকায় আপনার লেখাও পড়েছি। বেশ ভালো লেখেন আপনি।’
অংশুমান মুখ ঘুরিয়েই ‘ধন্যবাদ’ জ্ঞাপন করলো। লোকটার কাছে ছিল এক কাপড়ের ব্যাগ। সেটা থেকে এক মোটা রেজিস্টার খাতা বের করলো সে।
‘এতে আমার লেখা এক গল্প আছে। বলতে পারেন উপন্যাস। একবার পড়ে দেখতে পারেন।’
‘আপনি কি নিজের এই উপন্যাস কে প্রকাশিত করতে চান?’ জিজ্ঞাসা করলো অংশুমান।
হাসি মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল প্রফুল্ল সরকারের। শুকনো মুখেই বলল – ‘বেশ কিছু প্রকাশকের কাছ থেকে ঘুরে এলাম। সবাই তো টাকা নিয়ে বই ছাপায়। আমার কাছে টাকা নেই তাই কেউ গল্পটা পড়েও দেখলো না।’
‘আমরাও তাই করি সরকার বাবু।’ কথা শেষ করে চায়ের দাম মিটিয়ে এগিয়ে গেল অংশুমান।
‘আপনারা তো সাহিত্যিক মানুষ। লেখালিখি করেন। ভালো লেখার জন্য পড়ারও তো প্রয়োজন। আপনি না হয় পড়ার জন্যই নিয়ে যান।’
অংশুমান তাকালো প্রফুল্ল সরকারের দিকে।
‘অংশুমান বাবু, আমি আপনাকে বলছি না যে আমার গল্পটা প্রকাশ করুন। আমি অতি সাধারণ মানুষ। দিন আনি দিন খাই। টাকা দিয়ে বই ছাপানোর ক্ষমতা আমার নেই। আপনাদের মত দুয়েক জন যদি লেখাটা পড়ে ভালো বলে, তাহলে এতেই আমার শান্তি, এতেই আমার তৃপ্তি।’
অংশুমান আর কথা বাড়ায়নি। তাকে কাজে বেরোতে হবে। প্রফুল্ল সরকারের হাত থেকে রেজিস্টার খাতাটা নিয়ে এগিয়ে গেল নিজের ঘরের দিকে।
চায়ের দোকানে অংশুমান রোজ সকালে যায়। কিন্তু তার পর থেকে কোনও দিন আর প্রফুল্ল সরকারের দেখা পায়নি সে।
‘কোথায় গেল লোকটা?’ মনে মনে ভাবতো অংশুমান।
প্রায় দু মাস পর সময় হলো অংশুমানের প্রফুল্ল সরকারের রেজিস্টার খাতাটা খুলে দেখার। অংশুমান আর রুদ্র যাচ্ছিল ছুটি কাটাতে রাজস্থান। ট্রেনে লম্বা যাত্রা। সাথে কোনও গল্পের বই থাকলে যাত্রাটা মন্দ কাটবে না। হঠাৎ প্রফুল্ল সরকারের কথা মনে পড়ল অংশুমানের। ছোট কোনও বইয়ের বদলে মোটা খাতাটাই ব্যাগে ঢোকালো অংশুমান। পড়তে শুরু করলো প্রফুল্ল সরকারের লেখা উপন্যাস ‘সে দিনের কথা’। না, রাজস্থান সফরে বিশেষ কোথাও ঘুরতে যায়নি অংশুমান। অধিকাংশ সময় হোটেলে বসে সেই উপন্যাসটা পড়ে যেত সে। যত পড়তো, ততই যেন গল্পের গভীরে ঢুকে যেত সে। অদ্ভুত সুন্দর লেখা। বেশ কিছু বই অংশুমান আর রুদ্র প্রকাশ করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই, কিন্তু এমন লেখা তারা কোনও দিন পায়নি। উপন্যাসটা মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে গেল অংশুমান। রাজস্থান থেকে ফেরার সময় খাতাটা রুদ্রের হাতে দিয়ে অংশুমান বলল – ‘এই উপন্যাসটা পড়ে দেখিস। আমরা যদি এই উপন্যাসকে না ছাপি তাহলে এর লেখকের সাথে অন্যায় করা হবে।’
‘এত মোটা উপন্যাস? কম করেও কুড়ি ফর্মার বই হবে।’ বলল রুদ্র।
‘হুম, তা হবে। কিন্তু লেখক টাকা দিতে পারবে না। লোকটা গরীব। স্মার্ট ফোনের যুগেও হাতে লেখে সে।’
‘কিন্তু এত ইনভেস্টমেন্ট করবে কে?’ রুদ্র জিজ্ঞাসা করলো।
‘আমরা করবো। গল্পটা দুর্দান্ত। ভালো চলবে মার্কেটে। এমন লোকেদের এগিয়ে নিয়ে আনা দরকার রুদ্র। পকেটে টাকা থাকলে আর হাতে কলম থাকলেই লেখক হওয়া যায় না। আজকাল সবাই এটাই ভেবে নিয়েছে যে পকেটে টাকা থাকলেই লেখক হওয়া যায়। যাই লিখুক, প্রকাশনীকে টাকা দিলেই তারা লেখা প্রকাশিত করে দেবে। আজকাল চারিদিকে এটাই হচ্ছে। লেখার মান দিনে দিনে পড়ে যাচ্ছে রুদ্র। আজকের দিনে প্রফুল্ল সরকারের মত লেখকেরা তলিয়ে যাচ্ছে। এটা কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর। সাহিত্যকে রসাতলে যাওয়ার আগে বাঁচাতে হবে। প্রফুল্ল সরকারের মত লেখকদের এগিয়ে আনতে হবে।’
‘তার ফোন নম্বর আছে?’
‘না, তবে গল্পের শেষে তার ঠিকানা আছে। আমি সেই ঠিকানাতে যাবো।’

গিয়েছিল অংশুমান। কোলকাতা ফিরে আসার পরের দিনই গিয়েছিল প্রফুল্ল সরকারের বাড়িতে। আগরপাড়ায় বাড়ি প্রফুল্ল সরকারের। ছোট একতলা বাড়ি। বাড়ি খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না অংশুমানের। এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা ছাড়া মাঝ বয়সী এক মহিলার সাথে দেখা হলো অংশুমানের। বুঝতে অসুবিধে হলো না যে এরা প্রফুল্ল সরকারের মা, বাবা এবং স্ত্রী। প্রফুল্ল সরকারের খোঁজ করতে তার স্ত্রী বলল – ‘আপনি কি তার বন্ধু?’
‘না, মানে আমি তার বন্ধু নয়। বেশ কিছু মাস আগে প্রফুল্ল বাবু আমার কাছে একটা গল্প নিয়ে আসেন। গল্পটা এত দিনে পড়ার সময় পেলাম আমি। সে বিষয়ে ওনার সাথে কথা ছিল আর কি।’ একটু ইতস্তত করে অংশুমান বলল।
‘আপনি কি অংশুমান বাবু?’ আবার প্রশ্ন করলো প্রফুল্ল সরকারের স্ত্রী।
প্রফুল্ল সরকার তার মানে নিজের বাড়িতে অংশুমানের বিষয় চর্চা করেছে।
‘হ্যাঁ, আমিই অংশুমান ভট্টাচার্য।’
অংশুমানকে ঘরে বসতে দিয়ে চা করে নিয়ে আনলো প্রফুল্ল বাবুর স্ত্রী। প্রফুল্ল বাবুর মা এবং বাবা কিছুই বলছেন না, শুধু অবাক নয়নে দেখে যাচ্ছেন অংশুমানকে।
প্রফুল্ল সরকারের স্ত্রী বলল – ‘অনেক দিন আপনার অপেক্ষা করেছিল। আমাকে বলতো যে গল্পটা যখন আপনি পড়তে নিয়েছেন তখন আপনার ভালো নিশ্চই লাগবে। আমরা অতি গরীব মানুষ বাবু। তার কাছে টাকা দিয়ে বই বের করার ক্ষমতা ছিল না। লেখা তার শখ ছিল। কাজ থেকে ফিরে এসে প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত লিখে যেত। এই নিয়ে আমার সাথে অশান্তিও কম হয়নি। শুধু বলতো, ”আমার গল্প এক না এক দিন কারোর না কারোর পছন্দ নিশ্চই হবে।” নিজের গল্পকে ছাপা অক্ষরে দেখতে কে না ভালোবাসে? বহু পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছে। সব জায়গায় টাকা চায়। কোথাও দেড় শো তো কোথাও দু শো। কোথাও কোথাও তো আবার বলতো যে দু তিনটে পত্রিকা নাকি কিনে নিতে হবে। ওতো ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের কাছে দেড় – দু শো টাকার মূল্য অনেক। সারা দিন মন খারাপ করে থাকতো সে। আপনাকে ওই লেখাটা দেওয়ার পর একটু আশা জেগেছিল তার মনে। চলা ফেরা খুব একটা বেশি করতে পারতো না। তাই আর যেতে পারেনি আপনার কাছে। আপনার অপেক্ষায় ছিল।’
ভিতর ঘর থেকে বেশ কিছু খাতা নিয়ে এলো প্রফুল্ল সরকারের স্ত্রী। সবগুলোতেই প্রফুল্ল সরকারের লেখা ছোট বড় গল্প। বেশ কিছু ছোট গল্প পড়ল অংশুমান। সত্যি, অপূর্ব লেখা। প্রফুল্ল বাবুর কলমে যেন জাদু আছে।
‘তিনি কোথায় এখন?’ অংশুমান জিজ্ঞাসা করলো।
খানিক চুপ থাকার পর মহিলাটি বলল – ‘সে আর নেই। একমাস হলো সে মারা গেছে।’
চমকে উঠল অংশুমান। নিজের কানে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
‘বহুদিনের অসুস্থ সে। কিডনী রোগে আক্রান্ত। তার ইচ্ছে ছিল যাওয়ার আগে যেন দেখে যেতে পারে তার লেখা কোনও বই বেরিয়েছে। তার শেষ ইচ্ছেটা আর পুরো হলো না।’
কথাটা বলে কেঁদে ফেলল প্রফুল্ল বাবুর স্ত্রী। অংশুমান অনুভব করলো নিজের চোখেও দু ফোঁটা জল।

প্রায় এক বছর হয়ে গেল। আজ দিব্যেন্দু বন্দোপাধ্যায়ের মত বিখ্যাত লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। তিলোত্তমা প্রকাশনীর জন্য আজকের দিনটা গর্বের। কিন্তু বিন্দুমাত্র গর্ব হচ্ছে না অংশুমানের। তার গর্ব তখন হতো যখন সে প্রফুল্ল সরকার কে এমন খ্যাতি দিতে পারতো। অংশুমান যদি ঠিক সময় সেই গল্পটা পড়তো তাহলে মৃত্যুর আগে একটা বই লিখেই নাম করতে পারতো সেই দরিদ্র লেখকটা। সে ছাপাবে, প্রফুল্ল সরকারের প্রতিটি গল্প সে প্রকাশ করবে। প্রফুল্ল সরকারের প্রতিটি বই তার মৃত্যুর পর প্রকাশ পাবে। তাকে এই কাজটা করতেই হবে। প্রফুল্ল সরকারের লেখাকে জনসমূহের সামনে আনতেই হবে। ‘সে দিনের কথা’ উপন্যাসটা সে প্রফুল্ল বাবুর স্ত্রী কে দিয়ে এসেছিল। সেটা ফেরত আনতে হবে।
নিজের বাড়ি থেকে বেরোল অংশুমান। তার গন্তব্য এখন প্রেস ক্লাব নয়, তার গন্তব্য এখন প্রফুল্ল সরকারের বাড়ি।

সমাপ্ত।

Loading

One thought on “গল্প- সে দিনের কথা

  1. অনবদ্য,,,,,বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন,,,ধন্যবাদ

Leave A Comment